বুধবার, ১৪ মে, ২০২৫

মধুবন চক্রবর্তী

 

অন্নপূর্ণার ভান্ডার স্বরস্বতীর বরপুত্রী: অন্নপূর্ণা দেবী




হেমন্তের এক পড়ন্ত বিকেলে সুরবাহারে বেজে উঠেছে ইমনকল্যান। সুরমূর্ছনায় ইমন কল্যাণের রঙে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে সন্ধ্যার হিমেল বাতাসকে। সেই সন্ধ্যার মীড়কে ধীরে ধীরে গমক আর বিশুদ্ধ নায়কীতে আরও গভীর ও নিবিড় করে তুলছেন সেতারবাদক। সুরবাহার ও সেতারবাদনের যুগলবন্দিতে মন্দ্রিত হচ্ছে সংগীতের আকাশ বাতাস। হৃদয়ে ধ্বনিত হচ্ছে অন্তরের উদারা, মুদারা, তারা সপ্তক।

যুগলবন্দী শেষে এক মায়াময় পরিবেশ তৈরি হয়েছে চারিদিকে। সুরবাহার যিনি বাজাচ্ছিলেন, তিনি যেন সাক্ষাৎ সরস্বতী। সেদিনের সেই জীবন্ত সরস্বতীকে ঘিরে শ্রোতা দর্শকদের উচ্ছাস ছিল বাঁধভাঙা। মন্ত্রমুগ্ধের মত তাঁরা শুনেছিলেন অন্নপূর্ণা দেবী ও রবিশঙ্করের যুগলবন্দী। তবে সব বিস্ময় যেন ভিড় করেছিল অন্নপূর্ণা দেবীকে ঘিরে। সবার চোখে মুখে সেই মুগ্ধতা। শ্রোতা দর্শকদের সেই ব্যাকুলতা কি

একটু হলেও ভাবিয়েছিল রবিশঙ্করকে?...এরকম একাধিক অনুষ্ঠানে যুগলবন্দী হলেই বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই নজর কাড়তেন অন্নপূর্ণা দেবী। সেটাই পছন্দ হত না রবিশঙ্করের। এমনটাই শোনা গেছে সেইসময়। এমনকি

অন্নপূর্ণা দেবী এক সাক্ষাৎকারে সেরকমটাই জানিয়েছিলেন... "দর্শকদের সামনে আমি যতবার বাজিয়েছি, সকলেই আমার ভীষণ তারিফ করেছে। আমি বুঝতে পারতাম পণ্ডিতজি এটা ভালোভাবে নিচ্ছেন না। আমারও লোকের সামনে গিয়ে বাজানোর খুব গরজ ছিল এমন নয়। তাই এটা বন্ধ করে আমি নিজের মতো সাধনা চালিয়ে যেতে থাকি"...ধীরে ধীরে জনসমক্ষে সুরবাহার ও সেতারবাদন পরিবেশন করা একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আত্মীয়পরিজনরা অন্নপূর্ণা দেবীর এই অন্তর্ধানের পেছনে রবিশঙ্করের ঈর্ষাকেই দায়ী করেছিলেন। অন্নপূর্ণা দেবী যখন সুরবাহারে বাদন তুলতেন তখন শুকনো ঝরাপাতারাও যেন নৃত্য করে উঠত। ডালে বসে পাখি উড়ে যেত দূর দিগন্তে, প্রেম হয়ে উঠতো এক প্রতীক্ষার নাম। অন্নপূর্ণা দেবীর কাছে প্রতীক্ষা যেন প্রেমেরই অপর নাম, সেখানে রবিশঙ্কর যেন ঈর্ষার কাঁটায় বিদ্ধ হচ্ছেন। আঙ্গুল কেমন যেন অনায়াস ভাবে ডানা ঝাপটাচ্ছে কখনো ভোর কখন আবার রাতের রাগমালায়। অন্নপূর্ণা দেবী যখন ভাবছেন দুর্দান্ত বাজনার পর উষ্ণ স্পর্শে রবিশঙ্কর হাত দুটো ধরে হয়তো বলবেন তাঁর মুগ্ধতার কথা, সেখানে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে রবিশঙ্কর। আর অন্নপূর্ণা দেবীর গুণমুগ্ধরা তাকে ঘিরে ধরেছেন। অন্নপূর্ণা দেবীর ব্যাকুলতা হয়ত  কোনদিনই বুঝতে পারেননি, বা বুঝতে চাননি রবিশঙ্কর। আসলে অন্নপূর্ণা চাইতেন সংগীতের পর সব মনোযোগটাই তাঁর দিকে থাকুক। কিন্তু সেই প্রেমের ছোঁয়াটুকু সেভাবে পাওয়া হয়নি অন্নপূর্ণার। পণ্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গে জীবনের গাঁটছড়া বাধার মুহূর্তে রওশন-আরা বেগম অন্নপূর্ণা দেবী হয়েছিলেন বাবার ইশারায়। নৃত্যগুরু উদয়শঙ্কর চেয়েছিলেন তার ছোটভাই রবিশঙ্করের সঙ্গে আলাউদ্দিন কন্যা জুটি বাঁধুক। উদয়শঙ্করের সেই ইচ্ছেয় সায় দিয়ে শিষ্যের কাছে সরস্বতীকে সম্প্রদান করেছিলেন বাবা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। হরি-হর হয়ে পরস্পরকে আলিঙ্গন করতে ব্যাকুল থাকবে চিরকাল, সেরকম আশা করেছিলেন  আলাউদ্দিন খাঁও। ‘রাগমালা’র আত্মকথনে অবশ্য পন্ডিত রবিশংকর জানিয়েছেন "তাঁর জীবনে অন্নপূর্ণা দেখা দিয়েছিলেন দুর্বিপাক হিসেবে। বাবার সম্মুখে বসে একসঙ্গে বাজালেও ওকে দেখে প্রেমের চোরাটান তাঁর মনে নাকি কখনোও জাগেনি। আসলে দুজনের বিবাহবন্ধন ছিল দুজনের কাছেই আকস্মিক। অভিভাবকদের আদেশ বলা যেতে পারে। গুরুজির ইচ্ছে স্বপ্নকে পূরণ করা। দুজনেই সুরের জগতের হলেও তাদের মন কখনোও একই সুরে গাঁথা হয়নি। সেই ট্র্যাজেডি অন্নপূর্ণা দেবীকে আরও যেন দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে।

সহোদর আলী আকবর খাঁ অকপটে উক্তি করেছেন "বাবা এমন কিছু রাগ ও বাজাতে পারতো যেটা আমি বা অন্য শিষ্যরা কখনোও ঠিকঠাক রপ্ত করে উঠতে পারিনি। ওর মধ্যে বাবার ঐশ্বর্য ভর করেছিল"। ওস্তাদ আমির খান রাখঢাক না করেই বলেছিলেন, "অন্নপূর্ণা দেবীর মধ্যে আলাউদ্দিন খাঁর প্রতিভার আশিভাগ ভর করেছিল। ৭০ ভাগ পেয়েছিলেন আলী আকবর খাঁ। আর রবিশঙ্কর পেয়েছিলেন মেরেকেটে ৪০ ভাগ"। এরকমই অনেক বিতর্কিত কথাই পাওয়া যায় বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে, মন্তব্যে যা লিপিবদ্ধ হয়েছে বহু জায়গায়। অনুমান করাই যায়, পন্ডিত রবিশঙ্করজি একদিকে অন্নপূর্ণা দেবীর প্রতিভা ও নিরলস সাধনার প্রতি যেরকম মুগ্ধ ছিলেন, অন্যদিকে কোথাও এক আশঙ্কাও ছিল অন্নপূর্ণা দেবীকে নিয়ে। অন্নপূর্ণার লয়-দার বাদন শুনে মনে হতো যেন স্বয়ং আলাউদ্দিন খাঁ মঞ্চে ফিরে এসেছেন। অন্নপূর্ণা দেবীর সুরেলা বাঁধনের সম্মোহনী শক্তি এতটাই তীব্র ছিল যে রবিশংকর হয়তো অস্বস্তিতেই পড়ে যেতেন সেই প্রতিদ্বন্দ্বীর কথা ভেবে যে সুরবাহার হাতে নিলে এক অভাবনীয় স্বর্গীয় অনুভূতির সঞ্চার হবে। তাকে পরাভূত করার শক্তি কারোর নেই। (সূত্রঃ গানপার.কম )

ওস্তাদ আমির খান যেমন মেনে নিয়েছিলেন "সেতারে রবিশঙ্কর এবং সরোদে আলী আকবর খানের সন্ধার বাঁধন ক্ষণিক দিশা হারায় যখন আলাউদ্দিনদুহিতার চঞ্চল আঙ্গুল সুরবাহারে বেজে উঠত রাগ কিংবা কৌশিকিতে। বাবা আলাউদ্দিন যেন ছায়া হয়ে বসে থাকতেন কন্যায়"... একজন অপরজনকে মনে মনে ভাবতেন প্রতিদ্বন্দী। আর একজন ভেবেছিলেন হয়তো "অন্তরে তুমি আছো চিরদিন অন্তর্যামী"… দুজনের ভাবনার মধ্যে অনেকটাই তফাৎ হয়ে গিয়েছি।। এ ব্যাপারে অবশ্য টেলিভিশনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পন্ডিত রবিশঙ্কর যে কথা বলেছিলেন তা একেবারেই অন্য কথা। বলেছিলেন "বিয়ের পর একসঙ্গে বাজাতে অনেক জোরাজুরি করেছি, কিছু অনুষ্ঠানও করেছি আমরা। তবে এরপর থেকে সে আর একা অনুষ্ঠান করতে  চাইতো না। সব সময় চাইতো আমার সঙ্গে বসে বাজাতে। সে হয়তো দর্শকদের মুখোমুখি হতে চাইত না হয়তো নার্ভাস লাগতো ওঁর। তবে যাই থাকুক না কেন, সে অনুষ্ঠান করা বন্ধ করে দিয়েছে তার নিজের ইচ্ছায় এটা খুব আপসোসের একটা ব্যাপার। কারণ ও অসাধারণ সুরভ্রষ্টা'…!

সম্পর্ক তাদের যেরকমই হোক না কেন, রবিশংকর নিজে যে তার স্ত্রীর গুণগ্রহী ছিলেন, সে তার কথা বুঝতে অসুবিধা হয় না। এই দুই শিল্পীর দাম্পত্য জীবনের নানা টানাপোড়েন, জটিলতাকে উপজীব্য করে একসময় প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ঋষিকেশ মুখোপাধ্যায় তৈরি করেছিলেন তাঁর 'অভিমান' ছবিটি, যেখানে অভিনয় করেছিলেন অমিতাভ বচ্চন। বাস্তব জীবনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া দুই শিল্পী খুব সহজে একে অপরের হাত ধরে সারা জীবন চলতে পারে কি? ছবিতে কাহিনী অনুযায়ী মিলন হয়েছিল দম্পতির, কিন্তু পন্ডিত

রবিশঙ্কর এবং অন্নপূর্ণা দেবীর সম্পর্ক ক্রমশ অবনতির পথে এগিয়ে যায়। পরে সেই দাম্পত্য বিচ্ছেদে পরিণত হয়।

তীব্র অভিমানে ধীরে ধীরে অন্নপূর্ণা দেবী জনসমক্ষ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। যদিও এ ব্যাপারে রবিশংকরের ছাত্র মদনলাল ব্যাস ভিন্ন মত পোষণ করেন। মদনলাল যিনি দীর্ঘদিন "দা নবভারত টাইমস"র সংগীত সমালোচক হিসেবে কাজ করেছেন। লিখেছিলেন "কনসার্ট শেষ হলে লোকজন রবিশঙ্করের চেয়ে অন্নপূর্ণাকেই ছেঁকে ধরত বেশি। এটা পণ্ডিতজির পক্ষে মানা কঠিন হতো"… অন্নপূর্ণা নিজেও সেই একই কথা বলেছিলেন সাক্ষাৎকার।। তাই বলাই যায় যে দুজনে দুজনের প্রতি মান অভিমান ধীরে ধীরে এতটাই তীব্র হতে শুরু করেছিল যে সম্পর্কের ভেতরের ভাঙন ছিল অবশ্যম্ভাবী, সেটা অনুমান করা যাচ্ছিল।

ভেতরের পাহাড়টা ভাঙতে ভাঙতে একদিন একেবারেই ভেঙে গেল। ভাঙনের পর আবার তারপর নিভৃত জীবনে নতুন করে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়া, আবার নতুন করে রচনা করা নিজের জীবন যাপনকে। কন্যার মধ্যে এক অপরিসীম শক্তি জাগিয়ে তুলেছিলেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। সংগীতকে করে তুলেছিলেন সাধনার একমাত্র মাধ্যম। তাই সাংসারিক জীবনের আঘাত প্রত্যাঘাত, বাহ্যিক জীবনের সমস্ত রকম বাধা প্রতিকূলতাকে কাটিয়ে তিনি আত্মসমর্পণ করতে পেরেছিলেন সংগীতের কাছে। সঙ্গীত হয়ে ওঠে চরম প্রেম।

ধীরে ধীরে আড়ালে চলে যান অন্নপূর্ণা দেবী।

দীর্ঘসময় তিনি আড়ালে থাকেন। যতই আড়ালে থাকুক না কেন, তাঁর বাজনা শোনার অপেক্ষায় থাকতেন আমজনতা। যদিও তিনি কনসার্টে বাজাতেন না। তার বাজানো একটি মাত্র রেকর্ড আছে যা দুর্লভ ব্যক্তিগত রেকর্ডিং বলেই বিবেচিত হয়। প্রকাশ অনুষ্ঠান থেকে নিজেকে ক্রমশ সরিয়ে নেবার পর রবিশংকর এবং তাঁর বর্তমান স্বামী রুশী পান্ডের বাইরে তৃতীয় যে ব্যক্তি তার বাদন শোনার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন তিনি ছিলেন বিটেলস তারকা জর্জ হ্যারিসন। জানা যায় সত্তরের বেহালা বাদক ইয়েহুদী মেনুহিনকে নিয়ে ভারত  সফরে এসেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁদের সম্মানে কিছু করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর একটি ইচ্ছে ছিল, তিনি অন্নপূর্ণার বাদন শুনতে চান, যা এক অসম্ভব আবদার বলে মনে হয়েছিল সেই সময়। সেই চেষ্টাই করা হয়েছিল, অনেক অনুরোধের পর অবশেষে রাজি হয়েছিলেন অন্নপূর্ণা দেবী। তবে সিদ্ধান্ত হয়, কোনোও বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন হবে না। তিনি যখন রেওয়াজ করবেন তখন তাঁরা পাশে বসে শোনার সুযোগ পাবেন। যদিও নির্ধারিত দিনে উপস্থিত থাকতে পারেননি মেনুহিন। কিন্তু সেই দিনেই উপস্থিত ছিলেন জর্জ হ্যারিসন, একমাত্র সৌভাগ্যবান ব্যক্তি হিসেবে তিনিই সেদিন অন্নপূর্ণা দেবীর বাদন শুনেছিলেন।

ভারতীয় শাস্ত্রীয়সংগীতে কণ্ঠশিল্পে নিজেদের কৃতিত্ব বজায় রেখেছেন এমন অনেক মহিলা সংগীতশিল্পীকে খুঁজে পেলেও, বাদ্যযন্ত্রে সাম্রাজ্ঞী হয়ে ওঠার উদাহরণ কম পাই। কিন্তু সেতার নামক বাদ্যযন্ত্রে যিনি সিদ্ধহস্ত মা সরস্বতীর বরপুত্রী ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর কনিষ্ঠ কন্যা যাঁর প্রকৃত নাম রুশনারা আলী, যিনি গড়ে তুলেছিলেন সেতার বাদ্যযন্ত্রের নিজস্ব জগত। বাবা উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ এবং মদিনা বিবির সন্তান অন্নপূর্ণার জন্মকালে নামকরণ হয় রোশেনারা। আলাউদ্দিন খাঁ তখন মাইহাররাজ ব্রিজরাজ সিং-এর সভাশিল্পী। রাজাই স্বয়ং রোশেনারার নতুন নামকরণ করেছিলেন অন্নপূর্ণা। যতই তিনি আড়ালে থাকুন না কেন, হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতের ইতিহাসে তার নাম উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। জন্মগ্রহণ করেছিলেন মধ্যপ্রদেশের মাইহার রাজ্যে ১৯২৭ সালে। মাইহারে থাকাকালীন রবিশঙ্কর গুরুজী অর্থাৎ বাবা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের কাছে তালিম নিতেন। সেই সময়ে মাত্র তেরো বছরের অন্নপূর্ণার সঙ্গে উনিশ বছরের রবিশঙ্করের বিবাহ সম্পন্ন হয়। এই বিবাহ ছিল সম্পূর্ণ পারিবারিক বিবাহ। পরবর্তীকালে সেই বিবাহ বেশিদিন স্থায়ী না হলেও রবিশঙ্কর এবং অন্নপূর্ণার দাম্পত্য জীবন নিয়ে কথা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় লিপিবদ্ধ হয়েছে। যদিও সেই সময় মিডিয়ার দাপট কম ছিল। ছিল না অডিও ভিসুয়ালের চোখ রাঙানি, কথায় কথায় যখন তখন ভাইরাল হওয়ার ভয়। বিদেশে পাপারাৎজিরা সেলেবদের এমনিতেও পিছু ছাড়ে না, খবরের ভেতরের খবর ঠিক বেরিয়ে আসবেই তাদের কল্যাণে।

ভারতেও একটা সময়ে কোনও কোনোও সাক্ষাৎকার বা প্রিন্ট মিডিয়া আড়াল থেকে অজানা অনেক তথ্য পেশ করে সাধারণ মানুষকে রীতিমত চমকে দিত। বিশিষ্ট এই সংগীতশিল্পী প্রখ্যাত সেতার বাদক এবং

সুরবাহার বাদক অন্নপূর্ণা দেবী স্বেচ্ছায় সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন, প্রকাশিত হয়েছিল একসময় ম্যানজ ওয়ার্ল্ডে। (সূত্র প্রথম আলো)

ধ্রুপদী গান দিয়েই শুরু হয় অন্নপূর্ণা দেবীর সঙ্গীতে তালিম। উস্তাদ বাবা আলাউদ্দিন খা অন্নপূর্ণার কাছে জানতে চেয়েছিলেন সুরবাহার বাদ্যযন্ত্র শেখার ব্যাপারে তার আগ্রহ আছে কিনা? এটি সেতারের সমগোত্রীয় বাদ্যযন্ত্র আকারে বেশ বড়, বাজানোও কঠিন। শিখতে পারলে অবশ্যই গৌরবের ব্যাপার। ওস্তাদ আলাউদ্দিন  খাঁ চেয়েছিলেন তাঁর কনিষ্ঠা কন্যা সুরবাহার এই যন্ত্রটি শেখার ব্যাপারে মনোনিবেশ করুক। অন্নপূর্ণা দেবী স্মরণ করে বলেছেন তাঁর সাক্ষাৎকার - "বাবা বললেন তোমাকে আমার গুরুর বিদ্যা শেখাবো কারণ তোমার মধ্যে কোন লোভ নেই। এই বিদ্যা শিখতে হলে খুব শান্ত মন আর অসীম ধৈর্য দরকার। আমার মনে হয়েছে গুরুর এই উপহার তুমি ধরে রাখতে পারবে। সঙ্গীতের প্রতি তোমার সত্যিকারের অনুরাগ আছে''। পাশাপাশি তিনি এও বলেছিলেন, সুরবাহারের প্রশংসা করবে কেবল সেইসব শ্রোতা, যাঁরা সংগীতের গভীরতা বুঝতে পারেন। বা অন্তরের মধ্যে সুর অনুভব করেন। সাধারণ শ্রোতারা অবশ্য তোমার দিকে টমেটো ছুঁড়ে মারতে পারে। এখন তুমি কি করতে চাও সেটা বল"...

অন্নপূর্ণা দেবী বলছেন, "আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম, আমি বলেছিলাম, আপনি যা আদেশ করবেন, তাই হবে”। এরপর দীর্ঘ সময় সুরবাহারে তালিম নিয়েছেন অন্নপূর্ণা দেবী। তিনি যখন সেতারে ধীরে ধীরে পারঙ্গম হয়ে উঠছেন, বাবা আলাউদ্দিন কন্যার কাছে বলেছিলেন, "এবার সময় হয়েছে বিটিয়া সেতার ছেড়ে সুরবাহার হাতে নেওয়ার"। আসলে তিনি বলতে চেয়েছিলেন, শ্রম দিলে সেতার সহজেই গোলাপ হয়ে উঠতে পারে।  সুরের ফল্গুধারা বাজানো সেখানে কঠিন কিছু নয়। কিন্তু 'সুরবাহার' এমন একটি বাদ্যযন্ত্র সেখানে ফুল ফোটানো যথেষ্ট কঠিন। সুরবাহারকে সামলানো সকলের কাজ নয়। তিনি বিশ্বাস করতেন, তাঁর কন্যাই পারবে সুরবাহারকে যোগ্য সম্মান দিতে। শুধু নীচু লয়ে বাঁধা ধ্রুপদ অঙ্গের রাগ রাগিণীর আলাপ অংশ বাজানোর জন্যই সুরবাহারকে ব্যবহার করা হবে তা নয়, রাগ সম্পূর্ণ করতে ওকেই সঙ্গী করে নিতে হবে আর সেই নির্দেশে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন অন্নপূর্ণা দেবী। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের ইতিহাসে একাধারে সেতার এবং অন্যদিকে সুরবাহার বাদ্যযন্ত্রে পারদর্শী মহিলা বাদ্যযন্ত্রী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সংসার জীবন সুখের না হলেও, সংগীত জীবনে ছিল সত্যই সুরের বাহার। নিভৃত জীবন যাপন করলেও সংগীতসাধনা থেকে কখনো বিচ্যুত হননি। নিজেই রান্নাবান্না করতেন ঘর পরিষ্কার করতেন। বাইরে না গেলেও ঘরে বসে রেওয়াজ করতেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে বেশিভাগই হয়ে উঠেছিলেন প্রথিতযশা। পণ্ডিত নিখিল ব্যানার্জি, ওস্তাদ বাহাদুর খান, ওস্তাদ আশীষ খান, পণ্ডিত  হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার মত শিল্পীরা  তাঁর শিষ্য ছিলেন। শিষ্যদের সম্মুখেও যেতেন না তিনি। পাশের ঘর থেকেই নির্দেশনা দিতেন। একজন দক্ষ  সংগীতশিল্পীর পাশাপাশি কড়া প্রশিক্ষকও ছিলেন অন্নপূর্ণা দেবী। আর না হওয়ারই বা কি আছে!  ছেলেবেলা থেকেই অন্নপূর্ণার সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহ ছিল অপরিসীম। তাঁর গুরুজিও ছিলেন অত্যন্ত কড়া প্রশিক্ষক। সেই আবহে বড় হয়েছেন তিনি। সত্য স্পন্দনের চৈতন্যানুভূত সত্যদ্রষ্টা সাধক ওস্তাদ বাবা আলাউদ্দিন খাঁর মধ্যে প্রতিফলিত হয়ে জীবন দর্শনের সুন্দরতম রূপটি তাঁর সঙ্গীতে জীবন্ত হয়ে প্রতিভাত হয়েছিল তাঁর শিষ্যদের মধ্যে। সেই জ্ঞানের অনির্বাচনীয় সুধারসে সঞ্চিত হয়েছিলেন অন্নপূর্ণা দেবী। তাই তাঁর বাদ্যযন্ত্রের কণ্ঠ থেকে মিশ্রিত হয়েছিল জীবনের সুধারস।

সেই শিক্ষায় বর্ধিত হয়েছিলেন বলেই পরবর্তীকালে হয়ে উঠতে পেরেছিলেন একজন আদর্শ প্রশিক্ষক। প্রচারের আলোক থেকে অনেক দূরে নিভৃতে, নীরবে, নিরালায় নির্জনে গড়ে তুলেছিলেন এক সাধনার আশ্রম। কিন্তু প্রথম জীবনে বাবা উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ তাকে সংগীতে তালিম দিতে চাননি অর্থাৎ সংগীত শেখানোর ব্যাপারে ততটা আগ্রহী ছিলেন না, তাই লুকিয়ে লুকিয়ে তাঁর ভাইয়ের তালিম নেওয়া দেখতেন তিনি।   রেওয়াজও করতেন। একদিন তাঁর ভাই বাজাচ্ছিলেন আর মন দিয়ে শুনছিলেন অন্নপূর্ণা। একসময় তিনি ভাইকে থামিয়ে বললেন "ভাইয়া বাবা এভাবে না, এভাবে শিখিয়েছিলেন"... বলে নিখুঁতভাবে তাঁর বাবার সেই তালিম বাজানো শুরু করলেন। সেদিনের সেই ঘটনা নিজের মুখে বর্ণনা করেছিলেন তিনি। “আমি তখন সংগীতে এতটাই মগ্ন হয়ে গিয়েছিলাম যে, কখন বাবা এসে আমার পিছনে দাঁড়িয়েছেন আমি খেয়ালই করিনি। যখন বুঝতে পারলাম অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু বাবা তখন আমাকে বকার পরিবর্তে তাঁর ঘরে ডেকে নিলেন। সংগীতের প্রতি আমার সত্যিকারের আগ্রহের কথা বুঝতে পেরেছিলেন। আমার তালিম শুরু হয়ে গেল"।

কবিগুরুর সেই গানের কথাই মনে পড়ে যায় বারবার, "সীমার মাঝে অসীম, তুমি বাজাও আপন সুর, আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর"...

মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত মহা জীবনের অখন্ড যাত্রাপথের পথিক। আসা যাওয়ার পথেই প্রতিনিয়ত পূর্ণতার দিকে এগিয়ে চলেছি আমরা। জীর্ণবস্ত্র পরিত্যাগ করে নতুন বস্ত্র পরিধান করে পরিক্রমণ করছি মহাজাগতিক পথে। সুরের সাধক আলাউদ্দিন খাঁর সুযোগ্য কন্যা অন্নপূর্ণা দেবীও সেই মহাজীবনের পথেই এগিয়ে গিয়েছেন ক্রমশ। তিনি বুঝিয়েছেন, সমগ্র সংগীতজগতকে জীবনকে যখনই অনুভব করতে হবে, তাকে একটা সমগ্রের অংশ ধরে সমগ্রের সঙ্গে একাত্ম্য করেই উপলব্ধি করতে হবে। যেভাবে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলে গিয়েছেন তার বলাকা কাব্যে...

"জীবন হতে জীবনে মোর পদ্মটি যে ঘোমটা খুলে খুলে ফোটে

তোমার মানস সরোবরে

সূর্যতারা ভিড় করে

তাই ঘুরে ঘুরে বেড়ায় কুলে কুলে

কৌতূহলের ভরে"।

সীমার মাঝে অসীম হয়ে রয়েছেন অন্নপূর্ণা দেবী তাঁর সৃষ্টির মধ্যে। আলোকময় পৃথিবী ছেড়ে অনেক আগেই নিভৃতে প্রবেশ করেছিলেন। বহির্জগতের কাছে তৈরি করেছিলেন এক অজানা রহস্যময় জগত। আসলে তিনি নিভৃতেই নির্মাণ করেছিলেন এক আলোকময় পৃথিবী। যা প্রচারের আলো থেকে অনেক দূরে। যে অনুভূতি তিনি রেখে গিয়েছেন তার সংগীতের মধ্যে, সেই অনুভূতির রূপ রস গন্ধ স্পর্শের ভান্ডার আজ পরিপূর্ণ।

সম্পূর্ণ হয়েছে সেই অন্নপূর্ণার ভান্ডার।

 

 

 

 

 

"


৪টি মন্তব্য:

  1. মুগ্ধতা। সুরবাহারের সুর অনুভূত হলো। যার জীবন সুর সাগরের মাঝে, স্বপ্ন,যাপন সবকিছুই সুরের বাঁধনে তার প্রতি নতগ্রীব হয়ে রইলাম।

    উত্তরমুছুন
  2. Apnar sange byakitgoto jogajog korte chai dada। Doya kore ei anurodh rakhben

    উত্তরমুছুন
  3. অর্ঘ্য দত্ত বকসী

    উত্তরমুছুন
  4. কত অজানা কথা জানতে পারা গেলো, অসাধারণ প্রতিবেদন

    উত্তরমুছুন