রেলা – ২
স্বপন রায়
মাঝরাতের চক্রধরপুর। ১২ জানুয়ারি ১৯৭১, আমি আমার ঠোঁটে চা নেওয়ার মুহূর্তে, সেই আমানবিক শীতের কম্প্রমান আদেখলাপনায়
তখন আমি অবশ আর প্রায় নৈরাজ্যবাদী,
যেন চা ছাড়া আর অন্য কিছু এই পনেরো বছরের
তুচ্ছ জীবনের কাছে গ্রাহ্য নয়, এরকম একটি অসংবৈধানিক চাঞ্চল্যে যখন আমি মৃতপ্রায়, তখন
সেই মৃত্যুধার মুহূর্তেই অভি সামনের লোকটিকে হাত দিয়ে ডেকে উঠলো। অভির ঠোঁটে সিগারেট, সে তখন তুমুলভাবে অগ্নিপ্রবণ এবং থরথর।
লোকটি এবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো, অরূপের বাবা!
তার আগে অভি বলে দিয়েছে,
দাদা আগুনটা দেবেন?
লোকটি এখন বাবা, অরূপের
বাবা!
-অভি না?
অভি সিগারেট মুখে নিয়ে
কিছু একটা বললো।
অরূপের বাবার চোখে তখন
এক ঠাণ্ডা বিচারকের চাউনি... গলার সুর একটু তুলে আবার বললেন, অভি তো?
শীতের এই মজা! অভি’র
জ্যাকেট, অভির টুপি/মাফলার, আর শীতের ভারি কুয়াশা একটা বোদলেরীয় রোমান্টিসিজিমে নিয়ে যাচ্ছিলো
আমাদের, ভয়ানক কিন্তু আবছা, সংহারক কিন্তু দ্বিধাপ্রবণ, তো এই শীতের সুযোগ নিয়ে
অভি কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আমায় ডাক দেয়, আরে হো লাখন, মাচিস হ্যায় নু? আমি
বুঝে যাই। এরে কয় ডিসিভ করা, থ্রু ভাষা!
অরূপের বাবা একটু অবাক
যেন, বলেন, পাকামি হচ্ছে, আমি কিন্তু ধরে ফেলেছি...
অভি মুখের বাঁক ঘুরিয়ে
আবার বলে, লাখন হ্যায় নু মাচিস... আগে চলকে দেখ নু...
আমি ঘাবড়ে যাই, যে হারে
অভি নু নু করে চলেছে... একটা ইয়ে না হয়ে যায়...
অরূপের বাবা এবার
এগোচ্ছেন, শুনতে পেলাম তাঁর রাগী আওয়াজও, এই এতো নুনু নুনু করছিস কেন? তোর বিহারী
সাজা বের করছি হারামজাদা...
এরপর আর কী? পুরো
ন্যুভেল ভাগ সিনেমা... ভাগ ভাগ...
আমরা দৌড় দিই... অরূপের বাবা পিছিয়ে পড়েন...
আমাদের কামরা পিছনের দিকে... এসে উঠি। আমাদের
পনেরো বছরের কৈশোর তখন ঘর্মাক্ত। অভি হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, মাঙ্কি ক্যাপ আছে না? পরে
নে... আমি ইশারা বুঝে মাঙ্কি ক্যাপ পরে
নিই। অরূপের বাবা আমায় সে ভাবে দেখেননি, আমি চাই না দেখুক! আমরা দুজনেই অতএব মাঙ্কি ক্যাপড। আমাদের
জুলজুল করে তাকানো, আমাদের নার্ভাসনেস, এ সবই আর একটা প্রতিক্রিয়া তৈরি করে দিয়েছে
তখন। আমাদের সামনে এমন একজন ছিল কাল রাতে, যাকে দেখে ‘হুস্ন কি রানী / বাহারোঁ কি মালিকা...’ ইত্যাদি
ভুল সুরে চাপা গলায় গাইতে শুরু করে দিয়েছিল অভি। মেয়েটি কি হেসেছিল, আড়চোখে কি ছিল
আড়ঝারির আস্কারা? আমার সেরকম মনে হয়নি, অভি কিন্তু বারবারই বলছিলো, হাসছে রে! আমি, বিরক্ত হয়ে বলেছিলাম,
তোকে দেখে, না তোর গান শুনে? মেয়েটির বাবা, মা তাদের মেয়েকে ডাকছিলো খুকুমণি, খুকুমণি...
বারেবারেই... অভি আমার দিকে ঝুঁকে একসময় বলেই ফেললো, খুকুমণি!হেব্বি নাম, না?
সেই খুকুমণি শুনলাম ওর মাকে বলছে, মা আমি
বলেছিলাম না, এই দুটো চোর!... আমি আর অভি বাঁদুরে টুপির কেয়ারে বাক হারিয়ে অবাক
হারিয়ে ভ্যাবা! বলে কী? অফ অল থিংস, চোর! কাল রাত থেকে চোর ভাবছে আমাদের... অভি কীভাবে
যেন হাসলো। ‘হুস্ন কি রানী’ এখন মাকে জাগিয়ে, বাবাকে জাগিয়ে, সপরিবারে আমাদের
তাকিয়ে। আমাদের ঘাম, আমাদের দৌড়জনিত হাঁপ,
আমাদের অচানক মাঙ্কি ক্যাপ পরে নেওয়া, আমাদের যে চোরের ব্যক্তিত্বে নিয়ে গিয়েছিল, বুঝতে
পারিনি। আমি প্রতিবাদ করতে যাব, ঐ আলো না থাকা কামরায় আমার অপমানিত মুখে প্রায়
একটা চরম প্রতিবাদ এসে যাচ্ছিল যখন, দেখলাম
আধা অন্ধকারে একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে অরূপের বাবা। আমি থেমে যাই। অভি হঠাৎ মুখটাকে
প্যরালিটিক করে তুললো। খুকুমণি বললো, দেখো বাবা মুখটাকে অন্যরকম করে লুকোতে চাইছে!
আমাদের সামনে চোরদেখা পরিবারের প্রত্যেকের মুখে প্রবল সন্দেহ। একটু দূরে করিডোরে
দাঁড়ানো অরূপের বাবা আর আমরা
দু’জনে এক রাতজাগা ট্রেনের দুলুনিতে সব খোঁজা,
সব অপমানের বদলা নিতে শুরু করি ঘুমোবার ভান করে!
আর ঘুমিয়েই পড়ি একসময়। ঐ ঘুম ছিলো এতটাই লম্বা যে, ঘুম ভাঙার পরে আমরা বুঝতে পারি, যে স্টেশনে ট্রেন এসে থেমে আছে, তার নাম সম্বলপুর। আমাদের স্টেশন রাউরকেলা
প্রায় পাঁচ ঘন্টা আগে পেরিয়ে গেছে। আর নেমে গেছেন অরূপের বাবা, হুস্ন কি রানীর
পরিবারও!
আমরা টি.টি’র হাতে ধরা পড়ার ভয় নিয়ে নেমে আসি
সম্বলপুর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে... সকাল
জাপ্টে ধরে আমাদের।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন