সোমবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৩

০৩ অমিতাভ প্রহরাজ

আনন্দ পেয়েছিল
অমিতাভ প্রহরাজ



(২৮-শে জুলাই/ ২০১৩)



"গুস্তাখি মাফ হো"

"আপনি শুনতে পেলেন গুস্তাখি মাফ হো?"

"হ্যাঁ, পরিষ্কার শুনতে পেলাম, ড্রেসটা একই রকম, গেরুয়া, খুব আলো"

"সামনে? সামনে কী দেখলেন?"

"সেই বিশাল ক্রাউড। সবাই ফরেনার। কিন্তু ওপরে ঝিকমিকি আলোর বল ঘুরছে। আর হ্যাঁ, ক্রাউডের মধ্যে টম ক্রুজ, ব্রুস উইলিস, স্টিভ জোবস আর এ্যাঞ্জেলিনা জোলি দেখলাম।"

"কী দেখলেন? মানে কীরকম ভাবে দেখলেন? শুরু, শেষ টাইপের কিছু?"

"অনেকটা অস্কারের মতো... প্রচুর হাততালির শব্দ মিলিয়ে গেল... এ্যাঙ্কর, দাঁড়ান দাঁড়ান... এ্যাঙ্করটা মনে পড়েছে... লিন্ডসে লোহান... টিপিক্যাল এ্যামেরিকান উচ্চারণে বললো, নাও লেট্‌স ওয়েলকাম সোয়ামী ভিভেকানন্ডা... পিনড্রপ সাইলেন্স, তার মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দ পোডিয়ামে এলেন, গম্ভীর গলায় বললেন, গুস্তাখি মাফ হো... ওফফফ তারপর সেই না থামা হাততালির ঝড়... থামেই না...থামেই না... আর আমি তত টানটান হয়ে উঠছি... এই থামলো বোধহয়, এই থামলো বোধহয়... থামেই না, থামেই না... তারপর ঘেমে নেয়ে ঘুম ভেঙে গেল..."

"হুম... পরের দিন অফিসে কিছু বড় কাজ ছিল?"

"হ্যাঁ... একটা প্রেজেন্টেশান ছিল, মেজর... পুরোটা আমাকেই করতে হতো..."

"হুম... আর আপনার তো স্ট্যামারিং-এর প্রবলেম আছে?"

"হ্যাঁ... সবসময় হয় না... কেউ আমার নাম জিজ্ঞেস করলে আটকে যায়... আর কোনোকিছু দেখে পড়তে গেলে শুরু করার সময় আটকে যায়"

"হুম, খুব সিম্পল... এটা আপনার ফীয়ার অফ ফেলিওর থেকে জেনারেটেড..."

"ফীয়ার অফ ফেলিওর??!!"

"হ্যাঁ, প্রেজেন্টেশানটা হয়ে গেছে আপনার কাছে ধর্ম মহাসভা... নিজের কোড হয়ে গেছে বিবেকানন্দ... আপনার সাবকনশাসে সারাক্ষণ ভয়টা ঘুরছে প্রেজেন্টেশান দিতে গেলে যদি আটকে যায়... আটকে গেলে সরি বলতে হবে, কীভাবে বলবেন... এই চিন্তা থেকে বিবেকানন্দের মুখে 'গুস্তাখি মাফ হো' বসিয়েছেন... আপাত সাকসেস হিসেবে হাততালি শুনেছেন, কিন্তু যেহেতু আলটিমেটলি আপনি ফেলিওর নিয়ে চিন্তিত, ভীত... অতিভীত... তাই হাততালি না থেমে আপনার ভয়টাকে আরো কনডেন্স করেছে যাতে আপনি কনশাস স্টেটে মানে জাগরণে চলে এসে এটার সঙ্গে ডিল করেন... সিম্পল... আর প্রেজেন্টেশানে আপনার বসেরা হয়ে গেছেন স্টীভ জোবস, টম ক্রুজ, ব্রুস উইলিস জাতীয় এ্যাস্পায়ারিং ফিগার, বিকজ ইন ইওর প্রফেশ্যানাল ফিল্ড ইউ এ্যাস্পায়ার টু গ্র্যাব দ্যাট পোস্ট অফ ইওর বস... এ্যাম আই রাইট অর রং?"

"রাইট স্যার, এ্যান্ড মাই ওয়াইফ ইজ দীক্ষিত... মানে আমার স্ত্রী রামকৃষ্ণ মিশনের দীক্ষিত... সেখান থেকে বিবেকানন্দের রেফারেন্সটা ঢুকে এসেছে...

"ব্যাং অন দ্য পয়েন্ট"

"আর লিন্ডসে লোহান..."

"এইচ বি ও... গত সপ্তাহে চল্লিশবার ফ্রিকি ফ্রাইডে দিয়েছিল... সেখানেও লিন্ডসে লোহানের বারবার অপদস্থ হওয়ার ব্যাপার ছিল, সেটা আপনার ফীয়ার অফ ফেলিওরের সাথে জমে ক্ষীর হয়ে গেছে... খাপে খাপ পঞ্চুর বাপ টাইপের... হা হা হা হা..."

"তাহলে স্যার ওষুধ?"

"ওই তো যা চলছে চলবে, ওলানজেপিনটা ২০ থেকে ১০ করে দিন... কোনো সমস্যা নেই তো... দিব্যি সুস্থ লোকের মতো স্বপ্ন দেখছেন। চলুন"





(১৫ ই জানুয়ারি/ ২০১২)



"ডাক্তারবাবু, আমি লিখি, লেখা ছাড়া বাঁচবো না... জানি না কেন এরকম করলাম... মনে হলো... জানি না"

"ঠিক আছে... ঠিক আছে... তা কি কি খেয়েছেন?"

"আমার যা যা ওষুধ ছিল, যত পাতা, সব... কুড়িটার মতো রিভোট্রিল টু, তিরিশটা টেগ্রিট্যাল সি আর ৪০০, কুড়িটা এসজিট্যালো টেন, কুড়িটা প্যালিডো ওডি... আর স্যাভলন, মারকিউরোক্রোম আর হার্পিক..."

"কী আপদ, আবার স্যাভলন, হার্পিক কেন খেতে গেলেন? কতটা?"

"... আমি জানি না ডাক্তারবাবু... কেন... (কান্না)... একটা স্বপ্ন প্রতিদিন রাত্রে আমাকে (কান্না)... আমি জানি না... আমার লেখা... "

"স্বপ্নে পরে আসবো... এখন আপনাকে তো এইসব থেকে সুস্থ করতে হবে... আপনি কে? ওনার ওয়াইফ? সত্যি স্যাভলন, হার্পিক এইসব খেয়েছেন?"

"... (কাঁদতে, কাঁদতে) হ্যাঁ, স্যাভলন এক বোতল, মারকিউরোক্রোমের পুরো শিশিটাই ফাঁকা, হার্পিক একদম নতুন ছিল, ফুল, তার হাফ আছে"

"না স্যার, হাফ বোতলের বেশি হারপিক খেয়েছি... আমি জানি না... (কান্না)... "

"আপনি চুপ করুন, এখন কথা বলবেন না, শুয়ে থাকুন, হ্যাঁ মিসেস রাজ আপনি বলতে থাকুন"

"... আর স্যার এক শিশি ডেটলও ছিল, ভর্তি, ওটাও ফাঁকা... (কাঁদতে, কাঁদতে)... কিছু হবে না তো"

"কিচ্ছু হবে না... ইমিডিয়েটলি এ্যাডমিট করুন, বডি থেকে টক্সিক ম্যাটেরিয়ালগুলো আগে ফ্লাশ করতে হবে... স্টমাক ওয়াশ করতে হবে"





(১৯ শে জানুয়ারি/ ২০১২)



"ডাক্তারবাবু, আমি বাড়ি যাবো কবে? অন্তত একবার দেখা করা যাবে না?"

"বাড়ি যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না, আর দেখা টেখা আপাতত একমাস নয়"

"প্লিজ, ডাক্তারবাবু... এটা তো পুরো জেলখানার মতো... লেখার জন্য খাতা পেনও দেয় না"

"হ্যাঁ... যদি আবার খেয়ে ফেলেন... আপনার তো নানা রকম জিনিস খাওয়ার অভ্যেস আছে..."

"না, ডাক্তারবাবু (কান্না)... ওটা আমি কেন করেছিলাম, জানি না... আমি জানি না(কান্না)... কিন্তু না লিখে আমি থাকতে পারবো না... প্রত্যেক রাত্রে একটা স্বপ্ন... "

"কী স্বপ্ন?"

"একটা বিরাট দাবাখেলা... বিশাল বিশাল রাজা, মন্ত্রী, অট্টালিকার মতো... কালোর দিকে খেলোয়াড় কালো আলখাল্লা পরে আকাশছোঁয়া লম্বা, সাদার দিকে তেমন... আর তারপর মন্ত্রীর গায়ে একটা মশা, আমি মারতে যেতেই সব গড়িয়ে পড়ে আর আমি অনেক উঁচুর থেকে গড়িয়ে পড়ি, পড়তেই থাকি... ঘুম ভেঙে যায়"

"অনেক উঁচুর থেকে পড়া খুব কমন জিনিস... এটা ৮০% মানুষেই দেখে... অবচেতনে থাকা এসকেপিজম থেকে জন্ম নেয়... ছোটখাটো এসকেপিজম... যেমন ধরুন, রোজ আপনাকে রাতে মশা কামড়ায়, কিন্তু আপনি উঠে মশারিটা ভালো করে গুঁজতে চান না... তো অবচেতন দায়িত্ব নিয়ে আপনাকে কনশাসে ফিরিয়ে আনবে, গার্জেনের মতো... আর দাবাখেলা? অনেকবার বার্গম্যান দেখেছেন বা ওই বিখ্যাত সিনটার স্রষ্টার মতো ঐতিহাসিক লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন অবচেতনে... চিন্তা নেই সেরে যাবে"



(২৫ শে জানুয়ারি/ ২০১২)



"এখন কেমন লাগছে? ওই শব্দ টব্দ শোনা, সুইসাইড্যাল ইচ্ছে?"

"কিচ্ছু নেই... আমি এখন একেবারে ঠিক হয়ে গেছি... প্লিজ ছেড়ে দিন... আমি ওকে না দেখে আর থাকতে পারছি না... না লিখেও"

"স্বপ্ন হয় না, এখন ঘুম ঠিক হচ্ছে?"

"স্বপ্ন... স্বপ্ন... (কান্না)... একটা স্বপ্ন দেখি, আর ভয় একটা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা... দেখি একটা ঘোড়া একটা গোরুকে খেয়ে ফেলছে, তারপর ঘোড়াটা আমাকে খেয়ে ফেলছে..."

"ভাস্কর চক্রবর্তী"

"এ্যাঁ!!"

"ভাস্কর চক্রবর্তীর শয়নযানে আছে... ওই বইটা, যে তিনটে বই আপনাকে এ্যালাও করা হয়েছে তার মধ্যে আছে না?? ... ভয় নেই, স্বপ্ন টুকছেন বলে বলছি না (অট্টহাসি)... যদি দেখেও থাকেন, খুব ভালো... এটা ট্রান্সফর্মেশান সিগনিফাই করে... মানে সাবকনশাসলি আপনি ট্রান্সফর্ম হতে চাইছেন প্রবলভাবে... খুব ভালো লক্ষণ... গুড সাইন"



(১০ ই ফেব্রুয়ারি/ ২০১২)



"ডাক্তারবাবু, প্লিজ আমাকে সামনের রোববার রিলিজ করে দিন, আমি ওকে ছেড়ে থাকতে পারছি না... খুব কষ্ট হয়... স্বপ্নে ওকে দেখি খুব, আমরা একসাথে খুব আনন্দে সংসার করছি... খুব লিখছি আমি আর ওকে পড়াচ্ছি..... ঘুমও খুব ভালো হয়... কেন যে বোকার মতো ওইসব করতে গেলাম (কোনো কান্না নয়)..."

"হুম, দেখছি... তবে রোজ স্বপ্ন দেখছেন মানে ঘুমটা ভালো হচ্ছে না... রিভোট্রিলটা ডোজ বাড়িয়ে দিলাম... কাউন্সেলিং-এ যাবেন প্রতিদিন ম্যাডামের কাছে"

"হ্যাঁ, রোজ যাই... প্লিজ এই রোববার রিলিজ করে দিন... প্লিজ"







(২ রা আগস্ট/ ২০১৩)



নিজের এ্যাপার্টমেন্টে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেল বিখ্যাত মনোবিদ ডঃ শ্রীকান্ত তপাদারের মৃতদেহ। হলিউড সাইকো মুভিগুলোর মতো দেওয়ালে রক্ত দিয়ে লেখা "স্টোমাক ওয়াশের বদলা নিল বিবেকানন্দ"







১৪ই ফেব্রুয়ারি/ ২০১৪



ক্যালকাটা মেডিক্যাল সেন্টার, সি এম সি-তে নিউরো-সাইকিয়াট্রিস্ট ডঃ শ্যামল নন্দীর চেম্বার

"ডঃ নন্দী, একটা স্বপ্ন আমাকে সারাদিন কেমন একটা ফিয়ার সাইকোসিসের মধ্যে রাখে"

"বাবাঃ, ফিয়ার সাইকোসিস, আপনি তো দেখছি বেশ সাইকোলজির টার্ম ফার্ম জানেন ইন্দ্রনাথবাবু!! অবশ্য লেখক মানুষ। তা কি স্বপ্ন?"

"আমি দেখি আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্টকে খুন করছি, কারণ তার রক্ত দিয়ে আমি লিখবো... নৃশংসভাবে খুন করছি... প্রচুর রক্ত বেরোচ্ছে কিন্তু ক্লট করে যাচ্ছে... আমি তুলি ডোবাতে পারছি না... হঠাৎ বাথরুমে খুঁজে পাচ্ছি সার দিয়ে সাজানো আলতার শিশি... খুব খুশি হচ্ছি, তাহলে লাল রঙে লিখতে পারবো... কিন্তু আলতার শিশিগুলি একটাও ভাঙতে পারছি না... আছাড় মারছি, তবু ভাঙছে না... ঘেমে নেয়ে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে..."

"করেছেন কী মশাই??!! সাইকিয়াট্রিস্টকে খুন... রক্ত দিয়ে লিখবার তুলি... কম্যুনিস্ট ইন্টেলেকচুয়াল... তারপর রক্তের বদলে আলতা... ডিগ্রেডেশান অফ কম্যুনিজম... মেনে নিতে পারছেন না... ভাঙছে না... গল্প লেখার মতো ইন্টেলেকচুয়াল থিম মশাই... আপনি নবারুণ ভট্টাচার্য পছন্দ করেন? কম্যুনিস্ট অপটিমিস্ট ফ্রম দ্য কোর অব দ্য হার্ট, লেখায় হরর, বিজ্যার"

"হেঁ হেঁ... এ্যাঁ!!! আপনার পেশেন্ট নাকি??"


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন