রবিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৩

০৩ অর্ক চট্টোপাধ্যায়

হুশ
অর্ক চট্টোপাধ্যায়



আমি সকাল সকাল খাবারের খোঁজে বেরিয়েছিলাম। ম্যাগপাইটা তাড়া করলো। আমি অবশ্য তখনও ওর নাম জানতাম না। প্রথমবার যখন মাথার পাশ দিয়ে হুশ করে চলে গেল, খেয়াল করিনি। ভাবলাম কাক আর তাল। কিন্তু না! দ্বিতীয়বারে বুঝলাম কাক বা তাল কোনোটাই নয়! একটা সাদাকালো পাখি সক্কাল সক্কাল তাড়া করেছে। ফাঁকা রাস্তা। গাছ থেকে গাছ আমার মাথার পাশ দিয়ে হুশ আর হুশ! ঘাড়ের কাছে হাত দিয়ে দেখলাম, কোনো খাবার-টাবার আটকে নেই তো? নাহ! আমিই খাবার!

অসহায় চোখে কুকুরটা তাকিয়ে থাকে মেয়েটার দিকে। মেয়েটা অন্ধ, তাই দৃষ্টি ফিরিয়ে দিতে পারে না। এভাবে তাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অন্ধকারে। কুকুরটার অন্ধকার রঙ আর মেয়েটার কোটরের অনেক ভেতরে ঢুকে যাওয়া নিষ্প্রাণ চোখজোড়া। দু-পিদিম অন্ধকার আর একফালি সুতোয় জড়ানো আঠালো একটা দৃষ্টি। মানুষের গায়ে হিম লাগানো অসহায় সেই দৃষ্টি। না দেখার ভেতর তাকিয়ে থাকে। অন্ধকার আরো ঘনিয়ে আসে। কুকুরটার চোখজোড়া নিভন-আলোয় জ্বলতে থাকে। নিভন্ত এক চিতা, অন্ধকারে।

আমার ফ্ল্যাটমেট আর্ট এন্ড ক্রাফটের ক্লাসে যায় আর প্রতি সপ্তাহে একজোড়া নতুন মুখোশ নিয়ে আসে। ঘরের দরজায় লাগায়। তারপর অন্যত্র। টিভির ওপর। দেওয়ালে। কিচেনে। বাথরুমের ওপর। মুখোশে মুখোশে আপার্টমেন্ট ছেয়ে যায়। মুখোশের পেছনে জায়গাটা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে! ক্রমশ দুটো আলাদা আলাদা বাড়ি তৈরি হয়। একটা মুখ-বাড়ি, আরেকটা মুখোশ-বাড়ি।

একটা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে গেলাম। তারপর পাখিটার চোখের দিকে তাকালাম। নিকষ কালো অন্ধকার। চোখ দুটো যেন নেভানো। গোটা পাখিটা সেই নিভে যাবার ভেতরেই বসে আছে! এবার ঘাড়ের কাছে হাত দিতে শার্টের কলার বরাবর কি যেন একটা জিনিস ফিল করলাম। হাত বুলিয়ে যা মনে হলো একটা আংটার মতো। পাখিটা একভাবে দৃষ্টিহীন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর আবার... হুশ!

সবাই কথা বলছে। প্রশ্ন উত্তর বইছে চারপাশে। কুকুরটা একটুও শব্দ করছে না। চুপচাপ গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে আর মুখটা তুলে অন্ধকারে মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। পলকহীন আঁধার, পালকহীন। তাকিয়ে আছে... তাকিয়ে আছে... যতক্ষণ না মেয়েটা দু’হাত বাড়িয়ে আদর করে দিচ্ছে। আস্তে আস্তে তেমনটাই হয়। মেয়েটার হাত দুটো অন্ধকার ঠেলে কুকুরটার অন্ধকার মুখটাকে জড়িয়ে ধরে। কুকুরটার গলার চারপাশে একটা আংটা। হাত বোলাতে গেলে হাত ঠেকে যায়। হাতে লাগে। কেটে গেলে রক্ত দেখা যাবে না এমন অন্ধকারে কুকুরটার দেখতে পাওয়ার ভেতর গুটি গুটি পায়ে মিলিয়ে যায় মেয়েটার না দেখতে পাওয়া। তারপর দুজনে একসাথে... হুশ!

আমার ঘরটা চার নম্বর। আজ দেখলাম ৪ লেখা কার্ডটার ওপর আমার ফ্ল্যাটমেট একটা সাদা মুখোশ লাগিয়ে দিয়েছে। তার ডানদিকটা সোনালি চিকচিক। সেই চকচকিয়ে যাওয়া মুখোশের ভেতর থেকে ৪ সংখ্যাটা উঁকি মারছে। চোখের গর্তের ভেতর থেকে মিটি মিটি। দু’জোড়া চোখ! আর চড়চড় করে বেড়ে চলেছে ভেতরের জায়গাটা! ৪ সংখ্যাটাও ক্রমশ বড় হচ্ছে! আরো বড়... আরো বড়... মুখোশ ছিঁড়ে বাইরে বেরিয়ে আসছে ক্রমশ! তারপর একদিন... হুশ!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন