অনলাইনে কবিতা চর্চার ব্যাপারে
অনুপম মুখোপাধ্যায়
অনলাইনে কবিতা চর্চার ব্যাপারে আমি নিজেই এখন সন্দিহান। কয়েকটি মাত্র স্থান আছে, যেখানে নিজের কবিতা দিতে ইচ্ছে করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দিতে ইচ্ছে করে না। সোশ্যাল নেটওয়র্কগুলিতে বাংলা কবিতাকে তরল থেকে অতিতরল করে তোলা হচ্ছে। মুড়ি এবং মিছরির ভেদ থাকছে না। আন্তর্জালে বাংলা কবিতাকে নিয়ে আমার অনেক আশা আছে, স্বপ্ন আছে। সেগুলো সহজে মরবার নয়। আবার কিছু হতাশাও পাকাপাকি হয়ে আছে। আন্তর্জাল একজন তরুণ কবির কাছে আশীর্বাদ হয়ে উঠতে পারে, যদি তিনি সত্যি নিজের প্রতিভার দর্পণ হিসেবে তাকে ব্যবহার করেন, হাততালি কুড়োবার বাসনা তাঁর না থাকে। ফেসবুক এই কারণেই একটি ধারালো অস্ত্রের চেয়ে বিপজ্জনক। যে কোনো সোশ্যাল নেটওয়র্কই তাই। খুব সহজেই আপনি হাজার খানেক ‘বন্ধু’ সংগ্রহ করে ফেলতে পারেন। আপনি যদি মেয়ে হন, ব্যাপারটা আরো সহজ। এবার যদি দিনের মধ্যে বেশ কিছুটা সময় সাইটটিতে দেন, অনেকের মনোযোগ আকর্ষণ করবেন। অনেকের কবিতায় একনিষ্ঠভাবে লাইক দিলে বা ‘অসাধারণ’ ‘অসামান্য’ ইত্যাদি বললে, বিনিময়ে নিজে কবিতা পোস্ট করলেই ১০০-১৫০ লাইক পেয়ে যাবেন। তখন কি আপনি লক্ষ্য করবেন যে, ২০০০ বন্ধুর মধ্যে মাত্র ১০০ জন কবিতাটি ছুঁয়েছেন, তা-ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে নয়? হয়তো সেটা ভাবতে ভালো লাগবে না। বরং এতে আপনার অহং এমন একটা স্তরে যেতে পারে, যা মঞ্চের সাফল্যও আপনাকে দেবে না। কবি হিসেবে অংকুরোদ্গমের আগেই মৃত্যু ঘটবে।
সোশ্যাল নেটওয়র্কে জনপ্রিয় হয়ে উঠে একটা সময় হয়তো সমসাময়িক কবিতার দিকে না তাকিয়েই আপনি অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বেন। নিজের কবিতা নিজেই প্রকাশ করে, নিজের পাঠক সংগ্রহ করার সুযোগ আন্তর্জাল দেবে, কিন্তু তার আগে নিজেকে প্রস্তুত করা দরকার। সেই প্রস্তুতি আন্তর্জালের বাইরে হওয়াই ভালো। গলির ক্রিকেটকে টেস্ট ক্রিকেট ভাবার ভুল না হলে, ঘটে যাবে। হ্যাঁ পাঠক, ফেসবুকের কবিতা পোস্টিংকে আমি ওই চোখেই দেখি... গলির ক্রিকেট। যেখানে সম্পাদক নামক পেশাদার আম্পায়ারটি নেই। আপনি আউট হলেন কিনা, ছয় মারলেন না চার মারলেন না কট হয়ে গেলেন... আপনি নিজেই বিচার করবেন, কারো মতামত অপছন্দ হলে তাকে বন্ধুতালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেবেন। আন্তর্জাল একজন তরুণ কবির কাছে অভিশাপ হয়ে উঠতে পারে, যদি তিনি সম্পাদকের ভূমিকাকে মেনে না নেন। পেশাদার সম্পাদক মানে যে বেতনভূক সম্পাদক নন, বলা বাহুল্য। তবে... ২৪ x ৭ কবিতাকর্মী তাঁকে হতে হবে।
এই মুহূর্তে ব্লগ এক অনিবার্য ব্যাপার একজন তরুণ কবিরা কাছে। যদি তিনি কাউকে খুশি না করে নিজের একটি জগত গড়ে তুলতে চান, ব্লগ তাঁর একমাত্র অপশন মনে হয়। নিজের ব্লগে তিনি নিজের সৃষ্টিসুখের উন্মাদনাকে যেমন খুশি উপস্থিত করতে পারেন। সেই ব্লগে তারপর তিনি আমন্ত্রণ জানাতে পারেন পাঠকদের। তাঁকে নিজের কবিতা নিয়ে প্রকাশক বা সম্পাদকদের দরজায় দরজায় আর ঘুরে বেড়াতে হবে না। নিজের কবিতার দায়িত্ব এখন তিনি নিজে নিতে সক্ষম। দুই বাংলা মিলিয়ে বেশ কিছু তরুণ কবি আজ এই পথে হাঁটছেন। আজ তাঁরা খাদক নন, উৎপাদকের ভূমিকায়। অবশ্য জবাগাছের পাশাপাশি বিছুটিও এক উৎপাদক, কারণ সেও ক্লোরোফিলের অধিকারী।
আলাদা করে প্রতিষ্ঠানবিরোধীতার কথাও আজ আর বলার দরকার নেই। প্রতিষ্ঠানবিরোধীতা বলে কিছু হয় কিনা, সেই প্রশ্নে না গিয়েই বলি, নিজের কবিতা প্রকাশের ভার নিজে পেলে সেই কবি স্বয়ং এক প্রতিষ্ঠানের নাম হয়ে ওঠার সুযোগ পান।
তবে এখানেও আসে স্ব-সম্পাদনার প্রশ্ন। ঠিক সোশ্যাল নেটওয়র্কের মতোই ব্লগেও আগে নিজের কবিতার জায়গাটা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নেওয়া ভালো মনে হয়। কবিতা লিখতেই পারেন, কিন্তু সেই কবিতা প্রকাশের সময়ে একটা অধিকারের প্রশ্ন হয়তো আসে। লোককে নিজের কবিতা পড়ানোর অধিকার কি আপনি অর্জন করেছেন? সেটা যাচাই করছেন কী করে? এখানেই কবিতার আন্তর্জাল পত্রিকাগুলি অনিবার্য। সেখানে আপনার যোগ্যতার একরকম বিচার হয়। সেই বিচারকে গ্রহণ অথবা প্রত্যাখ্যানের দ্বারা আপনি নিজের কবিতা সম্পর্কে একটা অবস্থানে আসতে পারেন। একটি আন্তর্জাল পত্রিকাকে কবিতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটু শক্ত হাত রাখতেই হয়। না হলে সে ব্যক্তিগত ব্লগ অথবা ফেসবুকের আরেক সংস্করণ হয়ে যাবে। বা মুক্তমঞ্চের মতো কোনো ফোরাম। পত্রিকার গুণ তার থাকবে না।
আবার ইদানীং এমন ব্লগজিনের আবির্ভাবও হচ্ছে, যার সম্পাদক নিজের কেরিয়ার গড়ে তুলতে সেটির জন্ম দিয়েছেন। অন্য ব্লগকে অনুসরণ এবং অনুকরণ তার মূলমন্ত্র, আলাদা কোনো দর্শন নেই। কেন সেই পত্রিকার উদ্ভব ঘটানো হলো, তিনি স্বয়ং বলতে পারবেন না, হয়তো বলবেন বাংলা কবিতার স্বার্থে তিনি এর জন্ম দিয়েছেন। দেখা যাবে সেখানে অন্যের কবিতা ছাপার অন্যতম শর্ত সেই সম্পাদকের কবিতা অন্য পত্রিকায় ছাপা হওয়ার সুযোগ তৈরি করা। এবং ইদানীং সত্যিই অনেকে তাঁর কবিতা ছাপতেও শুরু করেছেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ডাক পাচ্ছেন। বিনিময়ে উদ্যোক্তার কবিতা ছাপছেন। ফেউয়ের বদলে তিনি বাঘ হয়ে উঠছেন, এবং তার কারণ নিতান্তই তাঁর কবিতা নয়। যোগাযোগের এবং বিনিময়ের এই অভিশাপ ছাপা পত্রিকার ভুবন থেকে আন্তর্জালে প্রবেশ করেছে।
আবার কিছু অনলাইন পত্রিকা প্রথম থেকেই কবিতার নির্বাচনে নির্মম হতে চেয়েছে। একটি কবিতা নির্বাচিত হলে তিনটি কবিতা হয়তো বাতিল হয়েছে। একটি ওয়েবজিন বা ব্লগজিন সেটা করতে পারে। ফেসবুকে যে গ্রুপম্যাগগুলি আছে, তারাও পারে। কোনো ফোরামে বা ফেসবুকের ওপেন গ্রুপে সেই সুযোগ নেই। আবার একটি ফোরাম বা গ্রুপ জনারণ্যে আপনাকে নিজেকে যাচাই করার অন্য সুযোগ দেবে। রাস্তায় পড়ে থাকা হীরের টুকরোকে লোকে চিনে নেবেই, এই আশা আপনাকে দেবে। সেটা খুব সহজ পরিসর নয়।
শুধু আত্মপ্রকাশ নয়। আন্তর্জালের সুবাদে অনেক সীমাবদ্ধতা, অনেক অভিশাপ দূর হবে। টাকার অভাবে অনেকে বই করতে পারেন না। আবার নিজের টাকায় (তা-ও প্রয়োজনের দ্বিগুণ মূল্যে... আপনার বই প্রকাশক বিক্রির জন্য মোটেই করছেন না) বই করে, নিজের টাকায় সেই বই নিজের বাড়িতে ট্রান্সপোর্টে আনিয়ে, খাটের তলায় রাখতে হয়। সেই বই তারপর নিজের টাকাতেই লোককে পাঠাতেও হয়, নিজেই ফোন করে জিজ্ঞেস করতে হয় তা কেমন লাগল। সেইসব দিন থেকে কবিরা মুক্তি পেতে পারেন আজ। ‘প্রিন্ট অন ডিমান্ড’ পদ্ধতি এসে গেছে। আপনি নিজের পান্ডুলিপি নিজে কম্পোজ করে একটি নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটকে দিতে পারেন। তারা সেই বই আন্তর্জালে প্রকাশ করবে। কোনো পাঠক যদি বই হিসেবে পেতে চান, তারা অর্ডার পেলে মূল্যের বিনিময়ে পাঠিয়ে দেবে। আপনিও নিজের বই নিজে কিনে কাউকে দিতে পারেন উপহার হিসেবে বা আলোচনার জন্য। এই পদ্ধতি সর্বাঙ্গসুন্দর হয়তো নয়, তবে অসাধু প্রকাশকের লোলুপতা থেকে ভবিষ্যতের কবির মুক্তির পথ অবশ্যই।
তবে যে কবি স্বয়ং প্রকাশকের কাছে টাকা নিয়ে বই দেন, এই পন্থা তাঁর জন্য নয়। কিন্তু সেই কবির সংখ্যা কত? এবং বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ কি আদৌ তাঁদের মুখের দিকে চেয়ে আছে? বাণিজ্যিক কবিতা... সাধারণ মানুষের কবিতাবিমুখতা দেখে এই ধারণাটাকে সোনার পাথরবাটি ছাড়া কিছু মনে হয় না। অথচ এই ধারণাকে আঁকড়ে থেকেই সামগ্রিকভাবে বাংলা কবিতা হাস্যকর এবং অবান্তর হয়ে পড়ে। আবার এও একটা প্রশ্ন : বাংলা ভাষায় এই মুহূর্তে ২৫ জন মানুষেরও কি কবিতা পড়ার ক্ষমতা, এবং তা নিয়ে কথা বলার যোগ্যতা আছে?
একটা কথা স্পষ্ট করেই বলি? আন্তর্জাল যে বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ, এ নিয়ে খুব সন্দেহের সুযোগ আজ আর বোধহয় নেই। তালপাতার যুগ থেকে যেমন ছাপাখানা, লেটার প্রেস থেকে যেমন ডিটিপি, তেমন ভাবেই এসেছে আন্তর্জাল। এ অনিবার্য বিবর্তন বলেই আমি মনে করি। একে অস্বীকার করলে জীবনের এবং প্রাণের বিকাশের ধর্মকেই খারিজ করা হয়। একজন নগণ্য কবিতালেখক হিসেবেই এটা আমার ধারণা।
অনলাইনে কবিতা চর্চার ব্যাপারে আমি নিজেই এখন সন্দিহান। কয়েকটি মাত্র স্থান আছে, যেখানে নিজের কবিতা দিতে ইচ্ছে করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দিতে ইচ্ছে করে না। সোশ্যাল নেটওয়র্কগুলিতে বাংলা কবিতাকে তরল থেকে অতিতরল করে তোলা হচ্ছে। মুড়ি এবং মিছরির ভেদ থাকছে না। আন্তর্জালে বাংলা কবিতাকে নিয়ে আমার অনেক আশা আছে, স্বপ্ন আছে। সেগুলো সহজে মরবার নয়। আবার কিছু হতাশাও পাকাপাকি হয়ে আছে। আন্তর্জাল একজন তরুণ কবির কাছে আশীর্বাদ হয়ে উঠতে পারে, যদি তিনি সত্যি নিজের প্রতিভার দর্পণ হিসেবে তাকে ব্যবহার করেন, হাততালি কুড়োবার বাসনা তাঁর না থাকে। ফেসবুক এই কারণেই একটি ধারালো অস্ত্রের চেয়ে বিপজ্জনক। যে কোনো সোশ্যাল নেটওয়র্কই তাই। খুব সহজেই আপনি হাজার খানেক ‘বন্ধু’ সংগ্রহ করে ফেলতে পারেন। আপনি যদি মেয়ে হন, ব্যাপারটা আরো সহজ। এবার যদি দিনের মধ্যে বেশ কিছুটা সময় সাইটটিতে দেন, অনেকের মনোযোগ আকর্ষণ করবেন। অনেকের কবিতায় একনিষ্ঠভাবে লাইক দিলে বা ‘অসাধারণ’ ‘অসামান্য’ ইত্যাদি বললে, বিনিময়ে নিজে কবিতা পোস্ট করলেই ১০০-১৫০ লাইক পেয়ে যাবেন। তখন কি আপনি লক্ষ্য করবেন যে, ২০০০ বন্ধুর মধ্যে মাত্র ১০০ জন কবিতাটি ছুঁয়েছেন, তা-ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে নয়? হয়তো সেটা ভাবতে ভালো লাগবে না। বরং এতে আপনার অহং এমন একটা স্তরে যেতে পারে, যা মঞ্চের সাফল্যও আপনাকে দেবে না। কবি হিসেবে অংকুরোদ্গমের আগেই মৃত্যু ঘটবে।
সোশ্যাল নেটওয়র্কে জনপ্রিয় হয়ে উঠে একটা সময় হয়তো সমসাময়িক কবিতার দিকে না তাকিয়েই আপনি অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বেন। নিজের কবিতা নিজেই প্রকাশ করে, নিজের পাঠক সংগ্রহ করার সুযোগ আন্তর্জাল দেবে, কিন্তু তার আগে নিজেকে প্রস্তুত করা দরকার। সেই প্রস্তুতি আন্তর্জালের বাইরে হওয়াই ভালো। গলির ক্রিকেটকে টেস্ট ক্রিকেট ভাবার ভুল না হলে, ঘটে যাবে। হ্যাঁ পাঠক, ফেসবুকের কবিতা পোস্টিংকে আমি ওই চোখেই দেখি... গলির ক্রিকেট। যেখানে সম্পাদক নামক পেশাদার আম্পায়ারটি নেই। আপনি আউট হলেন কিনা, ছয় মারলেন না চার মারলেন না কট হয়ে গেলেন... আপনি নিজেই বিচার করবেন, কারো মতামত অপছন্দ হলে তাকে বন্ধুতালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেবেন। আন্তর্জাল একজন তরুণ কবির কাছে অভিশাপ হয়ে উঠতে পারে, যদি তিনি সম্পাদকের ভূমিকাকে মেনে না নেন। পেশাদার সম্পাদক মানে যে বেতনভূক সম্পাদক নন, বলা বাহুল্য। তবে... ২৪ x ৭ কবিতাকর্মী তাঁকে হতে হবে।
এই মুহূর্তে ব্লগ এক অনিবার্য ব্যাপার একজন তরুণ কবিরা কাছে। যদি তিনি কাউকে খুশি না করে নিজের একটি জগত গড়ে তুলতে চান, ব্লগ তাঁর একমাত্র অপশন মনে হয়। নিজের ব্লগে তিনি নিজের সৃষ্টিসুখের উন্মাদনাকে যেমন খুশি উপস্থিত করতে পারেন। সেই ব্লগে তারপর তিনি আমন্ত্রণ জানাতে পারেন পাঠকদের। তাঁকে নিজের কবিতা নিয়ে প্রকাশক বা সম্পাদকদের দরজায় দরজায় আর ঘুরে বেড়াতে হবে না। নিজের কবিতার দায়িত্ব এখন তিনি নিজে নিতে সক্ষম। দুই বাংলা মিলিয়ে বেশ কিছু তরুণ কবি আজ এই পথে হাঁটছেন। আজ তাঁরা খাদক নন, উৎপাদকের ভূমিকায়। অবশ্য জবাগাছের পাশাপাশি বিছুটিও এক উৎপাদক, কারণ সেও ক্লোরোফিলের অধিকারী।
আলাদা করে প্রতিষ্ঠানবিরোধীতার কথাও আজ আর বলার দরকার নেই। প্রতিষ্ঠানবিরোধীতা বলে কিছু হয় কিনা, সেই প্রশ্নে না গিয়েই বলি, নিজের কবিতা প্রকাশের ভার নিজে পেলে সেই কবি স্বয়ং এক প্রতিষ্ঠানের নাম হয়ে ওঠার সুযোগ পান।
তবে এখানেও আসে স্ব-সম্পাদনার প্রশ্ন। ঠিক সোশ্যাল নেটওয়র্কের মতোই ব্লগেও আগে নিজের কবিতার জায়গাটা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নেওয়া ভালো মনে হয়। কবিতা লিখতেই পারেন, কিন্তু সেই কবিতা প্রকাশের সময়ে একটা অধিকারের প্রশ্ন হয়তো আসে। লোককে নিজের কবিতা পড়ানোর অধিকার কি আপনি অর্জন করেছেন? সেটা যাচাই করছেন কী করে? এখানেই কবিতার আন্তর্জাল পত্রিকাগুলি অনিবার্য। সেখানে আপনার যোগ্যতার একরকম বিচার হয়। সেই বিচারকে গ্রহণ অথবা প্রত্যাখ্যানের দ্বারা আপনি নিজের কবিতা সম্পর্কে একটা অবস্থানে আসতে পারেন। একটি আন্তর্জাল পত্রিকাকে কবিতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটু শক্ত হাত রাখতেই হয়। না হলে সে ব্যক্তিগত ব্লগ অথবা ফেসবুকের আরেক সংস্করণ হয়ে যাবে। বা মুক্তমঞ্চের মতো কোনো ফোরাম। পত্রিকার গুণ তার থাকবে না।
আবার ইদানীং এমন ব্লগজিনের আবির্ভাবও হচ্ছে, যার সম্পাদক নিজের কেরিয়ার গড়ে তুলতে সেটির জন্ম দিয়েছেন। অন্য ব্লগকে অনুসরণ এবং অনুকরণ তার মূলমন্ত্র, আলাদা কোনো দর্শন নেই। কেন সেই পত্রিকার উদ্ভব ঘটানো হলো, তিনি স্বয়ং বলতে পারবেন না, হয়তো বলবেন বাংলা কবিতার স্বার্থে তিনি এর জন্ম দিয়েছেন। দেখা যাবে সেখানে অন্যের কবিতা ছাপার অন্যতম শর্ত সেই সম্পাদকের কবিতা অন্য পত্রিকায় ছাপা হওয়ার সুযোগ তৈরি করা। এবং ইদানীং সত্যিই অনেকে তাঁর কবিতা ছাপতেও শুরু করেছেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ডাক পাচ্ছেন। বিনিময়ে উদ্যোক্তার কবিতা ছাপছেন। ফেউয়ের বদলে তিনি বাঘ হয়ে উঠছেন, এবং তার কারণ নিতান্তই তাঁর কবিতা নয়। যোগাযোগের এবং বিনিময়ের এই অভিশাপ ছাপা পত্রিকার ভুবন থেকে আন্তর্জালে প্রবেশ করেছে।
আবার কিছু অনলাইন পত্রিকা প্রথম থেকেই কবিতার নির্বাচনে নির্মম হতে চেয়েছে। একটি কবিতা নির্বাচিত হলে তিনটি কবিতা হয়তো বাতিল হয়েছে। একটি ওয়েবজিন বা ব্লগজিন সেটা করতে পারে। ফেসবুকে যে গ্রুপম্যাগগুলি আছে, তারাও পারে। কোনো ফোরামে বা ফেসবুকের ওপেন গ্রুপে সেই সুযোগ নেই। আবার একটি ফোরাম বা গ্রুপ জনারণ্যে আপনাকে নিজেকে যাচাই করার অন্য সুযোগ দেবে। রাস্তায় পড়ে থাকা হীরের টুকরোকে লোকে চিনে নেবেই, এই আশা আপনাকে দেবে। সেটা খুব সহজ পরিসর নয়।
শুধু আত্মপ্রকাশ নয়। আন্তর্জালের সুবাদে অনেক সীমাবদ্ধতা, অনেক অভিশাপ দূর হবে। টাকার অভাবে অনেকে বই করতে পারেন না। আবার নিজের টাকায় (তা-ও প্রয়োজনের দ্বিগুণ মূল্যে... আপনার বই প্রকাশক বিক্রির জন্য মোটেই করছেন না) বই করে, নিজের টাকায় সেই বই নিজের বাড়িতে ট্রান্সপোর্টে আনিয়ে, খাটের তলায় রাখতে হয়। সেই বই তারপর নিজের টাকাতেই লোককে পাঠাতেও হয়, নিজেই ফোন করে জিজ্ঞেস করতে হয় তা কেমন লাগল। সেইসব দিন থেকে কবিরা মুক্তি পেতে পারেন আজ। ‘প্রিন্ট অন ডিমান্ড’ পদ্ধতি এসে গেছে। আপনি নিজের পান্ডুলিপি নিজে কম্পোজ করে একটি নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটকে দিতে পারেন। তারা সেই বই আন্তর্জালে প্রকাশ করবে। কোনো পাঠক যদি বই হিসেবে পেতে চান, তারা অর্ডার পেলে মূল্যের বিনিময়ে পাঠিয়ে দেবে। আপনিও নিজের বই নিজে কিনে কাউকে দিতে পারেন উপহার হিসেবে বা আলোচনার জন্য। এই পদ্ধতি সর্বাঙ্গসুন্দর হয়তো নয়, তবে অসাধু প্রকাশকের লোলুপতা থেকে ভবিষ্যতের কবির মুক্তির পথ অবশ্যই।
তবে যে কবি স্বয়ং প্রকাশকের কাছে টাকা নিয়ে বই দেন, এই পন্থা তাঁর জন্য নয়। কিন্তু সেই কবির সংখ্যা কত? এবং বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ কি আদৌ তাঁদের মুখের দিকে চেয়ে আছে? বাণিজ্যিক কবিতা... সাধারণ মানুষের কবিতাবিমুখতা দেখে এই ধারণাটাকে সোনার পাথরবাটি ছাড়া কিছু মনে হয় না। অথচ এই ধারণাকে আঁকড়ে থেকেই সামগ্রিকভাবে বাংলা কবিতা হাস্যকর এবং অবান্তর হয়ে পড়ে। আবার এও একটা প্রশ্ন : বাংলা ভাষায় এই মুহূর্তে ২৫ জন মানুষেরও কি কবিতা পড়ার ক্ষমতা, এবং তা নিয়ে কথা বলার যোগ্যতা আছে?
একটা কথা স্পষ্ট করেই বলি? আন্তর্জাল যে বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ, এ নিয়ে খুব সন্দেহের সুযোগ আজ আর বোধহয় নেই। তালপাতার যুগ থেকে যেমন ছাপাখানা, লেটার প্রেস থেকে যেমন ডিটিপি, তেমন ভাবেই এসেছে আন্তর্জাল। এ অনিবার্য বিবর্তন বলেই আমি মনে করি। একে অস্বীকার করলে জীবনের এবং প্রাণের বিকাশের ধর্মকেই খারিজ করা হয়। একজন নগণ্য কবিতালেখক হিসেবেই এটা আমার ধারণা।
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুন