সোমবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৩

০৭ অর্ক চট্টোপাধ্যায়

রেডরুম
অর্ক চট্টোপাধ্যায়


আমার আপার্টমেন্টে সব মিলিয়ে পাঁচটা ঘর। আমি একটায় থাকি। বাকি চারটে ফাঁকা। বাড়িওয়ালা ওই ঘরগুলো প্রথমে বন্ধ করে রেখেছিলো। আমি যখন আমার ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দা দিয়ে হাঁটতাম, বন্ধ দরজাগুলো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতো। ঘর থেকে বেরোলে উল্টোদিকের দেওয়ালের রঙ টকটকে লাল, দরজাগুলোও লাল। ভেতরের রং লাল কিনা বলা যেতো না তখন। আমার ঘরের দিকের দেওয়াল সাদা; ভেতর বাইরে দু’দিকেই। আমার ঘরের দরজার রঙও সাদা; ভেতর বাইরে দু’দিকেই।

আমার পাশের ঘরের দরজাও বাইরে থেকে সাদা। ভেতর জানা নেই। যা দেখতাম তা হলো : লাল দেওয়াল বরাবর তিনটে লাল দরজার ঘর আর বাকি দুটো, যার মধ্যে একটা আমার, সাদা দেওয়াল বরাবর সাদা দরজার ঘর।

তারপর একদিন সন্ধেবেলা অফিস থেকে ফিরে দেখলাম বাড়িওয়ালা এসে আমার উল্টোদিকের তিনটে লাল ঘর খুলে দিয়ে গেছে। হয়তো হাওয়া খেলানোর জন্য। হয়তো অন্য ভাড়াটে আসবে বলে। ঘরগুলোয় ঢুকে দেখলাম তাদের ভেতরটাও লাল। টকটকে লাল।

REDRUM REDRUM

তারপর যখনি আমার ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দা দিয়ে হাঁটতাম, চাপা নিশ্বাসের শব্দ আসতো। প্রথম প্রথম ভেবেছিলাম নিজের। তারপর মনে হলো, তা কী করে হয়! এ নিশ্চয়ই ঘরগুলোর শ্বাস প্রশ্বাস... ওমা, সেইজন্যই তো তাদের খুলে রেখে গেছে বাড়িওয়ালা... যাতে খানিক দম নিতে পারে। আমার পাশের সাদা দরজার ঘরটা কিন্তু বন্ধই আছে। সেখানে শ্বাসের শব্দও শোনা যায় না। তবে হয়তো ওই ঘরে ভাড়াটে আসছে না আপাতত।

ওদিকের তিনটে ঘরের ভেতর আর বাইরের দেওয়াল আর দরজা দুইই লাল। আমার ঘরের ভেতর আর বাইরের দেওয়াল আর দরজা দুইই সাদা। এর থেকে ধরেই নিলাম আমার পাশের সাদা দরজার ঘরের ভেতরটাও নিশ্চয়ই পুরো সাদা।

তারপর সাদার ওপর লাল উঠলো, লালের পিঠে সাদা। দিনের ওপর রাত উঠলো আর রাতের পিঠে দিন। লালের ওপর সাদা উঠলো আর সাদার পিঠে লাল। দিনের ওপর মাস উঠলো আর মাসের পিঠে বছর।

আমি আমার ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দা দিয়ে হাঁটতাম আর লাল ঘরগুলোয় শ্বাসের শব্দের ওঠানামা শুনতাম। পাশের ঘরের দরজার সামনে চলে এলে চুপ। ঘরের ভেতরের সাদা রঙ দেখতে বড্ড ইচ্ছে করতো। কিন্তু দরজার মাঝামাঝি স্টিলের লক নায়ের গায়ে হেলান দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতো। একেক দিন তো ভেবেছি ভেঙেই ফেলবো দরজাটা! দু’হাতে মেখে নেব সাদা দেওয়ালের নিশ্বাস, কিন্তু তারপর আবার শান্ত হয়ে নিজের ঘরে ফিরে শুয়ে পড়েছি।

তারপর আবার সাদার ওপর লাল উঠেছে, লালের পিঠে সাদা। দিনের ওপর রাত উঠেছে আর রাতের পিঠে দিন। লালের ওপর সাদা উঠেছে আর সাদার পিঠে লাল। দিনের ওপর মাস উঠেছে আর মাসের পিঠে বছর।

এতগুলো বছর হয়ে গেলো, কেউ আসেনি আমার আপার্টমেন্টে। লাল ঘরের দরজাগুলো যে-কে সেই খোলা, শ্বাস-প্রশ্বাস অব্যাহত। তারপর একদিন সন্ধেবেলা একটা ঘটনা ঘটলো। অফিস থেকে ফিরতেই চোখে পড়লো, আমার পাশের ঘরের দরজাটা বাড়িওয়ালা এসে খুলে দিয়ে গেছে। হাট করে খোলা দরজার ভেতর থেকে ঘরের রং ঠিকরে বেরোচ্ছে। ঘরের ভেতরটা লাল। টকটকে লাল। কিন্তু না, কান পাতলেও কোনো নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে না। আমি এখন ওই ঘরেই থাকি। ওই ঘরেই লিখি

MURDER MURDER...






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন