শনিবার, ১২ জুলাই, ২০২৫

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 

কালিমাটি অনলাইন / ১৩২ / ত্রয়োদশ বর্ষ : পঞ্চম সংখ্যা

 


অনেকেই মন্তব্য করে থাকেন, ইদানীং সময়টা খারাপ যাচ্ছে তাঁর। অর্থাৎ তিনি যা কিছু করছেন অথবা করতে চাইছেন, তা ঠিকঠাক হচ্ছে না, বা তাঁর মনোমত হচ্ছে না। বলা বাহুল্য, ব্যাপারটা একান্তই ব্যক্তিগত। সাধারণীকরণ বা জেনেরালাইজেশন করে কথাটা বলা যায় না। কেননা, অন্য অনেকের ক্ষেত্রে হয়তো  ব্যাপারটা অন্য ঘটছে, তাঁরা হয়তো মনোমত সাফল্য লাভ করছেন। এবং তাই তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই মন্তব্য করতে পারেন যে, সময়টা তাঁদের পক্ষে অনুকূল অর্থাৎ সুসময় চলছে তাঁর। সুতরাং বলা যেতেই পারে যে, সময়ের ভালো এবং খারাপ, এটা নিতান্তই আপেক্ষিক ব্যাপার এবং অবশ্যই তুলনামূলক। কিন্তু যদি আমরা ব্যক্তিগত ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এসে বৃহত্তর সমাজের প্রেক্ষাপটে সময়ের কথা ভাবি, তাহলে নিঃসন্দেহে সময়ের মূল্যায়ন স্বতন্ত্র হবে।

আমাদের স্বল্প অথবা দীর্ঘ জীবনকালে আমরা অর্থনৈতিক রাজনৈতিক এবং সামাজিক পারিপার্শ্বিকতায় কখন ভালো বা খারাপ অবস্থায় ছিলাম এবং আছি, এটা অবশ্যই বিতর্কের ব্যাপার। বস্তুত সমস্যাহীন, টানাপড়েনহীন, সন্ত্রাসহীন সমাজব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিতি আমাদের এখনও হয়নি, অতীতেও কারও জীবনযাপনে তা হয়নি। অর্থাৎ অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন প্রতিকূলতার ঘূর্ণাবর্তের মধ্যেই আমাদের যাপন এবং সেই প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই। সুতরাং এই পারিপার্শ্বিকতায় সমষ্টিজীবনে ভালো সময়ের প্রসঙ্গই অর্থহীন এবং অবান্তর।

প্রতিদিনের সংবাদপত্র, রেডিও সংবাদ, টিভি সংবাদ বহন করে নিয়ে আসছে সারা বিশ্বব্যাপী উত্তেজনা হিংসা অস্থিরতার যাবতীয় সংবাদ। সন্ত্রাসবাদীদের নৃশংসতা, যুদ্ধবাজদের গণহত্যা, সাম্প্রদায়িকদের তান্ডব, সমাজবিরোধীতত্ত্বদের ঘৃণ্য আচরণ ও কার্যকলাপ সাধারণ জনসাধারণকে আতঙ্কিত করে রেখেছে। আমরা কেউ আজ নিরাপদে নেই, শাসকশ্রেণী নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। বিশেষত কোনো কোনো শাসকশ্রেণীর প্রশ্রয়ে ও মদতে জনজীবনের সর্বত্র বিরাজ করছে অরাজকতা। সভ্যতা বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে, যখন বিজ্ঞানের গভীর অনুশীলন ও প্রযুক্তিচর্চা নেহাতই শৈশবস্থায়, তখন তৎকালীন জীবনযাত্রায় যে আদিম মানসিকতা ছিল, আজ সভ্যতা এতটা অগ্রসর হবার পর, যখন প্রযুক্তির জয়যাত্রা এক অকল্পনীয় উচ্চতায় উন্নীত হয়েছে, দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় ঘটেছে অভূতপূর্ব পরিবর্তন, তখন কি আমাদের মানসিকতা পেছোতে পেছোতে আদিম যুগের মানসিকতা থেকেও ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে? আমরা কি দুর্বৃত্তদের ঘড়ির কাঁটা পেছনে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার ষড়যন্ত্রের শিকার?  

ইদানীং কাউকে ভালো থাকার শুভকামনা জানালেও সংশয় জাগে, আদৌ কি কেউ ভালো আছে, ভালো থাকতে পারছে? সম্ভবত নয়। এজন্য সময়কে দোষারোপ করা অহেতুক। বরং দোষী করা যেতে পারে এই বিশ্বে বসবাসকারী এক শ্রেণীর মানুষকে, যারা এই নষ্ট সময়ের জন্মদাতা, তার পোষক ও পরিচালক।    

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

 

 

 


শিবাংশু দে

 

শোলে অথবা আর্বান নাস্তিকতা

 


'কিতনে আদমি থে?

-দো সরকার!

-সির্ফ দো? ফির ভি ওয়াপস আ গয়া? খালি হাঁথ?'

এই 'দো আদমি' যেন ভবসংসারের আস্তিক আর নাস্তিক। এদের ঝগড়া যেন 'শোলে' ফিলিম। কখনও পুরনো হয় না। অপ্রাসঙ্গিকও হয় না। কিন্তু ফিরতে হয় 'খালি হাঁথ'। ফোস্কা-কাতর যে সব জনতা ঠাকুরের মাথায় জল ঢালতে যান, তাঁরা বিশ্বাস করেন তাঁদের মতো অমন আস্তিক আর কেউ নয়। পাশের লোকটি আচমকা হেঁচে ফেললেও যাঁরা ভাবেন 'আস্থা আহত হুয়া', তাঁরাও তেমনই ভাবেন। আবার এক দল 'সফিস্টিকেটেড' আস্তিক আছেন, যাঁরা খালি পায়ে জল ঢালতে যাবার ধকল সামলাতে পারেন না, তাঁদের আস্তিকতা অন্যরকম। যে কোনও 'বিতর্কে'র সময় তাঁরা ঠাণ্ডা গলায় বলেন, 'ভক্ত নই, কিন্তু একটা 'শক্তি'তে বিশ্বাস করি। কে চালাচ্ছে সব কিছু?' সেটা আবার একটা মারাত্মক অবস্থান। 'শক্তি' বলতে তাঁরা কী বোঝেন, তার জবাব তাঁদের কাছে নেই। যাঁরা নিজেদের উচ্চকিত ভাবে 'নাস্তিক' বলে দাবি করেন, তাঁদের ব্যাপারও বেশ সন্দেহজনক। 'নাস্তিকতা' একটা মানসিক অবস্থান। চেঁচামেচি করে তাকে প্রতিষ্ঠা করা যায় না। যাকগে, সম্প্রতি এক বন্ধু এই বিষয়ে আমার অবস্থান জানতে চেয়েছিলেন। এতো 'কোটিন' বিষয় 'টু মিনিট নুডলস' এর মতো স্মার্টলি ব্যাখ্যা করা যায় না। আমার ধারণায় এদেশে বিষয়টি নিয়ে সব চেয়ে স্বচ্ছ ধারণা ছিলো শাক্যমুনি গৌতম বুদ্ধের। তাঁকে উপজীব্য করে লেখা আমার নিবন্ধটি থেকে সামান্য অংশ ঊদ্ধৃত করলুম। আগ্রহী বন্ধুরা পড়তে পারেন,

‘…অস্তি, বা বিপরীতে নাস্তি শব্দের মূল রয়েছে কোনও একটি অস্তিত্ত্বের ধারণার মধ্যে। ব্যাপারটা বলা যত সহজ, অবস্থাটি তত সহজ নয়। এত বহুমুখী ও বিপরীতমুখী ব্যাখ্যা, তর্ক ও অবস্থান রয়েছে এই প্রশ্নে যে, তাকে সরলীকরণ করতে চাওয়া বিপজ্জনক। যদিও পরবর্তীকালে নাস্তিকতার প্রশ্নটি যখন মূলতঃ রাজনৈতিক অবস্থান হয়ে গেল, তখন উত্তরটিও সহজ বাইনারিতে ব্যাখ্যা করা শুরু হলো। যে ঈশ্বরকে মানে, সে আস্তিক এবং বিপরীত হলেই নাস্তিক। এ পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু যাঁরা 'ঈশ্বর' নামক সূচক দিয়ে আস্তিকতার অবস্থান বিচার করেন, তাঁদের অধিকাংশের কাছেই স্পষ্ট নয় 'ঈশ্বর' অর্থে কার বা কীসের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা হচ্ছে। ভারতবর্ষ সম্বন্ধে একটা সাধারণ ধারণা রয়েছে যে, এই দেশের মানুষ বৃহত্তরভাবে ঈশ্বরবিশ্বাসী বা 'ধর্মভীরু'। এই প্রচারটি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিলো আদি শংকরাচার্যের আধ্যাত্মিক মন্থনের সময় থেকে।

আমাদের দেশে ঈশ্বরভিত্তিক অস্তি-নাস্তির প্রশ্নটি নিয়ে বিশদ আলোচনা শুরু হয় বেশ দেরিতে। কারণ, এদেশের দর্শনভূমিতে সেমেটিকদের মতো একেশ্বরবাদী প্রকল্পনাটির স্থান প্রস্তুত হয়েছিলো পুরাণযুগের দ্বিতীয় পর্বে মাত্র। সময়কালের বিচারে অর্বাচীনতম দর্শন, উত্তরমীমাংসা, অন্য নাম বেদান্ত, সেখানে ব্রহ্মমীমাংসা নাম দিয়ে ঈশ্বরের পরিভাষা প্রস্তাব করা হয়েছিলো। "যাঁর থেকে এই জগতের জন্মাদি, তিনিই ব্রহ্ম" (জন্মদস্য যতঃ) -(বেদান্তসূত্র ১/১/২)

অর্থ সম্প্রসারণ করলে দাঁড়াবে, “যাঁর থেকে জগতের উৎপত্তি, স্থিতি ও ভঙ্গ হয়, তিনিই ব্রহ্ম।" এখানে এক অদ্বয়, সর্বশক্তিমান, সর্ব সৃজক 'ব্রহ্ম' বা 'ঈশ্বর'কে কেন্দ্রে রেখে দর্শনটি দানা বেঁধেছে। অথচ ভারতীয়  দর্শনচর্চার যে মূল ছ'টি ঘরানা রয়েছে, যাকে একসঙ্গে ষড়দর্শন বলা হয়, সেগুলি বিচার করলে ভারতীয়দের বহুবিজ্ঞাপিত 'ঈশ্বরবিশ্বাসে'র পূর্বাগ্রহটি বাতুল বোধ হয়। ষড়দর্শনের প্রায় সব প্রবক্তাই ‘সৃষ্টিকর্তা’ ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। আমাদের প্রাচীনতম দর্শন কপিলমুনির সাংখ্য, বা সাংখ্যের পথে বিকশিত যোগ বা লোকায়তদর্শন, সবই দ্ব্যর্থহীনভাবে নিরীশ্বরবাদী। কপিলমুনিই সম্ভবত প্রথম মানুষ, যিনি অতি স্পষ্টভাবে ঈশ্বরতত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। তাঁর বিখ্যাত উক্তি, "ঈশ্বরাসিদ্ধেঃ", মানে ঈশ্বরের অস্তিত্ত্ব অপ্রমাণিত। যুগে যুগে যাঁরা এই বক্তব্যটি নিয়ে তর্ক করেছেন, তাঁরা কিন্তু কেউই বলতে পারেননি 'নির্গুণ' ঈশ্বর সগুণ প্রকৃতিকে কীভাবে সৃষ্টি করলেন। পতঞ্জলি 'ঈশ্বরে'র অস্তিত্ত্ব অস্বীকার করেননি বটে, কিন্তু তাঁর ঈশ্বর বিশ্বস্রষ্টা ন'ন। বৈশেষিকদর্শনের কণাদ বা গোতম জড় পরমাণুকে বিশেষ বা নিত্য বলেছেন। ঈশ্বরকে নয়। প্রাচীন মীমাংসা বা পূর্বমীমাংসার প্রধান প্রবক্তা জৈমিনি 'ঈশ্বরে'র  অস্তিত্ত্ব অস্বীকার করেছেন।

“অপৌরুষেয় এষঃ সম্বন্ধঃ ইতি পুরুষস্য সম্বন্ধভাবাৎ।

কথং সম্বন্ধো নাস্তি। প্রত্যক্ষস্য প্রমাণস্যাভাবাৎ তৎপূর্বক ত্বাচ্চেতরেষাম।“

(জৈমিনিসূত্র ভাষ্য)

[অপৌরুষেয়, অর্থাৎ কোনও পুরুষ দ্বারা (এই বিশ্ব) কৃত নয়। কারণ সেরকম কোনও সম্বন্ধপুরুষই নেই। এরকম পুরুষের কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণ তো নেইই, অন্য কোনও পরোক্ষ প্রমাণও নেই।]

উপরন্তু যে বেদান্তে 'ব্রহ্ম' নামক সর্বসৃজক, সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ধারণা সৃষ্টি করা হয়েছে, সেই দর্শনই তো বলে জগৎ এখনও সৃষ্টিই হয়নি। সবই মায়াভ্রম। যদি সৃষ্টিই না থাকে, তবে সৃষ্টিকর্তার প্রশ্ন উঠছে কোথা থেকে!

সাংখ্যের সমসাময়িক বা পূর্বতন দর্শন ছিলো চার্বাকপন্থীদের। তাঁরা সর্ব অর্থে ছিলেন 'নাস্তিক'। এদেশে চার্বাককে আদর্শ নাস্তিক বলা হয়েছে। কারণ এই দর্শন একাধারে জড়বাদী (Materialist), উচ্ছেদবাদী (Nihilist), দৃষ্টবাদী(Positivist), সংশয়বাদী(Agnostic), হেতুবাদী(Ratinalist), প্রেয়ংবাদী(Hedonist), দেহবাদী, অনাত্মবাদী ও ইহসর্বস্ববাদী। সর্বদর্শনসংগ্রহে চার্বাককে 'নাস্তিক শিরোমণি' বলা হয়েছে। অতএব চার্বাকের মানদণ্ডেই বুদ্ধের 'নাস্তিকতা'র মূল্যায়ণ করা যেতে পারে। চার্বাকপন্থীদের মূল গ্রন্থ সর্বদর্শনসংগ্রহে এই মতবাদ নিয়ে যেসব চর্চা আছে তার কিছু অতি সংক্ষিপ্ত বিচার করতে গেলে বিষয়টি স্পষ্ট হতে পারে।

“ন স্বর্গো নাপবর্গোবা নৈবাত্মা পারলৌকিকঃ।

নব বর্ণাশ্রমাদীনাং ক্রিয়াশ্চ ফলদায়িকাঃ।।

অগ্নিহোত্রং ত্রয়োং বেদাস্তিদণ্ডং ভস্মগুণ্ঠনম।

বুদ্ধিপৌরুষ হীনানাং জীবিকা ধাতৃনির্ম্মিতা।।“

(সর্বদর্শনসংগ্রহ-চার্বাক দর্শন)

[স্বর্গ নেই, অপবর্গ নেই, পরলোকে আত্মাও থাকে না। ব্রাহ্মণাদি বর্ণ বা ব্রহ্মচর্যাদি আশ্রম ইত্যাদির কোনও ফলদায়ক ক্রিয়া নেই। অগ্নিহোত্র, ঋক, সাম আদি তিনটি বেদ, ত্রিদণ্ড, দেহে ভস্মলেপন ইত্যাদি, বিধাতা অবোধ কাপুরুষ ব্যক্তিদের জীবিকা অর্জনের জন্য সৃষ্টি করেছেন।]

সমকালীন অধ্যাত্মজগতে নাস্তিক্যবাদের যে পরিভাষাটি প্রভাবী ছিলো, সে প্রসঙ্গে বুদ্ধের এই বিবৃতিটি পাওয়া যায়,

“নত্থি দিন্নং, নত্থি য়িষ্টং, নত্থি হুতং, নত্থি সুকত-দুক্কানাং কম্মানংফলং বিপাকে। নত্থি অয়ং লোকে নত্থি পরো লোকো, নত্থি মাতা নত্থি পিতা, নত্থি সত্তা ওপপাতিকা, নত্থি লোকে সমনব্তাহ্মণা সম্মাগগতা সম্মাপটিপন্না যে ইমং চ লোকংপরং চ লোকং সয়ং, অভিঞঞা সচ্ছিকত্বা পবেদেস্তি।“ ...ইত্যাদি

(মজ্ঝিমনিকায়)

[চারটি ভূতের দ্বারা নির্মিত যে দেহ, সেটাই জীব। দেহের অতিরিক্ত কোনও আত্মা নেই। শ্মশানেই মানুষের সব শেষ। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ক্ষিতি মাটিতে, অপ জলে, তেজঃ আগুনে, মরুৎ বায়ুতে আর ইন্দ্রিয়সকল আকাশে মিলিয়ে যায়। অজ্ঞবিজ্ঞ সকলেই দেহের নাশের সঙ্গে বিনষ্ট হয়ে যায়। ইহলোক পরলোক ভেদ করা মূর্খতা। দান-শীল-ত্যাগ-কৃত্য সবই পণ্ডশ্রম, নিরর্থক ও নিষ্ফল।]

শ্রীরামকৃষ্ণ (বুদ্ধের এই ভাষ্য প্রসঙ্গে) বলেন,

‘…নাস্তিক কেন? নাস্তিক নয়, মুখে বলতে পারেন নাই। বুদ্ধ কী জান? বোধ-স্বরূপকে চিন্তা ক'রে ক'রে, -তাই হওয়া, -বোধস্বরূপ হওয়া... নাস্তিক কেন হতে যাবে! যেখানে স্বরূপকে বোধ হয়, সেখানে অস্তি-নাস্তিক মধ্যের অবস্থা... যা'রা সংসারী, ইন্দ্রিয়ের বিষয় নিয়ে র'য়েছে, তারা বলছে, সব 'অস্তি'; আবার মায়াবাদীরা বলছে, -'নাস্তি'; বুদ্ধের অবস্থা এই 'অস্তি' 'নাস্তির' পরে’।

বুদ্ধের নাস্তিক্য বিষয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের অবস্থানটি মূলত মহাযানী শূন্যবাদের বিকশিত রূপ। শুধু তাই নয়, বুদ্ধের নাস্তিকতা প্রসঙ্গে এটাই এদেশে সব চেয়ে প্রচলিত মত। শ্রীরামকৃষ্ণ তো স্পষ্টত মায়াবাদীদের কথাও উল্লেখ করেছিলেন। আড়াই হাজার বছর কেটে যাবার পরেও মানুষের যেন বিশ্বাস হতে চায় না শাক্যমুনি এমন একটা অধ্যাত্মদর্শনের খোঁজ দিয়েছিলেন, যেখানে আত্মিক উন্নতির জন্য সর্বশক্তিমান ঈশ্বর নামক কোনও অস্তিত্ত্বের প্রয়োজন নেই।

'ঈশ্বর'বিশ্বাস না থাকলেও উচ্ছেদবাদী (Nihilist) হতে হয় না। ঈশ্বররহিত মানবধর্ম পালন করেই বুদ্ধ শ্রেষ্ঠ মানব হতে পেরেছিলেন। ‘অস্তিনাস্তি’র বালাই তুচ্ছ করে উড়িয়ে দিয়েছিলেন অশ্বত্থের পাতায়, শাখায়।

{'বুদ্ধ ও নাস্তিকতা' (বুদ্ধ- এক অনন্ত অডিসি) থেকে সামান্য অংশ}

 

 


পি. শাশ্বতী

 

ব্রহ্মময়ী না কালী কি হিন্দু ঘরের মেয়ে, নাকি তিনি শবরকন্যা 



 

ব্রাহ্মণ্যবাদ অনুসারে হিন্দুধর্মের তেত্রিশ কোটি দেবতা। কিন্তু এই কোটি বলতে সাদা মনে আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি ব্যাপারটা আসলে কী? হিন্দু শাস্ত্রের জন্মকালে গোটা হিন্দু জাতির জনসংখ্যা এক কোটিও ছিল কিনা সন্দেহ। সেখানে তেত্রিশ কোটি দেবতার বর্ণনা কি একটা অবাস্তব ধারণা নয় কি? তাহলে হিন্দু শাস্ত্রজ্ঞরা এমন একটি সংখ্যার কথা কেন বলেছিলেন? প্রকৃতপক্ষে সংস্কৃতে ‘কোটি’ শব্দের দুটি অর্থ। একটি কোটি বলতে ‘প্রকার’কে বোঝানো হয, অপরটি সংখ্যা অর্থে বোঝানো হয়। সনাতনধর্ম  মতে দেবীভাগবতপুরাণ ও শ্রীশ্রীচণ্ডী অনুসারে যখনই পৃথিবীতে ও অমৃতলোকে অনিষ্টকর কোনো পাশবিক শক্তির উত্থান হয়েছে, তখনই বিশ্বপ্রসবিনী আদ্যাশক্তি মহামায়া দেবী নানা রূপ পরিগ্রহ করে তাঁর সন্তানদের রক্ষা করতে নানারূপে আবির্ভূত হয়েছেন। ভগবতী কালীদেবী রূপের উৎপত্তিও অনাদির আদি সেই আদ্যাশক্তি মহামায়ার থেকে। প্রথম মহাবিদ্যা দেবী কালী। দেবী ভগবতী মহামায়ার কালী রূপ তমোময়ী, উগ্রা, প্রচণ্ডা, ভীষণা হলেও তিনি স্বরূপত ত্রিগুণাতীতা, প্রশান্তা, স্নিগ্ধা, মাতৃরূপা। একই সঙ্গে দুই বিপরীত ভাবের অসামান্য সমন্বয় তাঁর মধ্যে রয়েছে। তিনি সাক্ষাৎ বিপরীত রতাতুরা। তিনি মহাকাশের মতো। দূর থেকে মহাকাশের রং এক এক সময় যেমন এক এক রকম ভাবে উদ্ভাসিত হয়, কিন্তু গভীরে তার থাকে একটিই রং - অসীম শূন্যতা এবং অন্তহীন এক মহাকাশ। মহাকাশ যেমন বর্ণহীন স্বরূপ সত্য, তেমনই সত্য বর্ণময় স্বরূপও। মহাজগতের যা কিছু পরমধ্রুব ও শুভ তার মধ্যে এই বৈপরীত্য বড় অনায়াসে থাকে। ভগবতী কালী দেবীও তেমনই এক বিরাট শক্তিতত্ত্ব। প্রচলিত বৈপরীত্যই তাঁর কাছে তাই অতি স্বাভাবিক।

শ্রীমৎ-দেবীভাগবতপুরাণ ও শ্রীশ্রীচণ্ডীতে বর্ণিত দেবী কালীর বিবরণ অনুসরণ করে অখণ্ড বঙ্গদেশে দেবী কালী বর্তমানে বহুল প্রচলিত মাতৃময়ী রূপ নিয়ে প্রকাশিত হয়েছেন। এর প্রসারে সহায়তা করেছে বঙ্গবলয়ে দীর্ঘকাল প্রচলিত বিষ্ণুক্রান্তা তন্ত্রসাধনা। উগ্ৰা মাতৃরূপে প্রতিষ্ঠিত দেবী কালী মহাশক্তির উৎস। সিংহহৃদয়ের মাতৃভক্ত এই মহাদেবীর উপাসক। পৌরাণিক ও তান্ত্রিক পথের আরাধ্য দেবী কালীই পরবর্তী সময়ে বাংলার মাতৃসঙ্গীতে কখনও অভয়া বরদা, কখনও মাতা, কখনও কন্যা হয়ে ফুটে উঠেছেন।

মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের পরবর্তী সময়ের বিখ্যাত মাতৃসাধক তন্ত্র-আচার্য কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ প্রথম মহাবিদ্যা দেবী কালীকে বঙ্গের সাধারণ মানুষের উপযোগী রূপকল্পে সাজিয়ে তুলেছিলেন, এমন একটি কিংবদন্তি প্রচলিত রয়েছে। স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে তিনিই প্রথম দেবী কালিকার মূর্তি গড়ে পুজো করেন। যদিও প্রাচীন সময় থেকেই বঙ্গদেশ ছিল শক্তিসাধনার পীঠস্থান। বঙ্গে অজস্র প্রাচীন মাতৃকাদেবীর মূর্তি রয়েছে। অবশ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেইসব শক্তিমূর্তির সঙ্গে কৃষ্ণানন্দ সৃষ্ট দেবীর মূর্তির মিল খুব কমই দেখতে পাওয়া যায়। হলেন স্নিগ্ধা দক্ষিণাকালিকা রূপের আদি রূপকার। কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ ছিলেন বঙ্গের একজন প্রসিদ্ধ তন্ত্র-আচার্য। কিংবদন্তি অনুসারে, সাধনায় সিদ্ধ হওয়ার পর কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ ভগবতীর কাছে দৈবী আদেশ পেয়েছিলেন। সেই আদেশেই ভগবতী কালীর দক্ষিণাকালী রূপ নির্মাণের দায়িত্ব পেয়েছিলেন আচার্য কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। দৈব নির্ধারিত পদ্ধতিতে আচার্য কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশই পেরেছিলেন পৌরাণিক ভ্রকুটি ভীষণা ভীমা প্রায় উন্মত্তা রণরঙ্গিনী মহাদেবীকে বঙ্গনারীর মতোই স্নেহময়ী বঙ্গমাতা করে তুলতে। শ্মশানের আরাধ্যা দেবী ধীরে ধীরে প্রবেশ করেছিলেন লোকালয়ে। সিদ্ধিলাভের পরে মাতৃসাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের ততোধিক কঠোর তান্ত্রিক সাধনায় তাঁর কাঙ্ক্ষিত আরাধ্যা ভগবতী কালী দেবীই হয়ে উঠেছিলেন প্রকারান্তরে তাঁর নিজের মা, একেবারে ঘরের গর্ভধারিণী মায়ের মতো মা।

অখণ্ড বঙ্গময় সতীপীঠের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। বঙ্গদেশ শক্তির উপাসনালয়। সপ্তম শতাব্দীতে আদি শঙ্করাচার্য পূর্বভারতের অসম-বঙ্গদেশে তন্ত্রের প্রভাবকে নষ্ট করে দিয়ে অদ্বৈতবেদান্তের সিদ্ধান্ত প্রসারের জন্য জ্যোতির্মঠ স্থাপন করতে চাননি। বঙ্গ-অসমে পরিব্রজ্যাকালে তিনি এই অঞ্চলে তন্ত্র সাধনমার্গের মধ্যে এক অতীন্দ্রিয় শুভশক্তি অনুভব করেছিলেন। ফলে বঙ্গদেশের মাতৃসাধক ও তাঁদের সাধনার বিষয়ে যথেষ্ট সহানুভূতিশীল ছিলেন আদি শঙ্করাচার্য।

তন্ত্রসাধনায় বিশ্বাস করা হয় - যা আছে মানুষের দেহ ভাণ্ডে, তা আছে এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে। পুরাণ-তন্ত্র- শাস্ত্রাদির সেই মহতী ভগবতী অখণ্ড অনন্ত চেতনা স্বরূপে সমগ্র বিশ্ব চরাচরে ব্যাপ্ত হয়ে রয়েছেন। সমস্ত কিছুই তাঁর থেকে জন্ম নিয়েছে, আবার সবকিছুই তাঁর মধ্যে লয়ও হয়ে যাচ্ছে, আবার তিনিই সৃষ্টি থেকে বিনাশ পর্যন্ত সবকিছুকে সযত্নে নিরলসভাবে লালন করে চলেছেন। সমগ্র মহাজগতের এই প্রকাশ ও বিনাশ তাঁর অনন্ত লীলার মাত্র এক ছটা। সাধক আচার্যদেব কৃষ্ণানন্দের মাতৃচেতনার এই মহান ধারাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর যোগ্য উত্তরসূরিরা, শিষ্য ও ভাবশিষ্যরা। এঁদের মধ্যে অন্যতম মাতৃসাধক ও মাতৃপদ রচয়িতা রামপ্রসাদ সেন। রামপ্রসাদের সমসাময়িক আরেকজন বিখ্যাত মাতৃসাধক ও শাক্তপদকর্তা কমলাকান্ত ভট্টাচার্য। আচার্য কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের মতো রামপ্রসাদ সেন ও কমলাকান্ত ভট্টাচার্যেরও সাক্ষাৎ মাতৃদর্শন হয়েছিল। এঁরা দুজনেই প্রথাগত তন্ত্রোক্ত পদ্ধতিতে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। কৃষ্ণানন্দের মাতৃচেতনার পথেই দেবী কালিকা যেন গর্ভধারিণীর মতোই ছিলেন রামপ্রসাদের চিৎ-আকাশে।

সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে সাধকদের বাহ্যত দুটি ভিন্ন পথ দেখা যায়। প্রথমটি, সাধকেরা সিদ্ধি অর্জন করে নিত্য সমাধিস্থ হয়ে লোক-জীবনোত্তীর্ণ এক আধ্যাত্মিক পথ গ্ৰহণ করেন। দ্বিতীয়টি, সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেও সাধকরা লোককল্যাণের জন্য সাধারণের উপযোগী আদর্শ তৈরি করে দিতে থাকেন, যা অনুসরণ করে সাধারণ মানুষও দৈনন্দিন জীবনের কাজের মধ্যে থেকেও সাধনায় ব্রতী হতে পারেন। তাঁরা তাঁদের সাধন লোককল্যাণে ব্যয় করেন। কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের পর রামপ্রসাদ সেন ও কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের হাত ধরে অব্যক্ত অখণ্ডমণ্ডলাকার চেতনাতীত মহাদেবী কালী শ্মশানচারী রূপ মুছে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন বাংলার স্নেহময়ী মা-তে, তিনি আসন পাততে শুরু করেছিলেন লোকালয়ের মাঝে, এমনকি ভদ্রাসনেও। এই পর্বে কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার (রায়) শাক্তধর্মের প্রসারের কাজে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি কৃষ্ণনগরে শাক্তরসের সূচনা করেছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই বঙ্গময় ছোট-বড় অজস্র শক্তিপীঠের সংস্কার শুরু হয়েছিল। এই পর্বেই গোটা বঙ্গে একাধিক রাজার তত্ত্বাবধানে একাধিক শাক্তমন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। রামপ্রসাদের দরদী ও আকুলকণ্ঠে শ্যামা, শ্যাম, শিব, রাম এক রূপে দেখা দিয়েছিলেন। রামপ্রসাদ সেন ও কমলাকান্ত ভট্টাচার্য গানে গানে বলেছিলেন পরমাত্মার পরম সত্তা আসলে এক, শুধু তাঁর প্রকাশ ভিন্ন ভিন্ন। সেই পরমতত্ত্বকে কেউ জগদীশ্বর বলে চেনেন, কেউ আবার জগদীশ্বরী বলে চেনেন। শাক্ত পদরত্নে ঘোষিত হতে শুরু করেছিল, মাতৃসাধনায় তন্ত্রোক্ত পদ্ধতির পাশাপাশি শুধুমাত্র মাতৃনাম জপেও সিদ্ধি মেলে। সেখানে মা মন্ত্রের অধীন হন না, তিনি সন্তানের প্রতি বাৎসল্যে অধীন।  কবিয়াল অ্যান্টনি ফিরিঙ্গী জন্মসূত্রে অহিন্দু হয়েও ভগবতী মায়ের পরম শরণ পেয়েছিলেন কত অনায়াসে! তিনি হয়ে উঠেছিলেন মাতৃসাধক। কলকাতার বর্তমান বৌবাজার অঞ্চলে এন্টনি ফিরিঙ্গী সাহেবের উপাস্য দেবী কালী আজও কৃপা বিলিয়ে চলেছেন।

অন্যদিকে রামকৃষ্ণ দেখালেন শুধু অখণ্ড ভালোবাসা দিয়েও উপাস্য মাকে পাওয়া যায়, নিত্য তাঁর সাহচর্য লাভ করা যায়। ভগবতীকে জীবন্ত দেখা যায়, অন্যকেও দেখিয়ে দেওয়া যায় যে, তিনি কোনো কাল্পনিক চরিত্র নন। তাঁর ক্ষেত্রে দেখা গেল, শুধু আর্তি মাখানো ভালোবাসা দিয়েই সাধনাতীত আদ্যাশক্তি ভবতারিণী ভগবতীকে একেবারে খুব কাছে পাওয়া যায়, তাঁর সঙ্গে একত্রে বসা যায়, কথা বলা যায়। শ্রীরামকৃষ্ণ এখানেই থেমে থাকলেন না, আরও একধাপ এগিয়ে তিনি শেখালেন সর্বজীবে তাঁকে অনুভবও করা যায়। তখন গৃহস্থ বাড়ির সতীলক্ষ্মী নারীও ভগবতী, পতিতাপল্লির বেশ্যাও ভগবতী। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে বলা হয়েছে, সমস্ত স্ত্রী সাক্ষাৎ জগদীশ্বরী। আর শ্রীরামকৃষ্ণ তা জীবনে প্রয়োগ করে দেখালেন। শুধুমাত্র তীব্র সহজসাধনায় আবেগমথিত হয়ে ভগবতীর দর্শনের পর রামকৃষ্ণ পরমহংস করেছিলেন তন্ত্রের সাধন। তাঁর তন্ত্রোক্ত পদ্ধতির সাধনার পথ প্রদর্শক ছিলেন এক নারী— ভৈরবী যোগেশ্বরী ব্রাহ্মণী। শ্রীরামকৃষ্ণজীবনের এক চরম সত্য ছিল অপার ও একনিষ্ঠ সাধ্যসাধন! অখণ্ড বঙ্গদেশে মাতৃসাধনার ধারায় এমন আর দ্বিতীয় হয়নি। শ্রীরামকৃষ্ণের সমসাময়িক আরেকজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মাতৃচিন্তার এই ধারায় যুক্ত করেছিলেন স্বদেশচেতনা। পুরাণ ও তন্ত্রোক্ত অখণ্ড শক্তিময়ী কালী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন দেশজননী রূপে। বাস্তবিকই সৃষ্টি-পালন-সংহারের ত্রিতত্ত্ব যেভাবে কালীর সঙ্গে যুক্ত, সেভাবেই দেশমাতৃকার সঙ্গেও জুড়ে যেতে শুরু করেছিল। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘আগামী পঞ্চাশ বছর এদেশের একমাত্র উপাস্য হবেন দেশজননী। দেশে বইবে শক্তির উপাসনার মলয় বাতাস। সাহসে যে দুঃখ দৈন্য চাইবে, মৃত্যুরূপা মাতা কালী করালিনী তাঁর কাছে প্রকাশিত হবেন। এইবার ভগবতী হবেন বীরজননী।’

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মা রূপে প্রকাশিত হলেন কালী ও অন্য শক্তিদেবীরা। স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতাও ভগবতী কালী ও দেশজননীকে এক করে দেখিয়েছেন। এই ভাবনা প্রসারিত হলে বীরমাতার বীর সন্তানদের হাতেই দেশের প্রকৃত সমৃদ্ধি আসতে শুরু করেছিল। ইংরেজ শাসনের আসন টলতে শুরু করেছিল এই সময় থেকেই। এর আগে দেশমাতা রূপে শক্তির উপাসনা দক্ষিণ ভারতের মারাঠাদের হৃদয়সম্রাট তথা মহারাষ্ট্রের নবজাগরণের পথিকৃৎ ছত্রপতি শিবাজি মহারাজও করেছিলেন।

বঙ্গদেশে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ও বিংশ শতাব্দীর শুরুতে শাক্তচেতনা পরিপক্ক আসন তৈরি করে নিতে পেরেছিল। কাজেই ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মমতের মতাদর্শের মধ্যে থেকেই এই ধারায় প্রচ্ছন্নভাবে যুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন, তিনি দেশমাতৃকার বন্দনায় ‘ডান হাতে খড়গ জ্বলে, বাঁ হাত করে শঙ্কাহরণ’ রূপের বর্ণনা করেছিলেন পরম কৌশলে। দেশমাতার মধ্যে এ যে কালীরই আবেশ। পরবর্তী সময়ে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু কলকাতায় বসবাসকালে শক্তির উপাসনা শুরু করেছিলেন উত্তর কলকাতার বাগবাজারে। বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গোৎসব শুরুর দিকে নেতাজিও ছিলেন এর সঙ্গে যুক্ত। নেতাজির আগ্ৰহে দুর্গাষ্টমী তিথি বীরাষ্টমীতে পরিণত হলো। বৈচিত্র্যময়ী দেবীর লীলাবৈচিত্র্যে এরপর আরও সমৃদ্ধি দিতে এলেন কবি নজরুলও। জন্মসূত্রে মুসলমান হয়েও তিনি নিজে ছিলেন মাতৃসাধক। অসীম বিরাটকে তিনি আদরের মেয়ে রূপে দেখলেন, আবার পূর্বসূরি কবিদের মতো নিজে শিশু হয়ে দেবীর কোলে মাথা রাখলেন। মুর্শিদাবাদের লালগোলার রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি রাজবাড়ি কালীমন্দির ও লালগলার অদূরে এক জাগ্রত কালীমন্দিরে গিয়ে রীতিমতো সাধনায় মগ্ন থেকেছেন দীর্ঘ দিন। নজরুল ইসলামও কালী দেবীকে দেশমাতা রূপে চিহ্নিত করেছিলেন। নজরুলের শাক্ত গানগুলিতে বহু রাগ রাগিনীর ব্যবহার রয়েছে। সঙ্গীতের মাধ্যমে মাতৃচর্চার একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিল এই সময় থেকে। এই ধরনের শাক্ত পদাবলি যখন বাংলার শক্তিসাধনাকে সমৃদ্ধি দিতে শুরু করেছিল সেই সময়ে আর একজন শাক্ত পদকর্তা ও মাতৃসাধক নজরুলের সমান্তরালে বাংলার কালীচেতনায় এনেছিলেন মাধুর্যের উচ্ছ্বাস, তিনি আন্দুল কালীকীর্তন সমিতির প্রাণপুরুষ প্রেমিক মহারাজ।

মাতৃসাধক প্রেমিক মহারাজও রামপ্রসাদের মতো সুকণ্ঠের অধিকারী ছিলেন। সাধকোচিত গভীর মাতৃভাবপূর্ণ বাণী ও সঙ্গীত ছড়িয়ে পড়ে ছিল বাংলার দিকে দিকে। রামপ্রসাদ সেন ও কমলাকান্ত ভট্টাচার্য যদি বাংলা মাতৃসঙ্গীতের মাধ্যমে বাঙালির কালীচেতনা ও কালীচর্চার প্রসারের প্রথম যশস্বী জুটি হন তবে মাতৃসাধক প্রেমিক মহারাজ ও নজরুল ইসলাম পরবর্তী সময়ে সেই ধারাকে সফল ভাবে বাঙালি চিত্তচেতনায় প্রোথিত করে দিয়েছিলেন। আর বিংশ শতাব্দীতে এসে স্বামী কৃষ্ণানন্দও সেই ধারাকে আরও সমৃদ্ধ করেছিলেন।

এবার আসা যাক দেবী কালিকার আর এক রূপের এক প্রচলিত কথকতায়। অতীত থেকেই ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে রামায়ণের বিভিন্ন সংস্করণ চালু রয়েছে। এগুলোর সাথে মহর্ষি বাল্মীকির রামায়ণের মিলের থেকে অমিল বেশি লক্ষ্ণীয়। কিন্তু অঞ্চলভেদে এসব রামায়ণ কাহিনি ভীষণ জনপ্রিয়। ঠিক যেমন কৃত্তিবাসী রামায়ণ বাংলায় জনপ্রিয় তেমন। আশ্চর্যের বিষয় হল যে, এর মধ্যে কিছু আঞ্চলিক রামায়ণে রামচন্দ্রকে রাবণ বধের কৃতিত্ব না দিয়ে সীতাকে দেওয়া হয়েছে বলে দেখা যায়। সেটাও আবার বাল্মীকির একমাথার রাবণ বা কৃত্তিবাসের দশমাথার রাবণ নয়, একেবারে সহস্রশীর রাবণ! অতীতে শূরবীর সিংহ ফতেহপুর জেলার একটি গ্রামে ‘জানকী বিজয়’ নামের একটি ছোট হিন্দি পুঁথি আবিষ্কার করেছিলেন; তাতে সীতাদ্বারা শ্বেত দ্বীপের অধিপতি সহস্রশীর্ষ রাবণের বধের কাহিনি পাওয়া যায়।

তবে এর থেকেও আশ্চর্যজনক বিষয় পাওয়া যায় বিভিন্ন রামায়ণ-গীতে। এগুলোও বহু প্রাচীনকাল থেকেই ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে চালু রয়েছে। বিশেষত উত্তরপ্রদেশের ব্রজ-অঞ্চলে (মথুরা-বৃন্দাবন এবং পারিপার্শ্বিক অঞ্চলে) যেসব লৌকিক রামায়ণ-গীত বর্তমানকালেও প্রচলিত রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে একটি মজার কাহিনি দেখতে পাওয়া যায়। সীতাকে নিয়ে রামচন্দ্র অযোধ্যায় ফিরে আসবার পরে, সীতা রামচন্দ্রকে জানিয়েছিলেন যে, রামচন্দ্র তো ‘রমনিয়া’কে হত্যা করেছেন, তিনি রাবণকে বধ করতে পারেননি। কারণ, রাবণ লঙ্কায় থাকেন না, তিনি ‘পলঙ্কা’য় থাকেন, তাঁর সহস্র শির এবং দ্বিসহস্র বাহু। একথা শুনে ভরত রামচন্দ্রকে বলেছিলেন, ‘তুমি এখন অযোধ্যার সিংহাসনে বসো, আমি গিয়ে সেই রাবণকে বধ করে আসছি।’

তারপরে ভরত সৈন্য-সামন্ত নিয়ে লঙ্কার দিকে রওনা দিয়েছিলেন; কিন্তু ‘নাকাসুর’ তাঁদের অযোধ্যায় ফিরিয়ে এনে আটকে রেখেছিলেন। তখন সীতা নিজেই অগ্রবর্তী হয়ে পলঙ্কায় গিয়ে রাবণকে গিলে খেয়ে ফেলেছিলেন, এবং সেখান থেকে তিনি আর অযোধ্যায় ফিরে আসেননি, সোজা কলকাতায় এসে ‘কালী মাই’ হয়ে গিয়েছিলেন। এরপরে নারদ কলকাতায় এসে তাঁকে অযোধ্যায় ফিরে যাওয়ার জন্য অনেক প্রার্থনা করেছিলেন, কিন্তু সীতা কিছুতেই রাজি হননি, তিনি কালী মাই হয়ে কলকাতাতেই থেকে গিয়েছিলেন। এর সপক্ষে একটি প্রচলিত প্রাচীন গীত এই রকম—

“কিশ্ন অগারী পরি রহে পেস এক না খাই

সবরে জোধা চলি দএ সর্বুলীনে বান উঠাই

পহুঁচী গয়ে কলকাত্তা মে, তৌ মাতা মংদির পহুঁচী জাই।

মংদির পহুঁচী জাই পাস নারা তব জাগৌ

নারহু চরণ পর্যৌ ভৈরাই বাত অপনী ঠহরায়ৌ

মাতা তৌ ন্যোঁ কহৈ সুনিলৈ জননী বাত

হমতে তূ তৌ কহা কহঁতি ঐ চলৌ হমারে সাথ।

সব চলিবে কী নাঁই অবঊ মতি আস লগায়ৌ

সবু দলু তুম ভগি জাউ পাস মতি মেরে আয়ৌ

বার বার তুমতে কহুঁ বচন কহুঁ সমঝাই

কলকত্তা কী কালী বনি গঈ সবরে ঘার কূ জাই।”

জনকনন্দিনী রামজায়া সীতা কলকাতার কালীঘাটে এসে কালীমাই হয়ে গিয়েছিলেন, এমন কাহিনি কিন্তু রীতিমত দুর্লভ। এ যেন একেবারে উলোটপুরাণ! কারণ, পৌরাণিক মতে— কালীর সঙ্গে দুর্গা বা পার্বতীর একটা সমীকরণ করা চলে, কিন্তু সীতার সঙ্গে কোনো ভাবেই সেটা করা চলে না; বরং চরিত্র অনুযায়ী সীতা লক্ষ্মীর সঙ্গে সম্পর্কিতা। আর লক্ষ্মী অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত বিষ্ণুর সঙ্গে। এবার আমরা জানি, রামচন্দ্র বিষ্ণুর অবতার। অন্যদিকে কালী-দুর্গা-পার্বতী শিবের সঙ্গে যুক্ত। তাই এই কাহিনিকে বৈষ্ণব ও শৈবদের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের একটা প্রচেষ্টা বলা যেতে পারে। আরও লক্ষ করবার বিষয় হল যে, এতে রাম সীতাকে পরিত্যাগ করেননি, উল্টে সীতা রামকে পরিত্যাগ করেছিলেন। 

বর্তমানে তন্ত্রের দেবদেবীদের মধ্যে ভারতের পূর্বাঞ্চলে, বিশেষ করে বাংলায় যিনি সর্বাপেক্ষা জীবন্ত ও ভয়ঙ্কর হয়েও নিতান্ত আপনজন বলে গণ্য হন, তিনি হলেন দেবী কালিকা। কলকাতার কালীঘাটের কালী ভারতবিখ্যাত দেবী। রক্ষাকর্ত্রীরূপে তাঁর মাহাত্ম্য অতুলনীয়। সারা ভারতবর্ষে এমন কোনো জায়গা নেই যেখান থেকে তীর্থযাত্রীরা কালীঘাটে গিয়ে কালীদর্শন করে তাঁর কাছে নিজের নিজের প্রার্থনা জানান না। সিদ্ধপুরুষ শ্রীশ্রীপরমহংসদেবের ইষ্টদেবী দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী কালীও বহুবিশ্রুত।

ইতিহাস কালী সমতকে বৌদ্ধদের যে ধারণার কথা উল্লেখ করেছে, সেখানে কিন্তু আমদের প্রচলিত বিশ্বাস ও পুরঙ্কথা গৌণ হয়ে পড়ছে। সেখানে বলা হচ্ছে দেবী কালিকার প্রথম পরিকল্পনা নাকি বৌদ্ধদের ছিল, এবং সেটি নাকি ভারতবর্ষের আদিবাসীদের মধ্যে থেকে শুরু হয়েছিল। যদিও এবিষয়টি নিয়ে আজও ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতদ্বৈধ রয়েছে। তবে একথা স্পষ্ট, মা কালী কোনো হিন্দুর ঘরে জন্মাননি, সেই তথ্য স্পষ্ট। কারণ, দেবী কালিকা মার্কণ্ডেয় পুরাণোক্ত চণ্ডীরই রোষ-সংস্করণ, অর্থাৎ— তিনি চণ্ডীদেবীর ক্রোধজাত নবরূপা। কিন্তু চণ্ডীদেবী নিজেই তো বিন্ধ্যবাসিনী শবরী, অর্থাৎ— ভারতবর্ষের আদিবাসী শবর জাতির ইষ্টদেবী। মহাযানী বৌদ্ধেরা স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে, শবরীকে তাঁরা শবরদের গৃহেই পেয়েছিলেন। বৌদ্ধদের দাবি এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। কারণ অশ্বঘোষ লিখিত ঐতিহাসিক প্রামাণিক পুঁথি ‘বুদ্ধচরিত’ থেকে  অশ্বঘোষের কাল ছিল খৃষ্টীয় প্রথম শতক, অর্থাৎ— বুদ্ধদেবের তিরোধানের পাঁচ বা ছ’শো বছর পরে। এই পুঁথিটি চীনা ভাষাতেও অনূদিত হয়েছিল। সেই অনুবাদে যে তথ্য পাওয়া যায়, তা থেকে একথাই মনে হয় যে, ভগবান বুদ্ধেরও কালী-দর্শন ঘটেছিল, তবে এখানে তাঁর কার্যকলাপ ছিল একটু অন্য রকমের। বুদ্ধের কালীদর্শনের যে চিত্রটি পাওয়া যায়, সেটি হল— বোধিদ্রুমের নিচে ভগবান বুদ্ধ ধ্যানে নির্বাণ বা বুদ্ধত্বলাভের জন্য বসেছিলেন। তাঁকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করবার জন্য এসেছিলেন ‘মার’, অর্থাৎ— যে দেবতা এসব কাজে পটু ছিলেন (‘মার’-এর আভিধানিক অর্থ কামদেবও বটে)। তিনি নিজের সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন একজন নারীকে; তাঁর নাম হল ‘মা-কিয়া-কালী’ (হয়তো মেঘকালী বা মহাকালী); মহাকালীর হাতে ছিল ‘খর্পর’, অর্থাৎ— মাথার খুলি। তিনি এসে বোধিসত্ত্বের ঠিক সম্মুখে দাঁড়িয়েছিলেন; তারপরে নানা ছলাকলা দিয়ে তাঁকে কামমোহিত করবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এই চেষ্টা নিষ্ফল হতেই মার তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের ত্রিশূলাদি দিয়ে বোধিসত্ত্বকে আক্রমণ করবার অনুমতি দিয়েছিলেন। অর্থাৎ— মহাকালীর কার্যকলাপ এখানে স্বর্গের অপ্সরা ঊর্বশী, মেনকা, রম্ভা প্রমুখের পর্যায়ের ছিল।

যাই হোক, এই কাহিননি থেকে বিদ্বজ্জনেরা অনুমান করেন যে, ত্রিশূলধারী শিব ও খর্পরধারিণী শিবশক্তি বা কালী অশ্বঘোষের কালেও সুপরিচিত ছিলেন। বৌদ্ধতন্ত্রই হয়তো কালীকে তাঁর স্থায়ী আসন দিয়েছে। বৌদ্ধদের হাতে পড়ে, মহাকালী বা কালীই প্রথমে তারা রূপ পরিগ্রহ করেছিলেন; আর পরে শাক্তদের দলে ভিড়ে তারা হয়েছিলেন ‘ব্রহ্মময়ী’।

 

 


শ্রেষ্ঠা সিনহা

 

শ্রীশম্ভু মিত্র : সমকাল থেকে নাট্যচর্চা

 


 

ভূমিকা

অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে ঔপনিবেশিক কলকাতায় থিয়েটারের ঐতিহ্যে লালিত ইংরেজ শাসক ইংল্যান্ডীয় মডেলে থিয়েটার হল এবং প্রসেনিয়াম মঞ্চ তৈরি করে। ধীরে ধীরে কলকাতা সহ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন অঞ্চলে থিয়েটার হল গড়ে ওঠে। এই বিদেশি রঙ্গালয়ে নাট্যাভিনয় এবং মঞ্চ উপস্থাপনাগত নানান কৌশলের দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে তৎকালীন উচ্চবিত্ত বাঙালি সমাজ নিজেদের বাড়ির প্রাঙ্গণে ‘সৌখিন নাট্যশালা’র প্রবর্তন করেতবে জনসাধারণের প্রবেশাধিকার সেখানে ছিল না। পরবর্তীসময়ে ধনী বাঙালির সীমানা অতিক্রম করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির চেষ্টায় সমগ্র জনসাধারণের জন্য সাধারণ রঙ্গালয় স্থাপিত হয়।

গিরিশচন্দ্র ঘোষের সান্নিধ্যে লালিত সাধারণ রঙ্গালয় পৌরাণিক ও ভক্তিরসের আবিলতায় দর্শকের নাট্যপিপাসা নিবারণ করে। অন্যদিকে এর সমান্তরালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে ‘রূপক বা ব্যঞ্জনাধর্মী’  নাটকের সমান্তরাল ধারা প্রবাহিত হতে থাকে। “সেই ধারা পরবর্তী বাংলা নাট্য আন্দোলনের বহুমুখী প্রচেষ্টার মধ্যে এক উজ্জ্বল দিক নির্দেশের কাজ করেছে।” কিন্তু  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং তার পরবর্তী আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি বাঙালি জনজীবনের পাশাপাশি বাংলা নাট্যশালাকেও প্রবাহিত করে। অন্যদিকে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, মন্বন্তর এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বিধস্ত জনগণের অসহায়ত অবস্থা নাটকের মাধ্যমে তুলে ধরেন একদল নাট্যমোদী মানুষ।

১৯৪৩  খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ‘ভারতীয় গণনাট্য সংঘ’ নাটকের মাধ্যমে বিজন ভট্টাচার্য, দিগিন্দ্রচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় প্রমুখরা ফ্যাসিস্ত শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামিল হনকিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন মতভেদের দরুণ একদল মানুষ গণনাট্য সংঘ পরিত্যাগ করেন। হেনকালে শম্ভু মিত্রের নেতৃত্বে  বাংলায় ‘নবনাট্য আন্দোলন’ সূচিত হয়। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘বহুরূপী’ নাট্যদলের মাধ্যমে গ্রুপ থিয়েটার  ধারাও অনুবর্তন ঘটে।

স্বাধীনতা পূর্ববতী সময়েই তিনি বাংলা রঙ্গমঞ্চের সংস্পর্শে আসেন। ফলত সাধারণ রঙ্গালয়, গণনাট্য আন্দোলন এবং নবনাট্য ধারার মাধ্যমে তাঁর প্রভিতা বিকশিত হয়। তিনি একাধারে নট, নাট্যকার, নাটককার এবং নাট্যবিশ্লেষক। “গত প্রায় দেড়শো বছরের বাঙালি থিয়েটারে এর আগের দুটি যুগ ‘গিরিশ যুগ’ ও ‘শিশির যুগ’ বলে অভিহিত করা হয়, তবে গত শতকের দ্বিতীয় অর্ধের যে ৩০/৪০ বছরের গণনাট্য থেকে নবনাট্যের উদ্ভব হয়ে তা পৌঁছে গেল দল-নাট্য বা গ্রুপ থিয়েটারের ধারায়, সেই সময়-পর্বকেও ইতিহাস শম্ভু মিত্রের শিরোনামে চিনতে চাইবে আগামীদিনে।”

আলোচ্য অংশে বাংলা নাট্যসাহিত্য ও নাট্যমঞ্চের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী শ্রী শম্ভু মিত্রের নাট্যানুরাগ থেকে তাঁর সমকালীন পরিস্থিতি এবং সর্বোপরি বাংলা থিয়েটারের বাঁকবদলের ইতিকথা সংক্ষিপ্ততার মাধ্যমে পরিবেশিত হয়েছেপ্রসঙ্গক্রমে আলচিত হয়েছে নাটককে নবতম করার প্রয়াসী শ্রী মিত্রের মঞ্চভাবনা থেকে শুরু করে তাঁর নাট্যভাবনার বিষয়গুলি।

 

শম্ভু মিত্রের নাট্যানুরাগ

বাংলা নাট্যসাহিত্যে এক বিস্ময়কর প্রতিভা শম্ভু মিত্র। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে ২২ অগাস্ট দক্ষিণ কলকাতার ডোভার লেনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শরৎকুমার মিত্র এবং মাতা  শতদলবাসিনী দেবী। ভবানীপুর স্কুলে বাল্যশিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি বালিগঞ্জ গর্ভমেণ্ট হাইস্কুলে ভর্তি হন। অষ্টমশ্রেণিতে পাঠরত অবস্থায় শ্রী মিত্র প্রথম নাট্যাভিনয় শুরু করেন। এইসময় তিনি  সহপাঠীদের সঙ্গে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘রানাপ্রতাপাদিত্য’ নামক ঐতিহাসিক নাটকটি অভিনয় করেন। শৈশব থেকেই তিনি নাটকের প্রতি অনুরাগী ছিলেন, তাঁর জবানিতে, “কেন যে আমি  অভিনয় করতে শুরু করলুম সে বলা আমার পক্ষে খুব শক্ত। কিন্তু হয়েছিল একটা ইচ্ছে-ছোটবেলা থেকেই অভিনয় করার। কেমন করে জানিনা, অভিনয় খুব ভালো লাগত।”

পরবর্তীকালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। এই সময় থেকেই প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য-এর নাটক এবং নাট্যব্যক্তিত্বদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে নাট্যচর্চা শুরু করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য শম্ভু মিত্র কৈশোরেই কৃষ্ণগোবিন্দ সরকার মহাশয়ের কাছে প্রথম অভিনয় শিক্ষায় হাতেখড়ি দেন। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে পারিবারিক কারণে তিনি এলাহাবাদ যানসেখানে নাট্যচর্চার পাশাপাশি সমাজবিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে চর্চা শুরু করেন।  তিনবছর পর কলকাতায় এসে তাঁর গৃহশিক্ষকের সূত্রে প্রখ্যাত নট ভূপেন রায়ের সঙ্গে পরিচয় হয়  শম্ভু মিত্রের। তাঁর হাত ধরেই শম্ভু মিত্র প্রথম ‘রঙমহল’ থিয়েটারে পর্দাপণ করেন মাত্র ২৪ বছর বয়সে। যদিও মঞ্চে তাঁর প্রথম আর্বিভাব ঘটে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ৯ সেপ্টেম্বর বিধায়ক ভট্টাচার্যের ‘মাটির ঘর’ নাটকের মাধ্যমেএখানে নাট্যভিনয়ের সূত্রে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের।

পরবর্তী সময়ে তিনি মির্নাভা থিয়েটারে ‘জয়ন্তী’ নাটকে নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেন। এরপর বেশ কিছুদিন তিনি ‘নাট্যনিকেতন’ কাজ করেন প্রতিষ্ঠানটি শিশির কুমার ভাদুড়ির নেতৃত্বে ‘শ্রীরঙ্গম’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এখানে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করে শম্ভু মিত্র যুক্ত হন কালিপ্রসাদ ঘোষের ‘ভ্রাম্যমাণ নাট্যদল’-একিন্তু সেখানেও বেশিদিন যুক্ত থাকতে পারেননি তিনি।

সাধারণ রঙ্গালয়ের নাট্যাভিনয় করাকালীন সময়ে শ্রী মিত্র বিশেষ উল্লেখযোগ্য চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পাননি। ফলে কোথাও তাঁর প্রতিভার পরিস্ফুরণ যথাযথ ভাবে বাংলা সাধারণ রঙ্গমঞ্চে প্রতিফলিত হয়নি। কিন্তু এই সময় অভিনয়ের সূত্রে “অহীন্দ্র চৌধুরি, নির্মলেন্দু লাহিড়ী, দুর্গাদাস বন্দোপাধ্যায়, যোগেশ চৌধুরি, নরেশ মিত্র, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য প্রমুখ সেকালের বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্বের সাহচর্যের সুযোগে নাট্যাভিনয়, প্রযোজনা-পরিচালনা সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলি পূর্ণ হয়ে ওঠে”—যা তাঁকে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা নাট্যমঞ্চের উজ্জল প্রতিভা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত  করতে সহায়তা করে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বাংলা নাট্যাভিনয়ে সমকালীন সমাজ-রাজনীতির পাশাপাশি গান্ধিজীর জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রভাব লক্ষ করা যায়। এছাড়া রাশিয়ায় উদ্ভূত সাম্যবাদী আন্দোলনের প্রতিচ্ছবিও ধরা পড়ে। কিন্তু বাংলা রঙমঞ্চে সর্বাধিক প্রভাব বিস্তার করে ২য় বিশ্বযুদ্ধ। ফ্যাসিবাদি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ১৯৪৩ সালে ‘ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই  সংগঠন কলকাতা কেন্দ্রিক নাট্য ব্যবস্থার পরিবর্তে গ্রাম-গ্রামান্তরে নাটক মঞ্চস্থ করতে শুরু করল।  মঞ্চসজ্জা, অভিনয় থেকে শুরু করে চরিত্র চিত্রণে প্রসেনিয়াম থিয়েটার থেকে বেরিয়ে প্রান্তিক জনজীবনের কাছে নাটককে হাজির করল গণনাট্য সংঘ। এইসময় শম্ভু মিত্র নাট্যাভিনয়ের তাগিদে এই সংগঠনে যোগদান করেন।

“শম্ভু মিত্র নাট্যাভিনয়ের সূচনা থেকে,-- মঞ্চের পাদপ্রদীপের সামনে আসার পর থেকে, ক্রমাগত দল ছেড়েছেন, আবার নতুন দল ধরেছেন,--তাঁর অতৃপ্তি তাঁকে অনবরত তাড়িয়ে বেরিয়েছে—হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোনোখানে, অন্য কোনো পথ ধরার বার্তা শুনিয়েছে। আর তা শুনিয়েছে সেদিনের দুই বিশিষ্ট প্রগতিবাদী বুদ্ধিজীবী বিনয় ঘোষ ও বিজন ভট্টাচার্য,--যাঁদের প্রণোদনায় ফ্যাসিবিরোধী লেখক শিল্পী সঙ্ঘের সাংস্কৃতিক শাখা ‘ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ’- শম্ভুবাবু যোগ দিলেন।’’ আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাত জনমানসে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল।  তারই সমান্তরালে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, মন্বন্তর, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং দেশ বিভাগের মত ঘটনা বাঙালির জীবনে আর্থ-সামাজিক সংকট সৃষ্টি করে। এই সময় শম্ভু মিত্র বিজন ভট্টাচার্য প্রণীত ‘নবান্ন’ নাটকের মঞ্চ উপস্থাপনা এবং পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তী সময়ে বিজন ভট্টাচার্যের ‘আগুন’ এবং বিনয় ঘোষের ‘ল্যাবরেটরি’ নাটকদুটি পরিচালনার ভার তাঁর ওপর ন্যস্ত হয়। বিনয় ঘোষ তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, “শম্ভু যেমন প্রাণ খুলে হাসতে পারে, তেমনই কারও কান্না দেখে, আকাশের দিকে চেয়ে কবিতা ও আবৃত্তি করতে পারে। সবই তাঁর কাছে ‘ফ্যাক্ট’, হাসিটাও ‘ফ্যাক্ট’, কান্নাটাও ‘ফ্যাক্ট’, বেঁচে থাকাও ‘ফ্যাক্ট’, মরে যাওয়াও  ‘ফ্যাক্ট’, মধ্যে আর কিছু নেই। খাঁটি ইন্টালেকচ্যুয়ালের একটা ‘সোসিওলজিক্যাল মডেল’ শম্ভু।”

‘নবান্ন’, ‘জবানবন্দী কিংবা ‘ল্যাবরেটরি’ ইত্যাদি নাটক একদিকে যেমন গণনাট্য সঙ্ঘের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করে অন্যদিকে শম্ভু মিত্রকে বাংলা নাট্যসাহিত্য এবং রঙ্গমঞ্চে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করে। কিন্তু দেশবিভাগ পরবর্তী পটভূমিতে সঙ্ঘের কর্মীদের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি হয়। আসলে কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে বিশ্বাসী গণনাট্য সঙ্ঘের বেশিরভাগ কর্মীরা সমাজের মেহনতি মানুষের লড়াই এবং তাদের ঐক্যবদ্ধ করে সমাজ পরিবর্তের আশায় নাটককে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে শুরু করলেন। সেখানে বিষয়বস্তু প্রাসঙ্গিক হলেও প্রযোজনার কোনোরকম বাহুল্য ছিল না। এছাড়া সংলাপের বিদগ্ধতাও সেখানে লক্ষ করা যায় না।

ফলত নাটককে নবতর করার প্রয়াসে শম্ভু মিত্র, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য সহ একদল মানুষ গণনাট্য সংঘ থেকে বেরিয়ে আসেন। হেনকালে শম্ভু মিত্রের পরিচালনায় এবং কলিম শরাফির সহপরিচালনায় ‘অশোক মজুমদার ও নাট্য সম্প্রদায়’ নামে একটি নাট্যগোষ্ঠী গড়ে ওঠে। এই পেশাদারি নাট্যসম্প্রদায়ের মাধ্যমে বাংলায় নবনাট্য আন্দোলনের সঞ্চারিত হয় এবং অগ্রণীরূপে শম্ভু মিত্র অতুলনীয় ভূমিকা পালন করেন। গণনাট্যে কেবলমাত্র মেহনতি মানুষের সংগ্রামের কথা প্রতিফলিত হয়েছে, কিন্তু নবনাট্যে সমকালীন সমাজপরিস্থিতি নাটকের মাধ্যমে তুলে ধরা হল। গণনাট্যে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার স্থান ছিল না সেখানে জনগণই প্রধান। কিন্তু নবনাট্যের সূচনা থেকেই মধ্যবিত্ত মানসিকতা অর্থাৎ ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা বিষয়টি লক্ষ করা যায়। এছাড়া দেশীয় ক্ল্যাসিকাল নাটক এবং বিদেশি নাটক অনুবাদের মাধ্যমে মঞ্চস্থ করা হল। তাই অতি অল্পসময়েই শম্ভু মিত্রের এই নাট্য আন্দোলন শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী মানুষের কাছে সমাদৃত হল

১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ১ মে ‘অশোক মজুমদার ও নাট্য সম্প্রদায়’ ‘বহুরূপী’ নামে নামান্তরিত হয়আর এই ‘বহুরূপী’-র মাধ্যমে নাট্যক্ষেত্রে প্রথম যথার্থ ‘গ্রুপ থিয়েটার’-এর প্রবর্তন হয়। “এখানে শম্ভু মিত্র একাধারে নাট্যকার-নাট্যরূপদাতা-নির্দেশক-প্রযোজনা-অভিনেতা এবং এককথায় তিনিই হলেন বহুরূপীর প্রাণপুরুষ বিশুদ্ধ শিল্পসম্মতভাবে নাটক উপস্থাপনা এবং তার মধ্যে  দিয়ে মহত্তর জীবন গঠনের প্রয়াসে শম্ভু মিত্র এবং বহুরূপীর পথচলার শুরু হয়

 

মঞ্চভাবনা

 স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা রঙ্গমঞ্চে একধরনের পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। একদিকে শিথিলভাবে প্রবাহিত হতে থাকে গণনাট্য ধারা, অন্যদিকে বাংলা সাধারণ নাট্যালয়ে অবক্ষয়ী মনোভাব এবং অপসংস্কৃতির প্রসারণ দেখা যায়। এই সময় শম্ভু মিত্রের নেতৃত্বাধীন ‘বহুরূপী’ বা ‘গ্রুপ থিয়েটার’ ধারা পেশাদার রঙ্গশালায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ১২ অগাস্ট শম্ভু মিত্র শ্রী সঞ্জীব ছদ্মনামে ‘উলুখাগড়া’ নাটকটি রচনা করেন। তাঁর নির্দেশনায় এই নাটকটি ই. বি. আর. ম্যানসন ইনস্টিটিউটে মঞ্চস্থ হয়। তিনি এই নাটকে সিনিক যুবক বিনোদের চরিত্রে অভিনয়ও করেন‘উলুখাগড়া’ তিনটি অঙ্ক তিনটি দৃশ্য যুক্ত নাটক। এই নাটকের মাধ্যমে শ্রী মিত্র নিম্নবিত্ত সমাজের প্রতি উচ্চবিত্তদের শোষণ-শাসনের বাস্তবধর্মী রূপটি তুলে ধরেছেন। এই সমাজে ‘উলুখাগড়া’ হল করুণাদেবীর মত অতি সাধারণ শ্রেণির মানুষ। যারা দেবব্রত কিংবা পঞ্চাননবাবুদের অত্যাচারের নাগপাশে জীবন অতিবাহিত করে। তবে এই নাটকটিকে সম্পূর্ণভাবে শ্রেণিসংগ্রাম ভিত্তিক নাটক বলা চলে না। দেবব্রত মিত্র চরিত্রটি এখানে নব্য সামন্ততন্ত্রের প্রতিভূ। অন্যদিকে পুরানো সামন্ততন্ত্রের প্রতীক পঞ্চানন বাঁড়ুজ্যে।

আবার এই নাটকটির প্রেক্ষাপটে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের রাজনৈতিক চিত্রও প্রতিফলিত হয়েছে। ইংরেজ শাসকের অত্যাচারের প্রতিবাদে গান্ধিজীর নেতৃত্বে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন সূচিত হয়অন্যদিকে তৎকালীন সময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারত শাসকের প্রতিপক্ষ ছিল জাপান। ফলত যুদ্ধের সমগ্র ব্যয়ভার ভারতবাসীর থেকে শাসক আদায় করে। ফলশ্রুতিতে জাপান ভারতবর্ষের বিভিন্ন অংশে বোমা বর্ষণ করে। ভারত যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেও ইংল্যান্ড এবং  জাপানের মধ্যে ‘উলুখাগড়া’য় পরিণত হয়। শম্ভু মিত্রের মুন্সীয়ানায় ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক দিকটিও প্রতিফলিত হয়েছে

তাঁর নির্দেশনা এবং  আভিনয়িক ক্ষেত্র সম্পর্কে নাট্যকার এবং সমালোচক শচীন সেনগুপ্ত মন্তব্য করেছেন, “পরিচালনা ও অভিনয়ে তিনি রসানুভূতি এবং রস সঞ্চারে শক্তির পরিচয় দিয়াছেন। বিনোদনের প্রগলভতা যেমন লঘু ছন্দে ব্যক্ত করে তিনি মনোরঞ্জন করেছেন, তেমনি মর্মাহত বিনোদনের মনের গভীরতম স্তরের কঠোর অনুভূতিকেও অভিনয়ের দ্বারা হৃদয়াগ্রাহী করেছেন।”

উক্ত সময়কালে রচিত ‘ঘূর্ণি’ নাটকটি উল্লেখযোগ্য। ১২৭৩ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে ‘ঘূর্ণি’ নাটকটি প্রকাশিত হয়েছিল। এটিও তিন অঙ্ক বিশিষ্ট নাটকতবে মঞ্চ উপস্থাপনায় অভিনবত্ব লক্ষ করা যায়। ‘ঘূর্ণি’-র সূচনা হয়েছে দেবন্দ্র মুখুজ্জ্যের প্রেস বিক্রি হয়ে যাওয়ার কাহিনি নিয়ে। তিনি ব্যবসায় অসদুপায় এবং আধুনিক পন্থা আনয়ন করতে না পারায় মন্দাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। হেনকালে  অবিনাশ দেবেনবাবুর পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তার ব্যবসা হস্তগত করে এবং সেখানে অসৎ উপায় অবলম্বন করে। মূল্যবোধের অবক্ষয় কীভাবে সমাজ-জীবনকে প্রভাবিত করেছিল অবিনাশ, সমীর, খুকু এই চরিত্রগুলির মাধ্যমে এখানে তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া বিকাশ চরিত্রটির মাধ্যমে তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটি প্রতিফলিত হয়েছে। নাট্যকার গণনাট্য সংঘ পরিত্যাগ করেছিলেন তবে তার আদর্শ থেকে কখনোই সরে আসেননি। আর তাই সমাজবিপ্লবের দ্বারাই সামাজিক শোষণ থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব এই বার্তাটি নাটকে ফুটে উঠেছে।

এই নাটকের প্রথম অঙ্কে দুটি দৃশ্য রয়েছে, যা সময়ান্তর বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। প্রথম অঙ্কের স্থান দেবেন্দ্রবাবুর বসার ঘর এবং দ্বিতীয় অঙ্কটি পার্কে সূচিত হয়েছে। তারই মধ্যে আবার দেখা যায় বিকাশ এবং অবিনাশের স্বতন্ত্র অংশের প্রতিফলন এবং নির্দেশনার আবহে আবার দৃশ্যটি পার্কে ফিরে আসে। আবার তৃতীয় অঙ্কে একটি পুরনো নবাবী আমলে নাট্যকার দর্শককে উপস্থিত করেন। অনেকটা ‘চার অধ্যায়’ নাটকের মঞ্চভাবনা পরিলক্ষিত হয় ‘ঘূর্ণি’ নাটকে।

‘বিভাব’ নাটক রচনা এবং পরিবেশনায় শম্ভু মিত্রের মুন্সীয়ানা প্রতিভাত হয়। এই নাটকটি প্রথম অভিনীত হয়  ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের ২০ এপ্রিল, লোয়ার সার্কুলার রোডে অবস্থিত সুধাংশু গুপ্তের  বাড়িতে। পরবর্তীকালে বিভিন্ন রঙ্গমঞ্চে নাটকটি অভিনীত হয়‘বিভাব’ নাটকটি আয়তনে ক্ষুদ্র হলেও আঙ্গিকগত এবং উপস্থাপনাগত দিক থেকে অভিনব। আচার্য্য ভরত প্রণীত ‘নাট্যশাস্ত্র’ অনুসারে নাট্যকার নাটকের নামকরণ করেন শম্ভু মিত্র ‘নাট্যশাস্ত্র’ অনুসারে রতি-ভাব সর্বদা  প্রকটভাবে অবস্থান করে না; তাই যে হেতু রতি ভাব প্রচ্ছন্ন অবস্থায় জাগ্রত থাকে  তাকে বলা হয় বিভাব। তৎকালীন আর্থ-সামাজিক অপ্রতুলতার প্রেক্ষাপটে তাই শম্ভু মিত্র তাঁর নাটকের নামকরণ করেন ‘বিভাব’। এই প্রসঙ্গে নাট্যকারের অভিমত, “আমাদের মনে হয় এর নাম হওয়া উচিত ‘অভাব নাটক’। কারণ দুরন্ত অভাব থেকেই এর জন্ম। আমদের একটা ভালো স্টেজ নেই। সিন্‌সিনারী, আলো, ঝালর কিছুই আমাদের নিজেদের নেই। সঙ্গে থাকবার মধ্যে আছে কেবল নাটক করবার বোকামিটুকু।” পাশাপাশি তাঁর এই বক্তব্যে তৎকালীন গ্রুপ থিয়েটার এবং বাংলা  রঙ্গমঞ্চের নানান সমস্যার কথাও প্রতিভাত হয়। সেই প্রেক্ষিতে ‘বিভাব’-এর মঞ্চায়ন বাংলা  নাট্যসাহিত্য ও নাট্যশালার ইতিহাসে একটি বৈপ্লবিক প্রচেষ্ঠা বলা চলে।

জাপানে প্রচলিত ‘কাবুকি’ থিয়েটারের ধাঁচে ‘বিভাব’ মঞ্চস্থ হয়। এই থিয়েটারে মঞ্চসজ্জা কিংবা সিন্‌সিনারী, আলোকসজ্জা, অভিনয়ে ব্যবহৃত আধুনিক সাজসরঞ্জাম কিংবা সাজসজ্জা-পোশাক পরিচ্ছদের দরকার হয় না। অভিনেতারা কেবলমাত্র শারীরিক অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে নাটকটি অভিনয় করেন এবং দর্শকগোষ্ঠী তাদের কল্পনারসে জারিত করে নাট্যরস আস্বাদন করে। এই নাটকের প্রধান তিনজন চরিত্র হল ‘শম্ভু দা’(শম্ভু মিত্র), ‘বৌদি’(তৃপ্তি মিত্র) এবং ‘অমর’(অমর গাঙ্গুলি)। ত্রয়ী চরিত্র শূন্য মঞ্চের ওপর কেবলমাত্র অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে “সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা,   জানলা-দরজা খোলা কিংবা বন্ধ করা, সোফায় কিংবা চেয়ারে আসন গ্রহণ করা, চা পান করা, দেশের সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনার ফাঁকে পুলিশের আগমনকে কেন্দ্র করে জানলা দিয়ে একতলায় লাফিয়ে পড়া অথবা রিক্সা-ট্রাম-বাসের ভিড় ঠেলে পালিয়ে যাওয়া, মিছিল সহ সঙ্গবদ্ধ জনতার অগ্রসর হওয়ার মত সকল বিষয়ই প্রতিফলিত করেছেন। “কলকাতার রাস্তা বোঝানোর জন্য এক একজন বাস- ট্যাক্সির ছবি আঁকা বোর্ড নিয়ে মঞ্চের একদিক থেকে অন্যদিকে চলে যাচ্ছে আর নেপথ্য থেকে বাস-ট্যাক্সির হর্ন দেওয়া হচ্ছে, কিংবা কেউ ট্রামের ছবি নিয়ে ট্রামের ছবি নিয়ে মুখে ট্রামের ঘণ্টির ‘ঠ্যাং ঠ্যাং’ আওয়াজ করতে করতে করতে সোজা চলে যাচ্ছে।”১০

চূড়ান্ত হাস্যরসের প্রচ্ছন্নতায় শম্ভু মিত্র দর্শকে কঠোর বাস্তবের সঙ্গে পরিচয় ঘটান নাটকের মধ্য দিয়ে। নাটকের অন্তিমলগ্নে চাল এবং কাপড়ের দাবিতে নিরস্ত্র জনতার ওপর পুলিশের নির্মমোচিত আক্রমণ নেমে আসে। ছত্রভঙ্গ জনতার মধ্যে থেকে ভেসে আসে কেবলমাত্র চাপা গোঙানির শব্দ। হেনকালে দর্শকদের উদ্দেশ্য করে অমরের প্রতি শম্ভু মিত্রের উক্তি সমগ্র সমাজব্যবস্থা সহ রাষ্ট্রের প্রতি বীতশ্রদ্ধ মনোভাবকে প্রকাশ করে, “কী অমর – এবার হাসি পাচ্ছে? এবার নিশ্চয়ই লোকের খুব হাসি পাবে।”১১

‘বিভাব’ নাটকের অভিনয় প্রসঙ্গে অমৃতবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, “একাঙ্কটিকে প্রথম থেকে আমরা হাসি-তামাশার ব্যাপার বলেই মনে করেছিলাম। কিন্তু এর বিস্ময়কর পরিণতি যেন সপাৎ করে এক ঘা চাবুকের মতো এসে পড়ল সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর। চমকে উঠলাম। কেবল দৃশ্যটির পরিণতির জন্যে নয়, চমকে উঠলাম এর পরিবেশনার কায়দায় এবং অভিনয়ের নিতান্ত বৈঠকি আঙ্গিকের জন্য। মনে হল, সুযোগ পেলে এঁরাই নাট্যজগতে বিপ্লব ঘটাবার শক্তির প্রকৃত অধিকারী।”১২

 

নাট্যভাবনা

নবনাট্য আন্দোলনের সিংহভাগ জুড়েই অবস্থান করছেন শম্ভু মিত্র। তিনি কেবলমাত্র নট, নাট্যকার কিংবা নাটককারের বেষ্টনীতে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেনি। তিনি একাধারে চলচ্চিত্র অভিনেতা, নাট্যবিশ্লেষক এবং সর্বোপরি নাট্যবিষয়ক প্রাবন্ধিক। বাংলা নাট্যজগত এবং সেই জগতের  স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বের পাশাপাশি তাঁর নিজস্ব চিন্তা-ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে শ্রী মিত্রের কলমে।

মূলত তিনটি প্রবন্ধ সংকলনের মাধ্যমে বাংলা নাট্যজগতকে তিনি পরিপূর্ণতা দান করেছেন। এছাড়া ‘বহুরূপী’ নাট্যপত্রিকার বেশকিছু সংখ্যায় এই বিষয়ে তাঁর স্বাক্ষর লক্ষ করা যায়। শম্ভু মিত্র প্রণীত সেই গ্রন্থগুলি হল— ‘অভিনয় নাটক মঞ্চ’(১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে), ‘সন্মার্গ সর্পযা’(১৯১০   খ্রিস্টাব্দ দ্বিতীয় সংস্করণ), ‘কাকে বলে নাট্য কলা’(১৯১১ খ্রিস্টাব্দ)। আলোচনার সুবিধার্থে এখানে গ্রন্থগুলি থেকে নির্বাচিত একটি প্রবন্ধ অবলম্বনে শম্ভু মিত্রের  নাট্যভাবনা তুলে  ধরা হল—

 ক) অভিনয় নাটক মঞ্চ

এই গ্রন্থটি ১৩৬৪ বঙ্গাব্দের আশ্বিনে প্রকাশিত হয়। অনুমান করা যায় এই প্রবন্ধ সংকলনটি নাটক এবং নাট্যসম্বন্ধনীয় প্রথম রচনা। ‘অভিনয় নাটক মঞ্চ’ এই গ্রন্থটি দশটি প্রবন্ধ সংবলিত এই সংকলনের অর্ন্তগত অভিনয় কেন্দ্রিক রচনা হল দুটি হল ‘চরিত্র চিত্রণ : স্ট্যানিস্‌ল্যাভস্কি(অনুবাদিত) এবং ‘অভিনয় কী ?’। এছাড়া এই গ্রন্থে সংকলিত হয় তাঁর নাটক বিষয়ক প্রথম প্রবন্ধ ‘রক্তকরবী’। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে শম্ভু মিত্রের ‘সন্মার্গ সর্পযা’ এবং ‘প্রসঙ্গ নাট্য’ প্রবন্ধ সংকলনেও ‘রক্তকরবী’ নামাঙ্কিত রচনা থাকলেও তা সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী।

এই গ্রন্থ প্রাবন্ধিক মঞ্চসজ্জার অপরিহার্যতা, সেই সম্পর্কিত পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক নানা ভাবনা, অভিনয় শিক্ষা এবং সমাজে নাট্যশিল্পের প্রয়োজনীতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

‘প্রস্তাবনা’ শীর্ষক রচনাটি ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকায় ১৩৫৯ বঙ্গাব্দে ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকায় বৈশাখ থেকে আষাঢ় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। তবে প্রকাশকালে এর শিরোনাম ছিল ‘ নবনাট্য আন্দোলনের ভবিষ্যৎ’প্রাবন্ধিক এখানে জানিয়েছেন পঞ্চাশের মনন্তর পরবর্তী পর্যায়ে উত্তরণের জন্য জনসাধারণে ব্যাপক আলোড়ন লক্ষ করা যায়। একইভাবে শিল্পের ক্ষেত্রেও নব্যধারার প্রয়াস দেখা যায়। হেনকালে নবনাট্য আন্দোলনের সূচনা হয়। আর সেই পর্যায়েই বাঙালি শিক্ষিত জনসমাজ নাট্যাভিনয়ের ক্ষেত্রে গভীর অনুরাগ প্রকাশ করে। অভিনয় এবং প্রযোজনাগত দিক থেকে নানা ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও নতুন নাটক এবং মঞ্চ উপস্থাপনার রীতি বৈচিত্র্যের মাধ্যমে তা দর্শকদের মনোরঞ্জনে সহায়ক হয়। কিন্তু নাট্যসাহিত্যের প্রতি অবহেলার কারণেই বহু প্রকাশক নাটক প্রকাশিত করতে পিছুপা হন। প্রসঙ্গক্রমে শ্রী মিত্র তুলসী লাহিড়ীর ‘ছেঁড়া তার’ নাটকের কথা উল্লেখ করেনএই সময় প্রায় অধিকাংশ প্রকাশনী সংস্থা নাটকটি প্রকাশ করতে নিমরাজি ছিলেন অগত্যা বাধ্যহয়েই নাট্যকার স্বয়ং নাটকটি প্রকাশ করেনতার পরেও স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টি থেকে বিরত থাকেনি, “বরং ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে আত্মতৃপ্তির জন্যই তাঁরা শুধু নাটক রচনা করে গেছেন— এখানেই আমাদের গর্ব। কবি ও ঔপন্যাসিকরা মূলত ভবিষ্যতের জন্য সৃষ্টির জাল বোনেন। কিন্তু নাট্যকাররা তাঁর সমসাময়িককালের মানুষের জন্য পসরা সাজায়এই বুঝি লোকের বিভ্রান্তির সুযোগ নিচ্ছি। এই তাদের কুসংস্কারকে স্তোক দিয়ে নিজের কোলে ঝোল টানছি।”১৩

তিনি আরও বলেছেন তৎকালীন সময়ে যখন তাঁরা কোনো ‘সরাইখানায়’ উপস্থিত হয়ে নাটক মঞ্চস্থ করে দর্শকদের বিনোদনের চেষ্ঠা করেন তখনই তারা বলে ওঠেন—“বড্ড ইনটেলেকচুয়াল!’’১৪ আর এই সমালোচনাকেই পাথেয় করে পরবর্তীতে নাট্যকাররা নাটক রচনায়  ব্রতী হন বলে প্রাবন্ধিক অভিমত পোষণ করেছেন।

খ) সন্মার্গ সর্পযা

এই প্রবন্ধ সংকলনটিতে রয়েছে একটি দীর্ঘ সময়কালের সাপেক্ষে( ১৯৪৯-১৯৮৩) বাংলা নাটক, থিয়েটারে অভিনয়, নাট্যনির্মাণ এবং তার সংগঠন প্রসঙ্গে শম্ভু মিত্র মতামত তুলে ধরেছেন। বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক এই প্রবন্ধের মূলে আছে ‘মানুষ এবং সমাজ’।

এই গ্রন্থের অন্যতম একটি বিশেষত্ব হল—প্রাবন্ধিক সহজ সরল ভাষায় বিশ্লেষণাত্মক লেখনীর মাধ্যমে এবং নিজস্ব দৃষ্টিকোণের সাপেক্ষে নাট্যধারার বিবর্তনের ইতিহাস তুলে ধরেছেন।

‘সন্মার্গ সর্পযা’ সংকলনের অন্যতম একটি প্রবন্ধ হল ‘সমস্যার একটি দিক’ শীর্ষক রচনা। এটি ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এখানে প্রাবন্ধিক তৎকালীন সময়ে নাট্য আন্দোলনের ফলে যে সমস্যা দেখা দিয়েছিল সেটি পাঠকের সামনে প্রতিফলিত করেছেন। প্রায় দশ থেকে বারো বছর ধরে নবনাট্য আন্দোলনের গতিধারা প্রবাহিত হলেও তার গভীরতা ছিল স্বল্প। যার ফলে দর্শকদের মধ্যে এই আন্দোলনকে নিয়ে মতবিরোধ দেখা যায়। অন্যদিকে জনমানসে নবনাট্য ধারা সেইরকম আলোড়ন সৃষ্টিতে প্রায় ব্যর্থ হয়। তিনি আরো বলেন মানুষ তার জীবৎকালে নানা রকম ঘটনা এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জীবনের সত্যগুলি অনুধাবন করে। এই জীবনসত্য প্রকাশের মাধ্যম রূপে ব্যক্তি ভেদে কেউ কবিতা রচনা করে, কেউবা নাটক লেখে আবার কেউ তার অভিনয় করে। শম্ভু মিত্রের মতে যখন একজন মানুষ তার জীবনকে যথার্থভাবে উপলদ্ধি করতে সক্ষম হন, তখন তার সৃষ্টিতে প্রাণের স্পর্শ অনুভূত হয়। তাই নবনাট্য ধারায় বহু নাট্যকার এই ঘটনাকে বিষয়বস্তু করে নাটক রচনা করলেও তাদের রচনায় প্রাণের স্পর্শের অভাব লক্ষ করা যায়।

শম্ভু মিত্র তাই এই আন্দোলনের উন্নতির জন্য এমন একটি মঞ্চের কল্পনা করেছিলেন যেখানে কেবলমাত্র একটি বিশেষ নাট্যদলের অধীনস্থ হবে না, সেখানে সব নাট্যদলের সমান অধিকার থাকবে। তাই তিনি সমকালীন কলকাতার প্রায় সব নাট্যদলকে সম্মিলিত করে একটি অভিন্ন নাট্যমঞ্চ তৈরির কথা বলেছেন। এই প্রসঙ্গে তাঁর অভিমত, “এই মঞ্চ লাভের লোভে পরিচালনা করা হবে না, পরিচালিত হবে শিল্পোন্নতির আদর্শে।”১৫

গ) কাকে বলে নাট্যকলা

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘জলসাঘর’ বক্তৃতায় শম্ভু মিত্র ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জুন নাট্যকলা সম্পর্কে  তাঁর মতামত প্রদান করেন। সাহিত্য, সঙ্গীত, ভাস্কর্য, চিত্রকলা সহ অন্যান্য কলার মতন নাট্যকলাটিও একটি বিশেষ কলা। কিন্তু নাট্যকলাকে সেই স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত করা হয়। প্রাবন্ধিকের মতানুসারে একজন সাহিত্যিক কিংবা সঙ্গীতজ্ঞ যখন কোনো কিছু সৃষ্টি করেন তাঁর পিছনে সেই স্রষ্টার একটি উদ্দেশ্য নিবব্ধ থাকে। সেটি হল তারা তাদের লেখনী অথবা সুরের মারফত সরাসরি দর্শকদের কাছে পৌঁছে যান। কিন্তু নাট্যকলাকে দর্শকের কাছে তুলে ধরার জন্য প্রাথমিক শর্ত হল একটি ভালো নাটক, অভিনেতা এবং মঞ্চের। প্রতিটি কলার একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যা অন্য কোনো কলা মাধ্যমের দ্বারা প্রকাশ করা যায় না। নাটকের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয় না। নাট্যকলার একটি অংশ হল অভিনয় যা মন্ত্রমুগ্ধের মত দর্শকে আকর্ষণ করে। তাই অভিনেতাকে এমনভাবে বিষয়টি তুলে ধরতে হয় যাতে দর্শকের মর্মে তা প্রতিধ্বনিত হয়।

এছাড়া এখানে প্রাবন্ধিক আরও দেখিয়েছেন নাট্যাভিনয়ের ক্ষেত্রে নাটক টেক্সট হিসাবে কতটা নাট্যকলার অঙ্গীভূত অংশ, কারণ অভিনয়ের মাধ্যমে টেক্সট নাট্যকলাকে ছাপিয়ে যায়। তাই নাট্যকলা হল অনুভবের সেই অনন্যতম অংশ যার মাধ্যমে টেক্সটের অন্তর্লীন ভাব ও সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়। লিখিত সংলাপ কীভাবে জীবন্ত আলাপচারিতায় পরিণত হয়, চিরায়ত নাটকের সংলাপকে সমকালীন বাস্তবতার ছাঁচে কীভাবে পর্যবসিত করেন একজন অভিনেতা এবং সেক্ষেত্রে মঞ্চসজ্জা এবং সংগীত কতোটা এই বিষয়ে শম্ভু মিত্র তার অভিমত জানিয়েছেন। এছাড়া ভালো নাটক অভিনয়ের সময়, সেই ক্ষেত্রে মহলার গুরুত্ব এবং সর্বোপরি নির্দেশকের ভূমিকা প্রসঙ্গেও শ্রী মিত্র আলোকপাত করেছেন।

‘অভিনয় নাটক মঞ্চ’, ‘সন্মার্গ সর্পযা’, ‘কাকে বলে নাট্য কলা’ এই তিনটি গ্রন্থ বাংলা নাট্যসাহিত্যের আকর গ্রন্থ। এখানে যেমন একদিক থেকে শম্ভুমিত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক চিন্তনের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। ঠিক তেমনভাবেই সমকালীন নাট্যসমাজ এবং তার পূর্বসূরি নাটককার বা নাট্যকারদের বিষয়ে তাঁর মতামত বিবৃত হয়েছে।

 

দেশীয় ও পাশ্চাত্য ঐতিহ্য

স্বতন্ত্রভাবে নাটক রচনার সমান্তরালে শম্ভু মিত্র একাধিক পাশ্চাত্য নাটকের নাট্যরূপদানের মাধ্যমে নাট্যপ্রিয় বাঙালিকে পাশ্চাত্য ঐতিহ্যের স্বাদ আহরণে সহায়তা করেছেন। শুধুমাত্র পাশ্চাত্য নাটকেই তিনি সীমাবদ্ধ থাকেননি, একাধিক রবীন্দ্রনাটকও তিনি সফলভাবে মঞ্চস্থ করেছেন।

দেশীয় ও পাশ্চাত্য ঐতিহ্য সংবলিত নাটকগুলির প্রথমেই আসে শম্ভু মিত্রের শ্রেষ্ঠ নাটক ‘চাঁদ বণিকের পালা’র কথাএই নাটকে সংলাপ বাংলা ভাষায় রচিত। তবে সেটি কাব্যময় মৌখিক বা আঞ্চলিক গদ্যভাষা। যার মধ্যে রয়েছে অপূর্ব নাট্যিক ব্যঞ্জনা। তবে এই নাটকের ট্র্যাজিক পরিণতিটি পাশ্চাত্য ট্র্যাজিডি লক্ষণযুক্ত। ‘কাব্যতত্ত্ব’ গ্রন্থে অ্যারিস্টটল ট্র্যাজেডি সম্পর্কে যে  সংজ্ঞা দিয়েছেন, সেটি হল— “ট্র্যাজেডি হল গম্ভীর, সম্পূর্ণ ও বিশেষ আয়তন বিশিষ্ট ক্রিয়ার অনুকরণ, ভাষার সৌন্দর্যে তার প্রতিটি অঙ্গ স্বতন্ত্র, এই ক্রিয়াটির প্রকাশরীতি বর্ণনাত্মক নয়, নাটকীয়; আর ক্রিয়া ভীতি ও করুণার উদ্রেক করে এবং তার মধ্য দিয়ে অনুরূপ অনুভূতিগুলির পরিশুদ্ধি ঘটায়।’’১৬

উক্ত নাটকের বিষয়বস্তু মধ্যযুগীয় পুরাণতান্দ্রিক সময়নির্ভরযেখানে স্বপ্নের দেবী সত্যের  মানুষের প্রত্যয় স্থাপনের লড়াই সংঘটিত হয়েছে। চাঁদ সওদাগর সর্বশান্ত হয়ে নিজের দৃঢ়তায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সে সমস্ত প্রতিকূলতার বিপরীতে গিয়ে কেবলমাত্র তার আরাধ্য দেবতার বিশ্বাসকে সম্বল করে এগিয়ে চলেছে। শেষপর্যন্ত পরিস্থিতির কাছে চাঁদ পরাজয় স্বীকার করলেও সেটি শর্তনির্ভর। তাই এই দিক থেকে ‘চাঁদ বণিকের পালা’ নাটকের বিষয়বস্তু গুরুগম্ভীর। এছাড়া নাটকটি নির্দিষ্ট সময় ও কালের সীমারেখায় সীমায়িত হয়েছে। তাই বলা যায় নাটকটি একটি নির্দিষ্ট আয়তন বিশিষ্ট। আবার এই নাটকটি আদি, মধ্য, অন্ত্য যুক্ত।

‘চাঁদ বণিকের পালা’ প্রথম পর্বে বনিক চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্য যাত্রার আয়োজন এবং যাত্রার বর্ণনা আছে। পরবর্তী অঙ্কে লখিন্দরের বড়ো হওয়া, বেহুলা ও লখিন্দেরর বিবাহ এবং বাসরঘরে সর্পাঘাতে লখিন্দরের মৃত্যুর ঘটনা বিবৃত হয়েছে। সর্বশেষ পর্বে রয়েছে লখিন্দরের প্রাণ ফেরাতে বেহুলার যাত্রা এবং পুত্রশোকে চাঁদের পাগলপ্রায় দশা উঠে এসেছে।

আবার ‘চাঁদ বণিকের পালা’র সূচনা হয়েছে নাটকীয় ভঙ্গিতে। কারণ সমুদ্রযাত্রার সময় দেখা যায় অমঙ্গলরোধ করার জন্য নৌকার নোঙরের দাঁড় কেটে যাত্রা আরম্ভ হয়েছেএই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নাটকীয় মাধুর্য্যে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে নাটকটি। এছাড়া দৈবিশক্তির বিপক্ষে মানবশক্তির লড়াই দর্শকের মনে ‘ভীতি ও করুণা’র উদ্রেক ঘটিয়ে ভাবমোক্ষণ বা ক্যাথারসিসে সহায়তা করে। নৃত্য পরিবেশনার মাধ্যমে স্বর্গের অধিদেবগণকে তুষ্ট করে বেহুলা স্বামীর প্রাণ ফেরাতে সমর্থ হয়। কিন্তু মর্ত্যে তার সতীত্ব অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হয়, এহেন পরিস্থিতিতে বেহুলার জবানিতে নারীর অবমাননাকর পরিস্থিতি তুলে ধরেন নাট্যকার, যা দর্শকদের মর্মে প্রতিধ্বনিত হয়—“...শ্বশুর, আমি আর সে বেহুলা নই। তেত্রিশ কোটির সেই কামোৎসুক চোখের সুমুখে যে নাচ নেচেছি—শ্বশুর, সে বড়ো অশ্লীল।...আর সেই নাচের ভিত্রে সায় বণিকের কন্যা সেই  যে বেহুলা, সেই যে তুমি যারে দেখ্যাছিলে বিবাহের দিনে, সে বেহুলা মর‍্যা গেল।”১৭ তাই  আলোচনার সাপেক্ষে বলা চলে শম্ভু মিত্রের ‘চাঁদ বণিকের পালা’ নাটকটি পাশ্চাত্য ঐতিহ্য সংযুক্ত।

আবার ‘চাঁদ বণিকের পালা’ নাটকটি একাধারে প্রাচ্য ঐতিহ্য সংমিশ্রিত নাটক হয়ে উঠেছে। নাটকের নামকরণেই নাট্যকার কর্তৃক ব্যবহৃত ‘পালা’ শব্দটি সর্বপ্রথম এর স্বপক্ষে যুক্তি দেয়। মধ্যযুগীয় বাংলা অন্যতম একটি সাহিত্য ধারা হল পালাগান। বর্তমান বাংলাদেশের মৈমনসিংহ জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে এই পালাগানের ইতিহাস লক্ষ করা যায়, পরবর্তীকালে অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সেন সেইসকল ‘পালা’ সংগ্রহ করে ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ নামে প্রকাশ করেনআবার নাটকের বিষয়বস্তুটি মধ্যযুগীয় ঘটনা নির্ভর। তৎকালীন মঙ্গলকাব্য ধারার অন্যতম জনপ্রিয় হল কানাহরি দত্ত প্রণীত ‘মনসামঙ্গল কাব্য’। পরবর্তীসময়ে কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ সহ অন্যান্য কবিরাও এই ‘মনসামঙ্গল’ কাব্য রচনায় নিবদ্ধ হন। “মধ্যযুগীয় জনপ্রিয়তম সাহিত্য শাখা মনসামঙ্গলের কাহিনির মোড়কে নাট্যকার আধুনিক জীবনযন্ত্রণা ও জীবনভাবনাকে ফুটিয়ে তুললেও যেহেতু মধ্যযুগ থেকে বিষয় আহরণ করেছেন, তাই সচেতনভাবেই ‘চাঁদ বণিক’ শব্দদ্বয়ের সঙ্গে ‘পালা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। আসলে চাঁদ বণিকের পালা মধ্যযুগের পান পাত্রে বিংশ শতকের জীবন মদিরার পালা।”১৮

তাছাড়া এই নাটকটি অঙ্ক বা দৃশ্য দ্বারা বিভক্ত নয়। এটি বাংলা লোকনাট্যের মতই তিনটি স্বতন্ত্র পর্বে বিন্যস্ত হয়েছে। সেইসঙ্গে এই নাটকে দেবমাহাত্ম্যের বিষয়টিও অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত রয়েছে। “রবীন্দ্রোত্তর বাংলা নাট্য সাহিত্যের ধারায় শম্ভু মিত্রের ‘চাঁদ বণিকের পালা’ মিথ-পুরাণের ভাঙাগড়ায় গঠিত এক মাইলস্টোনধর্মী রচনা। ‘Revers myth’ বা ‘মিথের প্রতিরূপক’ ব্যবহারের স্টাইলে তিনি এ নাটকে মধ্যযুগের বিখ্যাত লোকপুরাণ মনসামঙ্গলের কাহিনিটিকে বহিরঙ্গে মোটামুটিভাবে স্থাপন করে তার অন্তরে সমকালকে প্রছন্নভাবে লুকিয়ে রেখেছেন। এই মিথের আবরণটিকে সরিয়ে দিলে আমাদের সম্মুখে আধুনিক এক জীবন-প্রজ্ঞা তথা সমকালীন(১৯৬৬ থেকে ১৯৭৪ সালের পশ্চিমবঙ্গের) জীবন প্রসূত সমাজ-রাজনীতির চিত্রটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।”১৯

এই নাটকের সংলাপে একদিকে যেমন লৌকিক কথ্য ভাষার ব্যবহার, ঠিক তেমনভাবেই ধন্যাত্মক শব্দ, সমাসবদ্ধ শব্দ সহ বাগধারার প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। যেমন- বল্লভ চরিত্রের জবানিতে, “ না, না অকারণ সন্দেহ পোষণ করো নাকো ! আমি তোমাদের উভয়ের মিটমাট কর‍্যা দিয়্যা যাই।”২০ আবার তার সঙ্গে লখিন্দরের কথোপকথনে সমাসবহুল পদের উল্লেখ পাওয়া যায়; যেমন— “...নাহে বেণীনন্দন, না, না, চন্দ্রধরে নিয়্যা তুমি অযথা সন্ত্রস্ত হও। আমার তো জীবনের বেশিদিন কেট্যে গেছে অধ্যাপনা করে, সে আমার ছাত্র ছিল। তারে আমি ভালো মতে জানি।”২১ ইত্যাদি। উক্ত আলোচনার সাপেক্ষে তাই বলা যায় ‘চাঁদ বণিকের পালা” নাটকটি একাধারে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ঐতিহ্য সংবলিত নাটক।

স্বতন্ত্রভাবে নাটক রচনার পাশাপাশি শম্ভু মিত্র স্বনামধন্য বহু পাশ্চাত্য নাট্যকারের নাটক বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে নাট্যরূপ দান করেছেন। গ্রিক নাট্যকার সফোক্লিসের ট্র্যাজেডিধর্মী ‘কিং  ঈদিপাস’ নাটকের অনুবাদিত রূপ ‘রাজা অয়দিপাউস’এই নাটকটি প্রথম ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ জুন ‘নিউ এম্পায়ার’ থিয়েটারে নাটকটি অভিনীত হয়। ভাগ্যের চূড়ান্ত দোলাচলতায় রাজা অয়দিপাউস তৎকালীন যুদ্ধের নীতি অনুসারে বিজয়ী হন এবং পরাজিত রাজ্যের রানী ইয়োকাস্তাকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই রাজ্যে উদ্ভূত মড়কের কারণে প্রজাহিতৈষী রাজা এই উৎস সন্ধানের মাধ্যমে তার জন্মরহস্য সম্পর্কে অবগত হয়। নিজের অজান্তে অয়দিপাউস তার পিতাকে হত্যা করে এবং মা কে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ। তাই প্রজাদের স্বার্থে  তিনি চোখ কাঁটাবিদ্ধ করে অরণ্যবাসে চলে যায় অন্যদিকে ইয়োকাস্তা আত্মহত্যা করে। তবে নাটকটি অনুবাদের সময় শ্রী মিত্র বেশ কিছু সংযোজন বিয়োজন ঘটান। এই ক্ষেত্রে তিনি নাটকের শেষ দৃশ্য ব্যবহৃত কোরাসের সংলাপগুলি পরিত্যাগ করেন। গ্রিক নাটকে কোরাসের সংখ্যা ছিল নির্দিষ্ট( ১২ থেকে ১৫ )এখানে শম্ভু মিত্র সেটি পরিবর্তন করে কোরাসের সংখ্যা করেন তিনজন। তাছাড়া সর্বোপরি নাটকটি মান্য বাংলা ভাষায় রচিত, ফলে সকল চরিত্রের সংলাপও বাংলা ভাষায় ব্যাপৃত হয়েছে

বহুরূপী সদস্যরা ‘রাজা অয়দিপাউস’ এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রাজা’ নাটক দুটিকে  ‘অন্ধকারের নাটক’ বলে অভিহিত করেছেন। এই প্রসঙ্গে শাঁওলি বলেছেন, “...মানুষের জীবনে যতটা তার জানা,--তার চেয়ে অনেক বেশি তার অজানা। এই লক্ষ-কোটি সূর্যতারা, লক্ষ লক্ষ বছরের আবর্জনার মধ্যে কতটুকু সময় মানুষ বাঁচে ? তার আগে কী কারণে কী ঘটেছে তা সে জানে না। এই খন্ডকালের বাঁচাটুকুর মধ্যেই তার সাহস, তার অহঙ্কার। তার আকাঙ্ক্ষা- অনাকাঙ্ক্ষা, তার বেদনা।...অন্ধকার থেকে আলোয় উত্তরণের অসীম বাসনা বুকে নিয়ে চরম সর্বনাশের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তার জ্ঞানের লিপ্সা তাঁকে থামতে দেয় না। মানুষের এই পরিণতি একই সঙ্গে মহৎ এবং অতীব করুণ। সেই ট্র্যাজিক জীবনের প্রতিফলন এই দুটি নাটকেই বিদ্যমান।”২২

এছাড়াও শম্ভু মিত্র ইডজিন ও নীলের ‘Where the crush is made’ এবং ইবসেনের  ‘A Doll’s House’ নাটকদুটি বাংলায় অনুবাদ করে নাট্যরূপ দান করেন, যথাক্রমে— ‘স্বপ্ন’ এবং ‘পুতুল খেলা’ নামে। স্বভাবতই এই নাটকগুলিও প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মেলবন্ধনের রসোত্তীর্ণতা লাভ করেছে।


উপসংহার

“শম্ভু মিত্র—এই শব্দযুগল এখন আর শুধু এক ব্যক্তির নাম নয়, বরং এই দুটি শব্দের বন্ধনীতে ধরা পড়েছে একটি যুগের বাংলা থিয়েটারের ইতিবৃত্ত...একটি সময় পর্বের নাট্যচর্চা ও চর্যায় এত সুদূর-প্রসারী প্রভাব যাঁর সৃজনে ও জীবনে ঘটেছে, তিনি যে অতীব শক্তিশালী এবং বহুবর্ণী এক প্রতিভা তাতে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না।”২৩

সাধারণ রঙ্গশালায় থাকাকালীন সময়ে তিনি উল্লেখযোগ্য চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। কিন্তু এখানকার অভিজ্ঞতা এবং রঙ্গমঞ্চের বাস্তবধর্মীতা তাঁর পরবর্তী জীবনের ভিত্তিপ্রস্তর গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। পরবর্তীতে গণনাট্য এবং নবনাট্য আন্দোলন তাঁকে মঞ্চের পাদপ্রদীপে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। বিশুদ্ধ নাট্যশিল্প পরিবেশনের কারণে রঙ্গমঞ্চের স্বার্থে রচনা করেছেন একের পর এক নাটক। প্রযোজনা ও নির্দেশনার মাধ্যমে নিজের নাটকের পাশাপাশি প্রাচ্যের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে পাশ্চাত্যের ইবসেন, সফোক্লিসের অনন্যসৃষ্টিকে নাট্যরূপ দান করেছেন। নাটকের বিভিন্ন আঙ্গিক নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রতিফলিত করেছেন তাঁর নাট্যভাবনা। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী বাংলা থিয়েটারের ধারাকে একাধারে পরিপুষ্ট এবং লালিত করেছে।

নাট্যপরিচালক হিসেবেও তাঁর দক্ষতা প্রমাণিতসেই সময়ে বাংলা থিয়েটারে বিশেষ করে বাণিজ্যিক থিয়েটারে সামগ্রিক নাট্যপরিচালনা গতানুগতিকতা ও একঘেয়েমি ক্লান্তিকর হয়ে উঠেছিল। শিশির ভাদুড়ি নতুন যুগে নতুন ভাবনায় ও কার্যে নাটক পরিচালনায় অভিনবত্ব সৃষ্টি করেছিলেন। গণনাট্য সংঘ নাট্যপরিচালনায় গতানুগতিকতা ও একঘেয়েমি ক্লান্তিকর হয়ে উঠেছিল। শিশির ভাদুড়ি নতুন ভাবনায় ও কার্যে নাটক পরিচালনায় অভিনবত্ব সৃষ্টি করেছিলেন। গণনাট্য  সঙ্ঘ নাট্যপরিচালনায় যে ‘টোটাল থিয়েটার’—এর অনুবর্তন ঘটিয়েছিলেন, শম্ভু মিত্র সেখান থেকে এসে এবং কিছু অংশে শিশির ভাদুড়ির নির্দেশনায় শিক্ষা নিয়ে বহুরূপীতে স্বপ্রকাশিত হয়েছিলেনসূক্ষ্মভাব ও পরিশীলিত রুচি প্রকাশে অনুপুঙ্খ নিষ্ঠা, মঞ্চসজ্জায় ‘Suggestiveness’, অভিনয়ে চরিত্র বিশ্লেষণের গভীরতা, শব্দ ও বাক্য উচ্চারণের সঠিক পথ নির্দেশ, প্রত্যেকটি চরিত্র এবং অন্য খুঁটিনাটি ব্যাপার ও বিষয়ের দিকে তীক্ষ্ণ নজর—শম্ভু মিত্রের নাট্যনির্দেশনার আসল গুণ।”২৪

অভিনেতা হিসাবে শ্রী মিত্র তাঁর সমকালীন সময়ে খ্যাতির শীর্ষে আরোহিত হয়েছিলেন। মঞ্চ উপস্থাপনা ও নির্দেশনাগত সাফল্যে তিনি ‘পদ্মভূষণ’ সম্মানে সম্মানিত হন ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে। এছাড়া ‘সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার(১৯৫৯), ম্যাগসেসাই পুরস্কার(১৯৭৬) ইত্যাদি পুরস্কার লাভ করেন। দীর্ঘ ২৫ বছর লালন-পালন করেছেন বাংলা নাট্যমঞ্চকে। পরবর্তীকালে মতবিরোধ জনিত কারণে তিনি ‘বহুরূপী’ ত্যাগ করেন। স্বেচ্ছায় নির্বাসন গ্রহণ করেন বাংলা রঙ্গমঞ্চ থেকে।

প্রকৃত পক্ষে শম্ভু মিত্র স্বয়ং ছিলেন একটি নাট্য-প্রতিষ্ঠান। আলোচনার ক্ষুদ্র পরিসরে এই প্রতিষ্ঠানের প্রাণপুরুষের বিভিন্ন দিক সমকালীন সময়ের প্রেক্ষিতে তুলে ধরা হয়েছে। কয়েকটি চলচ্চিত্র ছাড়া শম্ভু মিত্রের মঞ্চাভিনয় স্বচক্ষে দেখার অভিজ্ঞতা নেই, তাই অন্যান্য নাট্যগবেষক এবং প্রাজ্ঞব্যক্তিদের শম্ভু মিত্র সম্পর্কে নানা অভিমত এবং ব্যাখ্যার সাপেক্ষে আমি শম্ভু মিত্রের নাট্যচর্চা ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয় তুলে ধরার চেষ্ঠা করেছি।

 

তথ্যসূত্র

 

১। চৌধুরী, দর্শন, ‘বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস’, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, পৃ ৩২৯

২। ভাদুড়ি, সত্য (সম্পা.), ‘শম্ভু মিত্র জন্মশতবর্ষপূর্তি সংখ্যা’, পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি, কলকাতা, পৃ ১২২

৩। ঘোষ, জগন্নাথ, ‘শম্ভু মিত্রের নাট্যচর্চা’, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, পৃ ৩১

৪। চৌধুরী, দর্শন, ‘বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস’, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, পৃ ৪৭৪

৫। মিত্র, সনৎ, ‘সাহিত্য টীকা’, সাহিত্য প্রকাশ, কলকাতা পৃ ২৬

৬। রথীন চক্রবর্তী (সম্পা.) ‘শম্ভু মিত্র জন্মশতবর্ষপূর্তি সংখ্যা’, নাট্য চিন্তা, কলকাতা, পৃ ২৩২

৭। মিত্র, সনৎ, ‘সাহিত্য টীকা’, সাহিত্য প্রকাশ, কলকাতা পৃ ২৬

৮। ঘোষ, জগন্নাথ, ‘শম্ভু মিত্রের নাট্যচর্চা’, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, পৃ ৫৫

৯। মিত্র, শাঁওলী (সম্পা.), ‘শম্ভু মিত্র রচনা সমগ্র’-১, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, পৃ ২০০

১০তদেব, পৃ ২১০

১১। তদেব, পৃ ২১১

১২। ঘোষ, জগন্নাথ, ‘শম্ভু মিত্রের নাট্যচর্চা’, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, পৃ ৬০

১৩। মিত্র, শাঁওলী (সম্পা.), ‘শম্ভু মিত্র রচনা সমগ্র’-২, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, পৃ ১৪৫

১৪। তদেব, পৃ ১৩০

১৫। তদেব, পৃ ১৪৪

১৬। দাশ, শিশিরকুমার (অনু.), ‘কাব্যতত্ত্ব ও অ্যারিস্টটল’, প্যাপিরাস, কলকাতা, পৃ ৪৯

১৭। মিত্র, শাঁওলী (সম্পা.), ‘শম্ভু মিত্র রচনা সমগ্র’-২, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, পৃ ১৫৫

১৮। ঘোষ, জগন্নাথ, ‘শম্ভু মিত্রের নাট্যচর্চা’, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, পৃ ৮৯

১৯। রথীন চক্রবর্তী (সম্পা.) ‘শম্ভু মিত্র জন্মশতবর্ষপূর্তি সংখ্যা’, নাট্য চিন্তা, কলকাতা, পৃ ২৩২

২০। মিত্র, শাঁওলী (সম্পা.), ‘শম্ভু মিত্র রচনা সমগ্র’-২, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, পৃ ২৯২

২১। তদেব, পৃ ৩৯২

২২। মিত্র, শাঁওলী, ‘ শম্ভু মিত্র : বিচিত্র জীবন পরিক্রমা’, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট ইন্ডিয়া, পৃ ১৪৩

২৩। ভাদুড়ি, সত্য (সম্পা.), ‘শম্ভু মিত্র জন্মশতবর্ষপূর্তি সংখ্যা’, পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি, কলকাতা, পৃ ১২৩

২৪।  চৌধুরী, দর্শন, ‘বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস’, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, পৃ ৩৩২

 

গ্রন্থপঞ্জি

 

আকর গ্রন্থ

মিত্র, শাঁওলী (সম্পা.)‘শম্ভু মিত্র রচনা সমগ্র’-১। কলকাতা : আনন্দ পাবলিশার্স, ডিসেম্বর ২০১৫।

সহায়ক গ্রন্থ

ঘোষ, অজিতকুমার। ‘নাট্যতত্ত্ব ও নাট্যমঞ্চ’। কলকাতা : দে’জ পাবলিশিং, আগস্ট ২০১৭।

ঘোষ, জগন্নাথ। ‘শম্ভু মিত্রের নাট্যচর্চা’। কলকাতা  : দে’জ পাবলিশিং, জানুয়ারি ২০০৩।

ঘোষ, শঙ্খ (সং.)‘শম্ভু মিত্র : একবক্তার বৈঠক’। কলকাতা  : তালপাতা, এপ্রিল ২০০৮।

চক্রবর্তী, রথীন। ‘থিয়েটারের শম্ভু মিত্র’। কলকাতা : নাট্যচিন্তা, জানুয়ারি ২০১৪

চৌধুরী, দর্শন। ‘বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস’। কলকাতা  : পুস্তক বিপণি, নভেম্বর ২০১৬।

চৌধুরী, দর্শন। ‘গণনাট্য আন্দোলন’। কলকাতা  : পুস্তক বিপণি, মার্চ ২০১২।

মিত্র, শাঁওলী (সম্পা.)‘শম্ভু মিত্র রচনা সমগ্র’-২কলকাতা : আনন্দ পাবলিশার্স, জানুয়ারি ২০১৭

মিত্র, শাঁওলী‘ শম্ভু মিত্র : বিচিত্র জীবন পরিক্রমা’। কলকাতা : ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট ইন্ডিয়া, জানুয়ারি ২০১৭।

মিত্র, সনৎ। ‘সাহিত্য টীকা’। কলকাতা : সাহিত্য প্রকাশ, এপ্রিল, ২০১৮।

সহায়ক পত্রিকা

ভাদুড়ি, সত্য (সম্পা.)‘শম্ভু মিত্র জন্মশতবর্ষপূর্তি সংখ্যা’  কলকাতা  : পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি, সেপ্টেম্বর ২০১৬।

রথীন চক্রবর্তী (সম্পা.)‘শম্ভু মিত্র জন্মশতবর্ষপূর্তি সংখ্যা’কলকাতা  :  নাট্য চিন্তা, নভেম্বর ২০১৫।

সহায়ক ওয়েবসাইট

30 June’18, 11 May’21<https://www.anandabazar.com/patrika/theunforgettable-sombhu-mitra>

2 June’18, 21 May’21<https://ir.nbu.ac.in/handle/123456789/2774>

22 August’20, 23 May<https://www.bongodorshon.com/theater-activist-sombhu-mitra’s105th birth anniversary>