বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০১৩

১০ অলোকপর্ণা

বুদবুদ অলোকপর্ণা




শহর থেকে শুন্ডিয়া ‘অনেক দূর’ বলতে সত্যি ঠাকুমার ঝুলির গল্পের মতো বাস রাস্তার পর সুরকি-পথ, সুরকি পথের পর শুষ্ক নদী, নদীর পর পায়ে হেঁটে টানা দুই ঘন্টা পর পুল পার হয়ে আসা বোঝায়। তাই শুন্ডিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এসে অরুণেশ ব্যানার্জী একপ্রকার মোক্ষ লাভ করলেন। বিদ্যালয়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির জন্য শুন্ডিয়া কেঠো বেঞ্চের থেকে উপযুক্ত কিছু খুঁজে পায়নি। সেই বেঞ্চে বসে অরুণেশ উজ্জ্বল রোদে চোখ কুঁচকে দেখলেন মেঠো মানুষজন অকারণ শ্রদ্ধাসহ তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি রুমালে মুখ ও কপালের ঘাম মুছে যারপরনাস্তি সহজ বাংলায় বিদ্যালয়ের উপযোগিতা সম্পর্কে বাণী আওড়ালেন। 


আরও কিছু আনুষ্ঠানিকতার পর সভা শেষ হলেও মেঠো কালো মানুষের ভীড়, উৎসাহ ও ফিসফাস না কমায় তিনি ড্রাইভার শ্যামলকান্তিকে ডাকলেন, “ওদের এক এক করে আমার কাছে আসতে বল, কার কি বলার আছে শুনব।”


এরপর তারা এসে অবাক চোখে অরুণেশের সামনে মাটিতে বসেছে, কেউ কেউ কথাই বলে উঠতে পারেনি, কেউ আবেগের তোড়ে এত কথা বলেছে যে অরুণেশ তার মর্মোদ্ধার করতে করতেই শ্যামলকান্তি পরের জনকে ডেকে এনেছে। এমনকি এক বৃদ্ধার অরুণেশকে ছুঁয়ে দেখার আবদারও মেটাতে হলো। অরুণেশ দেখতে পেলেন শুন্ডিয়াকে, দেখলেন তাদের প্রত্যেকের নখের মাটি, মাথার উকুন ও জট, দাঁতের ছ্যাদলা। শ্যামলকান্তি এর ফাঁকেই বলে গেল, “স্যর, ওরা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি সরকার থেকে কেউ শুন্ডিয়ার আসবে।”


ফিরে আসার আগে অরুণেশ ব্যানার্জী ঈশ্বরের ভঙ্গিমায় উঠে শান্ত স্বরে বললেন, “শুন্ডিয়ায় এসে আমার খুবই ভালো লাগছে।” জমায়েত মুহূর্তে উদ্বেল হলো। তারা শান্ত হতে তিনি বললেন, “আপনাদের অনেক অভাবই মেটাতে পারিনি আমরা। গ্রামের স্বাস্থ্য ফেরাতে কিছু কাজ করা হবে। সরকার সামনের মাসে আপনাদের জন্য সাবান পাঠাবে। কাপড় কাচার, স্নান করার, হাত পা মুখ ধোওয়ার। আপনারা ব্যবহার করবেন তো?”


জমায়েত সমস্বরে হ্যাঁ বলে উঠলে নিশ্চিন্ত মনে অরুণেশ ব্যানার্জী পুলের পর মেঠো পথ, তারপর শুষ্ক নদী, নদীর পর শামলকান্তি চালিত রাজকীয় অ্যাম্বাসাডারে বেপরোয়া ধুলো উড়িয়ে শহরে ফিরে এলেন।


মাস ছয় পর রাজার খেয়ালে অরুণেশ যখন সাত সাগর তেরো নদী পার করে শুন্ডিয়ার মাটিতে পা রাখলেন, তখন যেন হাতে স্বর্গ পেলো মেঠো মানুষেরা। মাস দুই আগে লরি ভরে সাবান আসায় তারা অসীম কৃতজ্ঞ। অরুণেশ কালো মানুষগুলোর আনন্দ দেখলেন, দেখলেন তাদের প্রত্যেকের নখের মাটি, মাথার উকুন ও জট, দাঁতের ছ্যাদলা, -- অবাক হলেন। চিন্তিত মুখে জানতে চাইলেন, “তোমরা সাবান ব্যবহার করছ না?”


বাচ্চারা জানালো, তারা সাবান দিয়ে অতি সহজেই ‘সেলেটে’ লিখতে পারছে; মহিলারা বলল, ঘরের তাকে সাবান রাখলে পাশের গ্রাম থেকে মেয়ে দেখতে এসে পাত্রপক্ষ মুগ্ধ হয়; পুরুষেরা কিছু না বললেও শ্যামলকান্তি জানিয়ে গেল যে, তাদের পরস্পরের প্রতি যার যত ধার দেনা, তারা সাবানের বিনিময়ে মিটিয়ে বড়ই সন্তুষ্ট হয়েছে। অরুণেশ হতবাক। তিনি জল ও সাবান আনার আদেশ দিলেন। সাবান ও এক জীর্ণ বোতল ভরা কিছুটা জল যোগাড় হলে ভীড়ের মাঝে বসে অরুণেশ নিজের অভিজাত হাতেই সাবান ও জল মিশিয়ে তার ব্যবহার দেখাতে লাগলেন।


ফেনা ও বুদবুদের ম্যাজিকে ভীড়ের ফিসফাস স্তিমিত হলে অরুণেশ শুন্ডিয়ার দিকে তাকালেন। তাঁকে ছুঁতে চাওয়া সেই বৃদ্ধা ভীড় থেকে এগিয়ে এসে দাঁতশূন্য হাসিতে মুখ ভরিয়ে বললেন, “লাট, সবই তো বুজতাছি, কিন্তু বল্‌ দেহি, -- সমগ্‌গ শুন্ডিয়ায় জল কোথা পাই!”


অরুণেশ ব্যানার্জী শ্যামলকান্তির দিকে তাকিয়ে বুঝলেন, সেও এক মহাশূন্যে পড়ে গিয়েছে তাঁরই মতো। কিছু পরে শ্যামলকান্তির সাথে নিশ্চুপ পুল পার করে মেঠো পথ হেঁটে শুষ্ক নদীর চরে এসে থামলেন অরুণেশ। শেষবারের মতো শুন্ডিয়ার দিকে ফিরে তিনি দেখলেন, সাবানের বুদবুদ ভরা প্রহসন ধেয়ে আসছে লালচে মাটি বেয়ে, তাঁর মাথার ওপর এসে সেগুলো ফেটে গিয়ে অট্টহাসি হয়ে ঝরে পড়ছে।

অরুণেশ ব্যানার্জী শ্যামলকান্তিকে আরো জোরে পা চালাতে বললেন।

 



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন