আজকের বাঙালির মননবিশ্বে বঙ্কিমচন্দ্র
অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী
অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী
যে কোনো যুগের সমাজনীতি ও মূল্যবোধ ইত্যাদি যে সে-যুগের সাহিত্য সমালোচনাকে চালিত করে, তা বলাই বাহুল্য। বিগত সাত আট দশকে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিবর্তন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত অগ্রগমন ও সমাজ-মনস্তত্ত্বে তার সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া এ-যুগের বাঙালি মূল্যবোধে তাই অনিবার্যভাবেই বৈপ্লবিক বদল এনেছে। ফলে আজকের গরিষ্ঠ পাঠক বা সমালোচক ‘বিধবার প্রেম’ বা ‘গণিকার প্রেম’ – এই জাতীয় সমস্যা নিয়ে খুব একটা ভাবিত নয়। কথাটা মনে এলো যে উদযাপনকে উপলক্ষ করে, তা হলো বঙ্কিমচন্দ্রের ১৭৫তম জন্মবার্ষিক স্মরণ।
বিগত শতকের শুরুতে বা তার আগের শতকে সাহিত্য-সমালোচনার নীতিটি কেমন ধারা ছিল, তার নমুনা আমরা পেয়েছি ডঃ সুকুমার সেনের ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’ বইটি থেকে। সেকালের নীতিদুরস্ত সমালোচক যতীন্দ্রমোহন সিংহ বাংলাসাহিত্যের দোষগুণ বিচার প্রসঙ্গে বিধবার প্রেম, কুমারীর প্রেম, সধবার প্রেম, গণিকার প্রেম ইত্যাদি কয়েকটি শ্রেণীনির্দেশ করেছিলেন। তাঁর কিছু সংক্ষিপ্ত মন্তব্য এখানে উদ্ধার করা যেতে পারে ;-
“...১। বিধবার প্রেম। বঙ্কিমচন্দ্র হইতে এই দুর্নীতির সূত্রপাত। পরিণতি রবীন্দ্রনাথে (চোখের বালি), শরৎচন্দ্রে (বড়দিদি, পল্লীসমাজ), হরিদাসে (কর্মের পথে)।
২। সধবার প্রেম (কুমারী অবস্থায় সঞ্জাত)। এই দুর্নীতিরও উৎস বঙ্কিমচন্দ্রে। পরিণতি শরৎচন্দ্রে (দেবদাস, স্বামী)।...”
আজকের বাঙালি পাঠকের মনস্তত্ত্বে ঐ অনিবার্য পরিবর্তনের ফলে তার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুও স্থানচ্যুত হয়েছে অন্যান্য ব্যাপারের মতো বঙ্কিম-সাহিত্যের প্রেক্ষিতেও। তাই ‘বিষবৃক্ষ’ বা ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’-এর নীতি-দুর্নীতি, আখ্যানবিন্যাসের ঔচিত্য ইত্যাদি প্রশ্ন এ-যুগে ততটা মনোযোগ পায়নি। বিগত সাত আট দশকে ভারত তথা বিশ্বের ইতিহাসের প্রধান দিকচিহ্নগুলো, যেমন উপনিবেশবাদ-বিরোধী মুক্তিসংগ্রাম, নানা আর্থ-সামাজিক কারণঘটিত বিভিন্ন গণবিদ্রোহ, নারীপ্রগতি, দেশবিভাগ ও বিভক্ত জাতীয়তা, বাস্তু হারানোর সমস্যা, আঞ্চলিক রাজনীতি, সাম্যবাদ, সমাজতন্ত্র ও আন্তর্জাতিকতাবাদের আদর্শ ইত্যাদিই এ-যুগে বাঙালির বঙ্কিমচর্চার প্রবণতাকে চালিত করেছে। ফলে এ-যুগে সেই প্রবণতার ভারকেন্দ্র সরে এলো বঙ্কিমচন্দ্রের ‘সাম্য’ নামক প্রবন্ধে, কমলাকান্তের নকশাগুলোয় এবং অবশ্যই ‘আনন্দমঠ’, ‘দেবীচৌধুরানী’, ‘সীতারাম’, ‘রাজসিংহ’ প্রভৃতি ইতিহাস-আশ্রিত কাহিনীগুলোয়। নিছক প্রণয়ের নৈতিকতা বা রোমান্টিক সার্থকতা বিচারে আগের যুগের মতো আগ্রহ আর রইলো না। শ্রমজীবী উত্থান ও অর্থনৈতিক বিচারের আলোকে (এবং কিছুটা সাম্প্রদায়িক চিন্তার বিচারেও) তাঁর ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ ও এর মতো রচনাগুলোতে আগ্রহের আলো এসে পড়লো।
অবশ্য ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ নিয়ে আলোচ্য সময়কালে একেবারেই আলোচনা হয়নি, এমন নয়। সার্ধশতবর্ষেও দেখা যাচ্ছে, রোহিণীর পরিণতির ন্যায্যতা নিয়ে আলোচনা করছেন সুমিতা চক্রবর্তী [আনন্দবাজার পত্রিকা], বা জয়দেব বসু আন্দাজ করতে চাইছেন, শরৎচন্দ্র ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ লিখতে বসলে কী করতেন [‘কলকাতা পুরশ্রী’]। তবে স্বীকার করতেই হবে, এ-সব প্রশ্ন আজ আর বাঙালির মনের আকাশ ছেয়ে বিরাজ করছে না। এ-যুগে ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘ইন্দিরা’ বা ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ নিয়ে কয়েকটি রচনা আমাদের চোখে পড়লেও সংখ্যার দিক দিয়ে তাঁর যে উপন্যাসটি এ-কালের আলোচনার সিংহভাগ অধিকার করে রেখেছে, তা অবশ্যই ‘আনন্দমঠ’। এই বইটি প্রসঙ্গে যে-সব প্রশ্ন এইকালে বারবার চর্চিত হতে দেখা যায়, সে-গুলো হলো -- ‘আনন্দমঠ’এ বিবৃত ঘটনার ঐতিহাসিক ভিত্তি বা মূল প্রেরণা কী ছিল, ‘বন্দেমাতরম’ সঙ্গীতের রচনাকাল, এই গান এবং / অথবা এই গ্রন্থ সাম্প্রদায়িকতা, হিংসা বা পৌত্তলিকতা প্রচার করে কিনা, বইটি ইংরেজবিরোধী বা মুসলিমবিরোধী কিনা এবং বঙ্কিম তাঁর মনিব অর্থাৎ ব্রিটিশ সরকারের চাপে এই গ্রন্থে রদবদল করেছিলেন কিনা বা কতটা করেছিলেন এবং সেই সূত্রে গ্রন্থের আদিপাঠ কেমন ছিল ইত্যাদি। বঙ্কিমচন্দ্র ও মুসলিম সমাজ বিষয়ে এ-বঙ্গে উল্লেখযোগ্য লেখক ছিলেন রেজাউল করিম ও সাম্প্রতিক কালে ও-বঙ্গের সারোয়ার জাহান।
বঙ্কিমসাহিত্যের আর যে-সব দিক নিয়ে এই সময়ের বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা আলোচনা করেছেন, তাতেও বৈচিত্র্য প্রচুর। তাঁর সাহিত্যে নারী ও গার্হস্থ্যজীবন, প্রকৃতিবর্ণনা, বিজ্ঞানচেতনা, হাস্যরস, মাতৃভাবনা ইত্যাদি নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বহুবিধ নিবন্ধ চোখে পড়ে। আবার তাঁর ধর্মচিন্তা সংশ্লিষ্ট প্রবন্ধগুলিতে যুগপৎ তাঁর উপন্যাস ও প্রবন্ধসাহিত্যের সূত্র অবলম্বন করে হিন্দুত্ব, তাঁর কৃষ্ণচিন্তা ও হিন্দু পুনরুত্থানবাদের প্রভাব নিয়ে এ-সময়ে একাধিক আলোচনা হয়েছে।
আবার সাহিত্যের মতো বঙ্কিমজীবনও যখন এ-যুগের মনোযোগের বিষয় হয়েছে, তখনও দেখা যায়, সাম্রাজ্যবাদী শাসকের অধীনে কর্মরত বঙ্কিমের চাকরিজীবনের তথ্যাবলিতেই যেন সন্ধানী আলো পড়েছে বেশি। সাদা চামড়ার ওপরওয়ালাদের হাতে বঙ্কিমচন্দ্রের সমাদর পাওয়া না-পাওয়া [না-পাওয়ার কারণ হিসেবে ‘আনন্দমঠ’এর কথাও এসেছে], বিচারক হিসেবে সামাজিক ন্যায়বিধানে বঙ্কিমের ব্যক্তিগত দক্ষতা ও নানা ভূমিকার কথাও আলোচিত হতে দেখা গেছে, যা আমাদের আলোচ্য সময়পর্বের প্রথম থেকেই সম্ভব হয়নি রাজনৈতিক পরবশ্যতার কারণে। বঙ্কিমজীবনের অন্যান্য বহুল আলোচিত বিষয়গুলি হলো বঙ্কিমচন্দ্রের পরিবার, বিশেষ করে তাঁর পিতা, তাঁর কলেজজীবন, রাজনীতিচর্চা, সম্পাদকজীবন, শেষজীবন ইত্যাদি -- সবচেয়ে বেশি আগ্রহ দেখা গেছে তাঁর চাকরিজীবন নিয়ে আলোচনায়। অন্য ধরনের একটি সাম্প্রতিক আলোচনায় রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ চরিত্রটির মডেল হিসেবে বঙ্কিমের সম্ভাব্যতা বিচার করা হয়েছে তাঁর ব্যক্তিজীবনের নানা ঘটনার উল্লেখ সহ [অভ্র বসু, ‘বিশ্বভারতী পত্রিকা’] বঙ্কিমজীবন নিয়ে এই পর্বে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি লিখেছেন গোপালচন্দ্র রায়।
বঙ্কিমের ছাত্রজীবন সম্পর্কে একটি বিতর্কিত জনশ্রুতি হচ্ছে যে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বি.এ. পরীক্ষায় তিনি নাকি প্রথমে বাংলায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি এবং বিদ্যাসাগর নাকি ছিলেন বাংলার পরীক্ষক। পরে গ্রেসমার্কের কল্যাণেই তিনি এ-দেশের অন্যতম প্রথম স্নাতক হবার গৌরব অর্জনে সক্ষম হন। এ-কারণেই তিনি নাকি পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগরের সমালোচনা করে গেছেন, এমন মন্তব্যও কোনো উৎসাহী লেখক করেছেন। এ-নিয়ে দীনেশচন্দ্র সিংহ একটি আলোচনায় [‘দেশ’, ১৯৮৮] বলতে চেয়েছেন যে, বঙ্কিম ঠিক কোন্ বিষয়ের পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন, তার স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় না। ঐ পরীক্ষার বাংলা প্রশ্নপত্র উদ্ধার করে তিনি দেখাতে চেয়েছেন, এত সহজ প্রশ্নপত্রে অকৃতকার্য হওয়া অসামান্য মেধাবী ছাত্র বঙ্কিমের পক্ষে স্বাভাবিক নয়, তিনি সম্ভবত অন্য কোনো বিষয়ে ফেল করেছিলেন।
জীবন ও সাহিত্য মিলিয়ে যে বঙ্কিমচন্দ্র, তাঁর সেই সামগ্রিক ভাবমূর্তি নিয়েও নানা আলোচনা এই বাংলার সারস্বতসমাজে দেখা গেছে, সে-তুলনায় পূর্ববাংলার বিদ্বৎমন্ডলীর বঙ্কিমচর্চার পরিধি যেন কিছুটা সঙ্কুচিত বলে মনে হয়। ও-বাংলার লেখালেখির যতটা হদিশ আমরা পেয়েছি, তার ভিত্তিতে বলা যায়, পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের বাঙালি প্রজন্মের কাছে বঙ্কিম যতটা জীবিত বা অনুপেক্ষণীয় ভাবে চর্চিত, বাংলাদেশের বাঙালিদের কাছে ততটা নন। স্বাধীন বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, এমন কী মাইকেলের তুলনায়ও বঙ্কিমকে নিয়ে আগ্রহ ও চর্চা নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর, এ-কথা স্বীকার করেছেন সে-দেশের অধ্যাপক ওয়াকিল আহমেদ। তাঁর মতে, এই অনাগ্রহের কারণ বঙ্কিমকে হিন্দুগৌরব ও মুসলিম-কলঙ্ক প্রচারক বলে অভিযুক্ত করা, যার “দায়ভাগ কলকাতারই”। অপর পক্ষে ভারতের বাঙালি বঙ্কিমকে দেখেছেন আরও বিশাল প্রেক্ষাপটে, তাঁর সম্পর্কে অনায়াসে যুক্ত করেছেন ‘যুগপ্রবর্তক’, ‘যুগস্রষ্টা’ ইত্যাদি বিশেষণ, নিজেদের রচনার শিরোলেখে বা গ্রন্থনামে ব্যবহার করেছেন ‘বঙ্কিম-ঐতিহ্য’, ‘বঙ্কিম-মনীষা’, ‘বঙ্কিম সরণি’, ‘বঙ্কিম বিদ্যা’, ‘বঙ্কিম ভাবনালোক’, ‘বঙ্কিম যুগ’ ইত্যাদি শব্দাবলি। তাঁরা বঙ্কিমকে দেখেছেন বঙ্গসংস্কৃতির নেতৃপুরুষ হিসেবে।
বিগত শতকের শুরুতে বা তার আগের শতকে সাহিত্য-সমালোচনার নীতিটি কেমন ধারা ছিল, তার নমুনা আমরা পেয়েছি ডঃ সুকুমার সেনের ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’ বইটি থেকে। সেকালের নীতিদুরস্ত সমালোচক যতীন্দ্রমোহন সিংহ বাংলাসাহিত্যের দোষগুণ বিচার প্রসঙ্গে বিধবার প্রেম, কুমারীর প্রেম, সধবার প্রেম, গণিকার প্রেম ইত্যাদি কয়েকটি শ্রেণীনির্দেশ করেছিলেন। তাঁর কিছু সংক্ষিপ্ত মন্তব্য এখানে উদ্ধার করা যেতে পারে ;-
“...১। বিধবার প্রেম। বঙ্কিমচন্দ্র হইতে এই দুর্নীতির সূত্রপাত। পরিণতি রবীন্দ্রনাথে (চোখের বালি), শরৎচন্দ্রে (বড়দিদি, পল্লীসমাজ), হরিদাসে (কর্মের পথে)।
২। সধবার প্রেম (কুমারী অবস্থায় সঞ্জাত)। এই দুর্নীতিরও উৎস বঙ্কিমচন্দ্রে। পরিণতি শরৎচন্দ্রে (দেবদাস, স্বামী)।...”
আজকের বাঙালি পাঠকের মনস্তত্ত্বে ঐ অনিবার্য পরিবর্তনের ফলে তার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুও স্থানচ্যুত হয়েছে অন্যান্য ব্যাপারের মতো বঙ্কিম-সাহিত্যের প্রেক্ষিতেও। তাই ‘বিষবৃক্ষ’ বা ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’-এর নীতি-দুর্নীতি, আখ্যানবিন্যাসের ঔচিত্য ইত্যাদি প্রশ্ন এ-যুগে ততটা মনোযোগ পায়নি। বিগত সাত আট দশকে ভারত তথা বিশ্বের ইতিহাসের প্রধান দিকচিহ্নগুলো, যেমন উপনিবেশবাদ-বিরোধী মুক্তিসংগ্রাম, নানা আর্থ-সামাজিক কারণঘটিত বিভিন্ন গণবিদ্রোহ, নারীপ্রগতি, দেশবিভাগ ও বিভক্ত জাতীয়তা, বাস্তু হারানোর সমস্যা, আঞ্চলিক রাজনীতি, সাম্যবাদ, সমাজতন্ত্র ও আন্তর্জাতিকতাবাদের আদর্শ ইত্যাদিই এ-যুগে বাঙালির বঙ্কিমচর্চার প্রবণতাকে চালিত করেছে। ফলে এ-যুগে সেই প্রবণতার ভারকেন্দ্র সরে এলো বঙ্কিমচন্দ্রের ‘সাম্য’ নামক প্রবন্ধে, কমলাকান্তের নকশাগুলোয় এবং অবশ্যই ‘আনন্দমঠ’, ‘দেবীচৌধুরানী’, ‘সীতারাম’, ‘রাজসিংহ’ প্রভৃতি ইতিহাস-আশ্রিত কাহিনীগুলোয়। নিছক প্রণয়ের নৈতিকতা বা রোমান্টিক সার্থকতা বিচারে আগের যুগের মতো আগ্রহ আর রইলো না। শ্রমজীবী উত্থান ও অর্থনৈতিক বিচারের আলোকে (এবং কিছুটা সাম্প্রদায়িক চিন্তার বিচারেও) তাঁর ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ ও এর মতো রচনাগুলোতে আগ্রহের আলো এসে পড়লো।
অবশ্য ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ নিয়ে আলোচ্য সময়কালে একেবারেই আলোচনা হয়নি, এমন নয়। সার্ধশতবর্ষেও দেখা যাচ্ছে, রোহিণীর পরিণতির ন্যায্যতা নিয়ে আলোচনা করছেন সুমিতা চক্রবর্তী [আনন্দবাজার পত্রিকা], বা জয়দেব বসু আন্দাজ করতে চাইছেন, শরৎচন্দ্র ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ লিখতে বসলে কী করতেন [‘কলকাতা পুরশ্রী’]। তবে স্বীকার করতেই হবে, এ-সব প্রশ্ন আজ আর বাঙালির মনের আকাশ ছেয়ে বিরাজ করছে না। এ-যুগে ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘ইন্দিরা’ বা ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ নিয়ে কয়েকটি রচনা আমাদের চোখে পড়লেও সংখ্যার দিক দিয়ে তাঁর যে উপন্যাসটি এ-কালের আলোচনার সিংহভাগ অধিকার করে রেখেছে, তা অবশ্যই ‘আনন্দমঠ’। এই বইটি প্রসঙ্গে যে-সব প্রশ্ন এইকালে বারবার চর্চিত হতে দেখা যায়, সে-গুলো হলো -- ‘আনন্দমঠ’এ বিবৃত ঘটনার ঐতিহাসিক ভিত্তি বা মূল প্রেরণা কী ছিল, ‘বন্দেমাতরম’ সঙ্গীতের রচনাকাল, এই গান এবং / অথবা এই গ্রন্থ সাম্প্রদায়িকতা, হিংসা বা পৌত্তলিকতা প্রচার করে কিনা, বইটি ইংরেজবিরোধী বা মুসলিমবিরোধী কিনা এবং বঙ্কিম তাঁর মনিব অর্থাৎ ব্রিটিশ সরকারের চাপে এই গ্রন্থে রদবদল করেছিলেন কিনা বা কতটা করেছিলেন এবং সেই সূত্রে গ্রন্থের আদিপাঠ কেমন ছিল ইত্যাদি। বঙ্কিমচন্দ্র ও মুসলিম সমাজ বিষয়ে এ-বঙ্গে উল্লেখযোগ্য লেখক ছিলেন রেজাউল করিম ও সাম্প্রতিক কালে ও-বঙ্গের সারোয়ার জাহান।
বঙ্কিমসাহিত্যের আর যে-সব দিক নিয়ে এই সময়ের বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা আলোচনা করেছেন, তাতেও বৈচিত্র্য প্রচুর। তাঁর সাহিত্যে নারী ও গার্হস্থ্যজীবন, প্রকৃতিবর্ণনা, বিজ্ঞানচেতনা, হাস্যরস, মাতৃভাবনা ইত্যাদি নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বহুবিধ নিবন্ধ চোখে পড়ে। আবার তাঁর ধর্মচিন্তা সংশ্লিষ্ট প্রবন্ধগুলিতে যুগপৎ তাঁর উপন্যাস ও প্রবন্ধসাহিত্যের সূত্র অবলম্বন করে হিন্দুত্ব, তাঁর কৃষ্ণচিন্তা ও হিন্দু পুনরুত্থানবাদের প্রভাব নিয়ে এ-সময়ে একাধিক আলোচনা হয়েছে।
আবার সাহিত্যের মতো বঙ্কিমজীবনও যখন এ-যুগের মনোযোগের বিষয় হয়েছে, তখনও দেখা যায়, সাম্রাজ্যবাদী শাসকের অধীনে কর্মরত বঙ্কিমের চাকরিজীবনের তথ্যাবলিতেই যেন সন্ধানী আলো পড়েছে বেশি। সাদা চামড়ার ওপরওয়ালাদের হাতে বঙ্কিমচন্দ্রের সমাদর পাওয়া না-পাওয়া [না-পাওয়ার কারণ হিসেবে ‘আনন্দমঠ’এর কথাও এসেছে], বিচারক হিসেবে সামাজিক ন্যায়বিধানে বঙ্কিমের ব্যক্তিগত দক্ষতা ও নানা ভূমিকার কথাও আলোচিত হতে দেখা গেছে, যা আমাদের আলোচ্য সময়পর্বের প্রথম থেকেই সম্ভব হয়নি রাজনৈতিক পরবশ্যতার কারণে। বঙ্কিমজীবনের অন্যান্য বহুল আলোচিত বিষয়গুলি হলো বঙ্কিমচন্দ্রের পরিবার, বিশেষ করে তাঁর পিতা, তাঁর কলেজজীবন, রাজনীতিচর্চা, সম্পাদকজীবন, শেষজীবন ইত্যাদি -- সবচেয়ে বেশি আগ্রহ দেখা গেছে তাঁর চাকরিজীবন নিয়ে আলোচনায়। অন্য ধরনের একটি সাম্প্রতিক আলোচনায় রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ চরিত্রটির মডেল হিসেবে বঙ্কিমের সম্ভাব্যতা বিচার করা হয়েছে তাঁর ব্যক্তিজীবনের নানা ঘটনার উল্লেখ সহ [অভ্র বসু, ‘বিশ্বভারতী পত্রিকা’] বঙ্কিমজীবন নিয়ে এই পর্বে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি লিখেছেন গোপালচন্দ্র রায়।
বঙ্কিমের ছাত্রজীবন সম্পর্কে একটি বিতর্কিত জনশ্রুতি হচ্ছে যে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বি.এ. পরীক্ষায় তিনি নাকি প্রথমে বাংলায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি এবং বিদ্যাসাগর নাকি ছিলেন বাংলার পরীক্ষক। পরে গ্রেসমার্কের কল্যাণেই তিনি এ-দেশের অন্যতম প্রথম স্নাতক হবার গৌরব অর্জনে সক্ষম হন। এ-কারণেই তিনি নাকি পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগরের সমালোচনা করে গেছেন, এমন মন্তব্যও কোনো উৎসাহী লেখক করেছেন। এ-নিয়ে দীনেশচন্দ্র সিংহ একটি আলোচনায় [‘দেশ’, ১৯৮৮] বলতে চেয়েছেন যে, বঙ্কিম ঠিক কোন্ বিষয়ের পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন, তার স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় না। ঐ পরীক্ষার বাংলা প্রশ্নপত্র উদ্ধার করে তিনি দেখাতে চেয়েছেন, এত সহজ প্রশ্নপত্রে অকৃতকার্য হওয়া অসামান্য মেধাবী ছাত্র বঙ্কিমের পক্ষে স্বাভাবিক নয়, তিনি সম্ভবত অন্য কোনো বিষয়ে ফেল করেছিলেন।
জীবন ও সাহিত্য মিলিয়ে যে বঙ্কিমচন্দ্র, তাঁর সেই সামগ্রিক ভাবমূর্তি নিয়েও নানা আলোচনা এই বাংলার সারস্বতসমাজে দেখা গেছে, সে-তুলনায় পূর্ববাংলার বিদ্বৎমন্ডলীর বঙ্কিমচর্চার পরিধি যেন কিছুটা সঙ্কুচিত বলে মনে হয়। ও-বাংলার লেখালেখির যতটা হদিশ আমরা পেয়েছি, তার ভিত্তিতে বলা যায়, পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের বাঙালি প্রজন্মের কাছে বঙ্কিম যতটা জীবিত বা অনুপেক্ষণীয় ভাবে চর্চিত, বাংলাদেশের বাঙালিদের কাছে ততটা নন। স্বাধীন বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, এমন কী মাইকেলের তুলনায়ও বঙ্কিমকে নিয়ে আগ্রহ ও চর্চা নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর, এ-কথা স্বীকার করেছেন সে-দেশের অধ্যাপক ওয়াকিল আহমেদ। তাঁর মতে, এই অনাগ্রহের কারণ বঙ্কিমকে হিন্দুগৌরব ও মুসলিম-কলঙ্ক প্রচারক বলে অভিযুক্ত করা, যার “দায়ভাগ কলকাতারই”। অপর পক্ষে ভারতের বাঙালি বঙ্কিমকে দেখেছেন আরও বিশাল প্রেক্ষাপটে, তাঁর সম্পর্কে অনায়াসে যুক্ত করেছেন ‘যুগপ্রবর্তক’, ‘যুগস্রষ্টা’ ইত্যাদি বিশেষণ, নিজেদের রচনার শিরোলেখে বা গ্রন্থনামে ব্যবহার করেছেন ‘বঙ্কিম-ঐতিহ্য’, ‘বঙ্কিম-মনীষা’, ‘বঙ্কিম সরণি’, ‘বঙ্কিম বিদ্যা’, ‘বঙ্কিম ভাবনালোক’, ‘বঙ্কিম যুগ’ ইত্যাদি শব্দাবলি। তাঁরা বঙ্কিমকে দেখেছেন বঙ্গসংস্কৃতির নেতৃপুরুষ হিসেবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন