অর্ক চট্টোপাধ্যায়
কবীর সুমন নিজের ওয়েবসাইটে ২০১২র দোসরা ডিসেম্বর একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন যার নাম 'An Important Statement'। প্রসঙ্গ সাম্প্রতিক পুরস্কার বিতর্ক যা বহুদিনের বন্ধু অঞ্জন দত্তর সাথে এক অস্বস্তির জায়গা তৈরি করেছিল। অঞ্জনের 'রঞ্জনা' ছবির জন্য নীল দত্ত জাতীয় পুরস্কার পেলেও সেখানে সুমনের গাওয়া 'গানওলা' বা তাঁর বেছে দেওয়া “জাগরণে যায় বিভাবরি”র কোনো ঋণস্বীকার হয়নি বলে তিনি দুঃখ পেয়েছিলেন। জাতীয় পুরস্কারে ওভাবে নাম পাঠানো যায় না বলে জানানো হয়েছিল অঞ্জনের তরফে। এই সিকুয়েন্সের মহামুহূর্ত হলো সুমনের বহুদিনের বন্ধু জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়ের থেকে তাঁর জানতে পারা যে, International Bengali Film Critics' Award-এর ক্ষেত্রেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। জগন্নাথবাবু বিচারকদের একজন হওয়ায় সুমন জানতে পেরেছিলেন, এই প্রতিযোগিতায় নাম পাঠানোর বন্দোবস্ত ছিল। সুমনের কন্ঠে তাঁর নিজের কম্পোজিসন রয়েছে ছবিটিতে। সেক্ষেত্রে সংগীত পরিচালনার জন্য নাম পাঠানো হলে নীল দত্তর পাশে সুমনের নামটাও পাঠানো সংগত বলেই মনে হয়। সুমনের দাবি অযৌক্তিক নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তবে কি এতদিনের আপোষহীন প্রতিরোধের পর কবীর সুমন পুরস্কারাকাঙ্ক্ষী হয়ে উঠলেন? এই বিভ্রান্তি দূর করতেই তাঁর বিবৃতি, যেখানে তিনি স্পষ্টতই জানিয়েছিলেন, পুরস্কার পেতে আর পাঁচটা লোকের মতো তাঁরও ভালোই লাগে। কিন্তু এখানে প্রশ্ন পুরস্কারের নয়, প্রশ্ন নমিনেশনের। তিনি লিখেছেন: “Nomination as a gesture, as a metaphor”. যদিও নিজেই এই ইংরেজি বাক্যটিকে কটাক্ষ করেছেন আবার: “এই এতক্ষণে আমি আঁতেল ভাষায় ব্যপারটা বলতে পারলাম”।
আমরা এই আঁতেল ভাষাকে ঘিরেই কিছু কথা বলব। “অনেককালের বন্ধুর এক টুকরো নমিনেশন” নিয়ে কথা বলব। ‘নমিনেশন’ শব্দের অর্থ মোদ্দায় নির্বাচন। বাংলায় যাকে বলে মনোনয়ন। সন্ধি-সমাস-প্রত্যয়ের ভাষায় দেখলে, মনের ভিতর কোনো কিছুকে নিয়ে আসার নাম মনোনয়ন। কী নিয়ে আসা হবে মনের ভিতর? ‘নমিনেশন’ শব্দেই তার উত্তর রয়েছে। নাম; কোনো এক প্রিয়জনের নাম মনের ভিতর, মুখের ভিতর আর মুখের ভিতর থেকে মুখের বাইরে নিয়ে আসাই আসল মনোনয়ন বা ‘নমিনেশন’! সুমন কি আমাদের প্রজন্মকে, আত্মবিস্মৃতি ভালবাসে এমন বাঙালি জাতিকে এই ঋণী এবং কৃতজ্ঞ মনোনয়নের পাঠ দেননি তাঁর গান ও পারফরমেন্সের মধ্য দিয়ে? সুমনের এই দাবি আসলে যতটা না যুক্তির, তার থেকে অনেক বেশি আবেগের, বন্ধুতার! তিনি বরাবরের মতো এখানেও আমাদের থেকে সেই উপহারটাই চেয়েছেন; যে উপহারের মূল্য বহুদিন ধরে তিনি আমাদের বুঝিয়েছেন বা অন্তত বোঝানোর চেষ্টা করেছেন!
প্রতিটি দেশ, ভাষা আর সংস্কৃতির একটা স্মৃতি থাকে। তা কখনো বইয়ে ধরা থাকে, কখনো আবার মুখের মধ্যে, মনের মধ্যে। আর্কাইভ শুধু বইয়ের পাতা নয়, চলন্ত জীবন্ত মানুষও এক একটা আর্কাইভ, যেখানে বিস্মৃতপ্রায় অথচ স্মরণীয় এক এক প্রিয়জনের নাম ধরা থাকে। আমরা চলতে ফিরতে যখন তাঁদের নাম করি, তখন সেই মনোনয়ন আমাদের সাংস্কৃতিক স্মৃতিকে জাগিয়ে রাখে, বাঁচিয়ে রাখে। যেমন আমার মাস্টারমশাই শ্রীঅম্লান দাশগুপ্ত তাঁর মাস্টারমশাই শ্রীঅরুণকুমার দাশগুপ্তর নাম করেন বা আমার আরেক মাস্টারমশাই শ্রীশান্ত্বনু বিশ্বাস প্রফেসর গিলের নাম করেন। সুমনও এভাবেই আমাদের ‘রাই জাগ’তে শেখান তাঁর গানে। ধারণ করার চেষ্টা করেন বাংলার সাংগীতিক সংস্কৃতির ক্ষয়িষ্ণু স্মৃতিকে তাঁর মিউজিক্যাল প্র্যাকটিস দিয়ে। ‘খোদার কসম জান’ গানে হঠাৎ ঢুকে পড়েন শ্যামল মিত্র আর তাঁর গান ‘তরীখানি ভাসিয়ে দিলাম’; ‘নাগরিক কবিয়াল’ আঁকড়ে ধরে লালনকে; ‘জাগে জাগে রাত’ মনে করে আমীর খানের ললিতকে; পান্নালাল ঘোষের ‘নূপুরধ্বনি’ রাগে খেয়াল বাঁধেন; হিমাংশু দত্তর ভুলে যাওয়া গান ফিরিয়ে দেন; সুধীরলাল চক্রবর্তীর গান গেয়ে ওঠেন অনুষ্ঠানে— এই বাক্য অসমাপ্য। কলামন্দিরে তাঁর ২০১২র জন্মদিনের অনুষ্ঠানে স্টেজের তিনটে ভাগের দ্বিতীয়টায় অর্থাৎ মধ্যিখানে দুটো চেয়ার রাখা ছিল বন্ধুদের জন্য। এক বাল্যবন্ধুকে ডেকে এনে বসিয়ে গান শুনিয়েছিলেন তিনি; আবারও চেয়েছিলেন তাঁর বন্ধুতা।
সুমনের গান এমনি সব বন্ধুদের গান। শহিদ কাদরির জন্য ‘তোমাকে অভিবাদন’, ‘UAPA-র শহীদ স্বপন দাশগুপ্ত’ কিম্বা বন্ধু আয়ান রশিদের জন্য এসব গান। এসব গান সুফিয়া কামালের জন্য, ফুলমণি, কাঞ্চন, সঞ্জীব পুরোহিত এবং আরও অসংখ্য সময়ের গিলোটিনে আটক নামের জন্য। সুমন ক্রমশ সঙ্গীত ছাড়িয়ে আমাদের গোটা সময়ের স্মৃতিটাকে ধরে রাখতে চান। সেলিব্রেট করেন এইসব নামকে। এক-একটা নাম এক-একটা প্রতিরোধ; কখনো তা সাংগীতিক, কখনো প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক। সুমন একটি গানে লিখেছিলেন, “কার নাম ঝরে যায় একা বিলকুল”। সুমনের গানের প্র্যাকটিস এইসব নামকে ঝরে যেতে না দেবার প্র্যাকটিস; এভাবেই তো ইতিহাস তার তাবড় স্মৃতি নিয়ে রক্ষা করে কত কত বিশেষ নামবাচক শব্দকে; ব্যতিক্রমের নামে, প্রতিরোধের নামে, আবার ভালবাসারও নামে; বন্ধুতারও নামে। আমাদের সমসময়ে কবীর সুমন এমন এক নমিনেশনের নাম, যিনি নিজেই নৈতিক বিশ্বস্ততার এক মনোনয়ন। এই মনোনয়নের মধ্য দিয়ে নিজের গানে একরকমের কমিউন গড়েন কবীর। নিজের নামও পাল্টাতে থাকেন। তাঁর নামের কমিউন বদল ধরে রাখে, ধরে রাখে “পাল্টে দেবার স্বপ্ন”টাকে। ফরাসী দার্শনিক আলেন বাদিউ তাঁর The Communist Hypothesis গ্রন্থে কমিউনিজমের ধারণা দিয়ে এভাবেই ব্যক্তি-নামকে রক্ষা করার কথা বলেছেন---“[...] the communist idea […] refers directly to the infinity of the people—needs the finitude of proper names”। ইতিহাসের প্রক্ষেপণে যে সব নামেরা একা একা ঘুরে বেড়ায় ইতি উতি, তাদের সঙ্ঘবদ্ধ করে একটা বয়ান তৈরি করে সুমনের গান। সেখানে সাহিত্য-সঙ্গীতের মহান নামগুলির পাশে অমোঘ এক সমতা নিয়ে বসবাস করে সাধারণ সব ব্যক্তি-নাম। একই সূত্রে গ্রথিত হন অনিতা দেওয়ান আর অখিলবন্ধু ঘোষ। তাঁরা বন্ধু হয়ে ওঠেন ক্রমশ!
২০১২র ২৫শে নভেম্বর আনন্দবাজারের রবিবাসরীয়তে ‘সুমনামি’ বিভাগে কবীর সুমন ট্রাফিক সিগনালে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজানো নিয়ে লিখেছিলেন। প্রশ্ন তুলেছিলেন, ট্রাফিক সিগনাল সঙ্গীত শোনার আদর্শ পরিবেশ হতে পারে কিনা তা নিয়ে। এখানেও কি অন্য আর একরকম মনোনয়ন নেই! ট্রাফিক সিগনালে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজানোও তো এক ধরনের নমিনেশন! বেশ তো লোকে বাসে যেতে যেতে এক টুকরো হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পেয়ে যাচ্ছে! তাঁদের নাম মনে রাখছে! এও তো সাংস্কৃতিক স্মৃতি! প্রশ্ন হলো, ঐ কণ্ঠ আসলে কার? হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের? সুচিত্রা মিত্রর? নাকি ঐ সকল কণ্ঠই এক এবং অদ্বিতীয় এক রাজার, যিনি কয়েকটি অসামান্য নাম ও তাঁদের কণ্ঠকে বাজেয়াপ্ত করেছেন? তাঁর মহামহিমায় আমরা “ব্যঙ্গ করে ব্যঙ্গমা আর ব্যঙ্গ করে ব্যঙ্গমী”! আমাদের চারপাশে এই দুই ধরনের মনোনয়নের খেলাধুলা চলছে। কেউ নাম দিয়ে জলের আলপনা করে সংস্কৃতির ধ্বজা ধরছেন; কেউ আবার কয়েকটা নাম দিয়ে আমাদের ‘অন্ধ সাজার অনুরাগ’কে মেপে নিচ্ছেন। আর আমরা ‘গ্যালারিতে বসে গালিলিও’!
কবীর সুমন নিজের ওয়েবসাইটে ২০১২র দোসরা ডিসেম্বর একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন যার নাম 'An Important Statement'। প্রসঙ্গ সাম্প্রতিক পুরস্কার বিতর্ক যা বহুদিনের বন্ধু অঞ্জন দত্তর সাথে এক অস্বস্তির জায়গা তৈরি করেছিল। অঞ্জনের 'রঞ্জনা' ছবির জন্য নীল দত্ত জাতীয় পুরস্কার পেলেও সেখানে সুমনের গাওয়া 'গানওলা' বা তাঁর বেছে দেওয়া “জাগরণে যায় বিভাবরি”র কোনো ঋণস্বীকার হয়নি বলে তিনি দুঃখ পেয়েছিলেন। জাতীয় পুরস্কারে ওভাবে নাম পাঠানো যায় না বলে জানানো হয়েছিল অঞ্জনের তরফে। এই সিকুয়েন্সের মহামুহূর্ত হলো সুমনের বহুদিনের বন্ধু জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়ের থেকে তাঁর জানতে পারা যে, International Bengali Film Critics' Award-এর ক্ষেত্রেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। জগন্নাথবাবু বিচারকদের একজন হওয়ায় সুমন জানতে পেরেছিলেন, এই প্রতিযোগিতায় নাম পাঠানোর বন্দোবস্ত ছিল। সুমনের কন্ঠে তাঁর নিজের কম্পোজিসন রয়েছে ছবিটিতে। সেক্ষেত্রে সংগীত পরিচালনার জন্য নাম পাঠানো হলে নীল দত্তর পাশে সুমনের নামটাও পাঠানো সংগত বলেই মনে হয়। সুমনের দাবি অযৌক্তিক নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তবে কি এতদিনের আপোষহীন প্রতিরোধের পর কবীর সুমন পুরস্কারাকাঙ্ক্ষী হয়ে উঠলেন? এই বিভ্রান্তি দূর করতেই তাঁর বিবৃতি, যেখানে তিনি স্পষ্টতই জানিয়েছিলেন, পুরস্কার পেতে আর পাঁচটা লোকের মতো তাঁরও ভালোই লাগে। কিন্তু এখানে প্রশ্ন পুরস্কারের নয়, প্রশ্ন নমিনেশনের। তিনি লিখেছেন: “Nomination as a gesture, as a metaphor”. যদিও নিজেই এই ইংরেজি বাক্যটিকে কটাক্ষ করেছেন আবার: “এই এতক্ষণে আমি আঁতেল ভাষায় ব্যপারটা বলতে পারলাম”।
আমরা এই আঁতেল ভাষাকে ঘিরেই কিছু কথা বলব। “অনেককালের বন্ধুর এক টুকরো নমিনেশন” নিয়ে কথা বলব। ‘নমিনেশন’ শব্দের অর্থ মোদ্দায় নির্বাচন। বাংলায় যাকে বলে মনোনয়ন। সন্ধি-সমাস-প্রত্যয়ের ভাষায় দেখলে, মনের ভিতর কোনো কিছুকে নিয়ে আসার নাম মনোনয়ন। কী নিয়ে আসা হবে মনের ভিতর? ‘নমিনেশন’ শব্দেই তার উত্তর রয়েছে। নাম; কোনো এক প্রিয়জনের নাম মনের ভিতর, মুখের ভিতর আর মুখের ভিতর থেকে মুখের বাইরে নিয়ে আসাই আসল মনোনয়ন বা ‘নমিনেশন’! সুমন কি আমাদের প্রজন্মকে, আত্মবিস্মৃতি ভালবাসে এমন বাঙালি জাতিকে এই ঋণী এবং কৃতজ্ঞ মনোনয়নের পাঠ দেননি তাঁর গান ও পারফরমেন্সের মধ্য দিয়ে? সুমনের এই দাবি আসলে যতটা না যুক্তির, তার থেকে অনেক বেশি আবেগের, বন্ধুতার! তিনি বরাবরের মতো এখানেও আমাদের থেকে সেই উপহারটাই চেয়েছেন; যে উপহারের মূল্য বহুদিন ধরে তিনি আমাদের বুঝিয়েছেন বা অন্তত বোঝানোর চেষ্টা করেছেন!
প্রতিটি দেশ, ভাষা আর সংস্কৃতির একটা স্মৃতি থাকে। তা কখনো বইয়ে ধরা থাকে, কখনো আবার মুখের মধ্যে, মনের মধ্যে। আর্কাইভ শুধু বইয়ের পাতা নয়, চলন্ত জীবন্ত মানুষও এক একটা আর্কাইভ, যেখানে বিস্মৃতপ্রায় অথচ স্মরণীয় এক এক প্রিয়জনের নাম ধরা থাকে। আমরা চলতে ফিরতে যখন তাঁদের নাম করি, তখন সেই মনোনয়ন আমাদের সাংস্কৃতিক স্মৃতিকে জাগিয়ে রাখে, বাঁচিয়ে রাখে। যেমন আমার মাস্টারমশাই শ্রীঅম্লান দাশগুপ্ত তাঁর মাস্টারমশাই শ্রীঅরুণকুমার দাশগুপ্তর নাম করেন বা আমার আরেক মাস্টারমশাই শ্রীশান্ত্বনু বিশ্বাস প্রফেসর গিলের নাম করেন। সুমনও এভাবেই আমাদের ‘রাই জাগ’তে শেখান তাঁর গানে। ধারণ করার চেষ্টা করেন বাংলার সাংগীতিক সংস্কৃতির ক্ষয়িষ্ণু স্মৃতিকে তাঁর মিউজিক্যাল প্র্যাকটিস দিয়ে। ‘খোদার কসম জান’ গানে হঠাৎ ঢুকে পড়েন শ্যামল মিত্র আর তাঁর গান ‘তরীখানি ভাসিয়ে দিলাম’; ‘নাগরিক কবিয়াল’ আঁকড়ে ধরে লালনকে; ‘জাগে জাগে রাত’ মনে করে আমীর খানের ললিতকে; পান্নালাল ঘোষের ‘নূপুরধ্বনি’ রাগে খেয়াল বাঁধেন; হিমাংশু দত্তর ভুলে যাওয়া গান ফিরিয়ে দেন; সুধীরলাল চক্রবর্তীর গান গেয়ে ওঠেন অনুষ্ঠানে— এই বাক্য অসমাপ্য। কলামন্দিরে তাঁর ২০১২র জন্মদিনের অনুষ্ঠানে স্টেজের তিনটে ভাগের দ্বিতীয়টায় অর্থাৎ মধ্যিখানে দুটো চেয়ার রাখা ছিল বন্ধুদের জন্য। এক বাল্যবন্ধুকে ডেকে এনে বসিয়ে গান শুনিয়েছিলেন তিনি; আবারও চেয়েছিলেন তাঁর বন্ধুতা।
সুমনের গান এমনি সব বন্ধুদের গান। শহিদ কাদরির জন্য ‘তোমাকে অভিবাদন’, ‘UAPA-র শহীদ স্বপন দাশগুপ্ত’ কিম্বা বন্ধু আয়ান রশিদের জন্য এসব গান। এসব গান সুফিয়া কামালের জন্য, ফুলমণি, কাঞ্চন, সঞ্জীব পুরোহিত এবং আরও অসংখ্য সময়ের গিলোটিনে আটক নামের জন্য। সুমন ক্রমশ সঙ্গীত ছাড়িয়ে আমাদের গোটা সময়ের স্মৃতিটাকে ধরে রাখতে চান। সেলিব্রেট করেন এইসব নামকে। এক-একটা নাম এক-একটা প্রতিরোধ; কখনো তা সাংগীতিক, কখনো প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক। সুমন একটি গানে লিখেছিলেন, “কার নাম ঝরে যায় একা বিলকুল”। সুমনের গানের প্র্যাকটিস এইসব নামকে ঝরে যেতে না দেবার প্র্যাকটিস; এভাবেই তো ইতিহাস তার তাবড় স্মৃতি নিয়ে রক্ষা করে কত কত বিশেষ নামবাচক শব্দকে; ব্যতিক্রমের নামে, প্রতিরোধের নামে, আবার ভালবাসারও নামে; বন্ধুতারও নামে। আমাদের সমসময়ে কবীর সুমন এমন এক নমিনেশনের নাম, যিনি নিজেই নৈতিক বিশ্বস্ততার এক মনোনয়ন। এই মনোনয়নের মধ্য দিয়ে নিজের গানে একরকমের কমিউন গড়েন কবীর। নিজের নামও পাল্টাতে থাকেন। তাঁর নামের কমিউন বদল ধরে রাখে, ধরে রাখে “পাল্টে দেবার স্বপ্ন”টাকে। ফরাসী দার্শনিক আলেন বাদিউ তাঁর The Communist Hypothesis গ্রন্থে কমিউনিজমের ধারণা দিয়ে এভাবেই ব্যক্তি-নামকে রক্ষা করার কথা বলেছেন---“[...] the communist idea […] refers directly to the infinity of the people—needs the finitude of proper names”। ইতিহাসের প্রক্ষেপণে যে সব নামেরা একা একা ঘুরে বেড়ায় ইতি উতি, তাদের সঙ্ঘবদ্ধ করে একটা বয়ান তৈরি করে সুমনের গান। সেখানে সাহিত্য-সঙ্গীতের মহান নামগুলির পাশে অমোঘ এক সমতা নিয়ে বসবাস করে সাধারণ সব ব্যক্তি-নাম। একই সূত্রে গ্রথিত হন অনিতা দেওয়ান আর অখিলবন্ধু ঘোষ। তাঁরা বন্ধু হয়ে ওঠেন ক্রমশ!
২০১২র ২৫শে নভেম্বর আনন্দবাজারের রবিবাসরীয়তে ‘সুমনামি’ বিভাগে কবীর সুমন ট্রাফিক সিগনালে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজানো নিয়ে লিখেছিলেন। প্রশ্ন তুলেছিলেন, ট্রাফিক সিগনাল সঙ্গীত শোনার আদর্শ পরিবেশ হতে পারে কিনা তা নিয়ে। এখানেও কি অন্য আর একরকম মনোনয়ন নেই! ট্রাফিক সিগনালে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজানোও তো এক ধরনের নমিনেশন! বেশ তো লোকে বাসে যেতে যেতে এক টুকরো হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পেয়ে যাচ্ছে! তাঁদের নাম মনে রাখছে! এও তো সাংস্কৃতিক স্মৃতি! প্রশ্ন হলো, ঐ কণ্ঠ আসলে কার? হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের? সুচিত্রা মিত্রর? নাকি ঐ সকল কণ্ঠই এক এবং অদ্বিতীয় এক রাজার, যিনি কয়েকটি অসামান্য নাম ও তাঁদের কণ্ঠকে বাজেয়াপ্ত করেছেন? তাঁর মহামহিমায় আমরা “ব্যঙ্গ করে ব্যঙ্গমা আর ব্যঙ্গ করে ব্যঙ্গমী”! আমাদের চারপাশে এই দুই ধরনের মনোনয়নের খেলাধুলা চলছে। কেউ নাম দিয়ে জলের আলপনা করে সংস্কৃতির ধ্বজা ধরছেন; কেউ আবার কয়েকটা নাম দিয়ে আমাদের ‘অন্ধ সাজার অনুরাগ’কে মেপে নিচ্ছেন। আর আমরা ‘গ্যালারিতে বসে গালিলিও’!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন