সোমবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৩

১০ লিপিকা ঘোষ

ব্রোচ
লিপিকা ঘোষ


জিনিসটা ও কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছে না। এ-ঘর ও-ঘর ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার কোত্থাও তো নেই! কিছুক্ষণ আগেই কোথায় যে রাখলো, মনে করার খুব চেষ্টা করছে রাই। রাই মিত্র; কলেজে, ইউনিভার্সিটিতে ওর নাম নিয়ে খুব জ্বালাতন করতো সকলে। রক্তিম লাস্ট বেঞ্চে বসে ওর ডাইরির পাতায় ছবি আঁকত আর কবিতা লিখে দিত। সকালে অফিস যাওয়ার সময় ওর পায়ের তোড়ায় শাড়ির পাড় বেঁধে যায়। ঝুঁকে ছাড়িয়ে নেওয়ার সময় ওর কাঁধ থেকে জিনিসটা মাটিতে পড়ে ছিটকে গেল। বেশ খোঁজাখুঁজির পর আলমারির নিচ থেকে বেরোল জিনিসটা। তারপর তারপর যে কোথায় রাখল রাই... জলের বোতল, টিফিনবাক্স ব্যাগে ঢুকিয়ে ঝটপট দরজায় তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়ল। বেরোনোর আগে এক ঝলক ড্রেসিং টেবিলে মুখটা দেখে নেয়। হ্যাঁ, এই তো সারাদিনের জন্য প্রস্তুত একটা হাসিমুখ। অফিসে সর্বদা ভ্রূ কোঁচকানো বিগ বস সেদিন বলেই ফেললেন, ‘এই মেয়েটা সব সময় স্মাইলি ফেস কী করে যে বজায় রাখে! কিপ ইট আপ রাই’! কিন্তু আজ সারাদিন রাইয়ের কাজে মন নেই। কাঁধের কাছে বারবার হাত দিয়ে দেখছে -– জিনিসটা নেই। ‘ব্রোচ’, একটা সোনালি রঙের ব্রোচ। সোনার নয়। রূপোর ওপর সোনার জল করা। নকশা’র কারুকাজ যেন একটা প্রজাপতি পাখনা মুড়ে ওর কাঁধে বসে আছে, এই উড়ল এই উড়বে বলে। কে যেন গিফট করেছিল, তার মুখ আবছা মনে পড়ে। খুব সুন্দর ছোট্ট একটা বাক্সে। মানুষটা’র মুখ আবছা। প্রায় বছর আটেক হয়ে গেল, রাই সেই শহর ছেড়ে চলে এসেছে। পদ্মাপাড়ের দূর গ্রামে চাকরি এখন। পঞ্চায়েত ভোট শেষ। পদ্মার পানিতে এখন লোহুর মিশেল। পদ্মার পানিতে এখন আগুন লেগেছে। এ আগুন ধিকি ধিকি জ্বলবে টানা পাঁচ বছর। পুরনো অনেক মুখ আর রাইএর সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে না। দাঁড়াবে না আর কখনও। আপাতত অফিসে কাজের চাপ কম। সকলেই ভোট পর্যালোচনা নিয়ে ব্যস্ত। রাইয়ের সেদিকে মন নেই। অফিস থেকে বেরিয়ে কিছুদূর হেঁটে পদ্মাপাড়ে এসে দাঁড়ালো রাই। হু হু করে বাতাস বইছে। বর্ষার বাতাসে যেন বৃষ্টির ছাঁট। বৃষ্টি রঙের আঁচল উড়ছে, রাই আনমনা। কাঁধের কাছটা ফাঁকা। ব্রোচটা নেই। ‘ ইখেনে হুতাস দাঁইড়ে থাইকবেন না নতুন ম্যাডাম, এখুন সময় ভালো লয়, কিই আর বুইলব, জানেনই তো সব’। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল রাই। একটা নতুন চেনা মুখ। ছেলেটা ভোটে জিতেছে। রাই মেইন রোডে এসে দাঁড়ালো। এখুনি ট্রেকার এসে পড়বে। ঝমঝম করে বৃষ্টির তোড়, ভিজিয়ে দিচ্ছে রাইএর কাঁধ ঘাড় পিঠ... ব্রোচটা নেই। ডানা মুড়ে বসে থাকা প্রজাপতি ব্রোচটা কোথায় যে হারিয়ে ফেলেছে সে... না না হারায় নি, ঠিক খুঁজে পাবে, ঠিক উড়ে এসে বসবে ওর কাঁধে। এখন তো ভরা বর্ষা, ‘কান্ত প্রবাসে’। রবি ঠাকুর সুর করার সময় শব্দ বদলে ‘বিরহ দারুণ’ করে নিয়েছিলেন। কড় কড় করে বাজ পড়ল। চিরকাল বিদ্যুৎ চমকালেই রাইএর সাংঘাতিক ভয় করে। আজ ভয় করল না তো! শুধু মনে হলো, বাড়ি ফিরেই বান্ধবী বিডস মানে বিদিশাকে একটা ফোন করা খুব জরুরি...


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন