সিঁড়ি ভেঙে চলা যে জীবন : কবির জীবন
|
(চিত্র-ঋণ : আন্তর্জাল) |
শূন্য ও অশূন্য। ঝুলে আছে জীবনমৃত্যুর মাঝ বরাবর। অশূন্যের গায়ে শীতের আলোয়ানের মতো এক নির্লিপ্ত আকাশ। সে জাগতিক আলোর বাইরে দাঁড়িয়ে
যেন বিশ্বনাট্যের মহড়া দেখছে। মোহাবিষ্টের রাত্রিজগৎ। এতো যে লীলাভৈরব, সেখানে তার কি কোনও ভূমিকা থাকছে না! এদিকে শূন্যের একখানা সিঁড়ি, নেমে আসছে নিবিড় নৈর্ব্যক্তের দিকে। এই নৈর্ব্যক্তিকতার সঙ্গে
চরাচরের আনন্দ মিশে এক স্বাধীন সম্পর্ক। যাঁরা এই নিবিড়ে একান্ত হয়ে উঠতে চান, তাঁদের ভেতরে নিজের অজান্তেই বিশেষের জন্ম হয়। বিশেষ হলো সত্তার এক রূপ, যে তাড়িত করে সমস্ত 'আমি'র ভিন্ন 'আমি'কে। তাকে খুঁজে বের করতে মন ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে ওঠে।
এই খোঁজ হলো শূন্যের সেই প্রথমাংশ। অর্থাৎ বিস্ময়ের বোধ। অরূপের জিজ্ঞাসা।
আত্মখননের পথ ধরে যার গভীরে নেমে যাওয়া। গভীর থেকে আরও গভীর। এক জীবনে যে খননের কোনও
শেষ নেই। আবার এই খনন শুরু হলে থেমে থাকারও কোনও উপায় থাকে না। নিজের সঙ্গে নিজে, ভেতরের জিজ্ঞাসাগুলো যেন আন্তরিক হয়ে ওঠে।
তাহলে কবিতা কোথায় থাকে! বা কবিতার ভেতরবাড়ির আলো-অন্ধকার! ছায়া ছায়া নীরবতার গায়ে শিশির লাগছে। হিম
বাতাস। কেউ দেখছে না বাতাসের গায়ে উলঙ্গ আঙুলের স্পর্শ রচনা করে চলেছে একটা সরুপথ। এই পথ কতদূর বিস্তৃত! তাকে কি আমাদের পক্ষে সহজে উদ্ধার
করা সম্ভব! আমরা সেভাবে বলতেই পারি না। কারণ কেউ তো সেভাবে দেখছে না। এই দেখাটাই এক
জিজ্ঞাসা। সম্ভব-অসম্ভবের
একটা দোলায় দুলছে।
তার মধ্যে আরও আরও বিস্ময় সন্ধ্যার আভাস
নিয়ে জড়ো হয়।
দূরে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা অন্ধকার যেন পা মিলিয়ে এগিয়ে আসতে থাকে। বিস্ময় আর বিস্ময়। জিজ্ঞাসাকে সাজাতে বসেছে রাত্রি তার নিজের
অলংকার দিয়ে। তার জন্যেও অস্থির হচ্ছে মন। না-পারার ঢেউ যতো আছড়ে পড়ছে বুকের উপর, অস্থিরতাও ততো তীব্র হয়ে উঠছে।
ব্যাকুলতার কি এবার যাত্রা শুরু হলো!
সেকি এবার চলেছে অনির্দিষ্টের দিকে!
এভাবে বললে কি সবটুকু বোঝা যায়! আসলে বোঝার নয় বাজার। কতটা ভেতরে বাজলো! আমরা জানি না, এই যে জীবন, সে কতটা
কবিতার ভেতরবাড়ির আলোবিন্দুকে কাছে পায়! কতটা অন্ধকারের রহস্যকে উদ্ধার
করতে পারে! প্রতিটি শুরুর আগে একটা শুরু থাকে, একটা আরম্ভ। একটা পথ এগিয়ে চলেছে নানা বাঁক নিয়ে। জীবনের গভীরে যখন সত্তার
নড়াচড়া শুরু হবে সেই হলো আরম্ভ। সত্তাকে সংসারের বাজারি হিসেব ছেড়ে উন্মুক্ত পথের
বাঁকে এসে দাঁড়াতে হবে। কানের মধ্যে ঝুম ঝুম অপরিচিত শব্দ নিয়ে। এই অপরিচয়ও এমন এক
উপাদান যা একসময় অপূর্ণ থেকে পূর্ণতার দিকে ঠেলে দেয়। এখন এক 'আত্ম'র জন্যে একাকিত্বের মহার্ঘ
ধ্যান সেরে নেওয়া।
যে চাইছে বীজের আশ্রয়। বীজ হলো পাখপাখালির অচেনা গুঞ্জন থেকে উঠে আসা আত্মার 'অক্ষর'। অন্তর্গত ধ্বনির অক্ষর। মূলে বিষাদের
নৈর্ব্যক্তিক ঘোর। যখন সে এসে দানা বাঁধে, তখনই ঘনিয়ে আসা রাত্রির অন্ধকারে তার হয়ে ওঠার চাকাটা ঘুরতে
শুরু করে। সৃষ্টির উন্মাদনা শুর হয়।
এই উন্মাদনার মধ্যে নতুন জন্মের আয়োজন সংঘটিত হচ্ছে। স্রষ্টা একবার নিজেকে ভাঙছেন একবার গড়ে তোলার চেষ্টা
করছেন। যেটুকু
ধরাছোঁয়ার অতীত, তাকে বর্তমানে টেনে আনার
চেষ্টা।
হয়তো পুরোটাই ব্যর্থ হলো। তাতে কিচ্ছু এসে যায় না। ব্যর্থতাও সংসারের আরেক উপাদান, ধূপ-ধুনো-চন্দনের মতো। কবির নিঃসঙ্গের যাত্রাকে ত্বরান্বিত করে।
প্রতিটি ব্যর্থতার মধ্যে দিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে নেমে যাওয়া। যেন আত্মহননের পথ তাঁকে
ডেকে চলেছে বিযুক্তির দিকে। যা তাঁকে অন্য জীবনের সন্ধান
দেয়। এই পথই তাঁর নিয়তি। শব্দের ঘর, শব্দের সংসারে তাঁর নাড়া বাঁধা। এই অকথিত ধ্বনিপুঞ্জ প্রতিমুহূর্তে কবিকে
নির্দেশ পাঠাচ্ছে। কবি সেই নির্দেশ মেনে
বরণ করে নিচ্ছেন সৃষ্টির অমোঘকে। গূঢ় বেদনার মতো। হ্যাঁ, চূড়ান্ত বেদনা থেকে যে আনন্দ, তাই-ই অমোঘ। একবার সত্তা যদি জাগে,
তাহলেই
চক্রব্যূহে ঢুকে পড়া। ঢুকে পড়লে এর থেকে নিষ্কৃতি নেই। নিজেকে মুক্ত করার আর কোনও
উপায় নেই। ধারণার বাইরেও একটা জগৎ থাকে। সেই জগতে প্রবেশের জন্যে সবার আগে বেদনার
গহ্বরটি খুঁজে বের করতে হবে। জীবনের সমস্ত সাধারণসামগ্রী সরিয়ে, সমস্ত আগাছা সরিয়ে, জঞ্জাল
সরিয়ে হাতি ধরা ফাঁদের মতো সেই গহ্বরে ঢুকে পড়তে হবে শুধুমাত্র নিজেকে নিয়ে। সম্পর্কের দ্রাঘিমায় রেখাগুলো
যতদূর বিস্তৃত তাকে ছাড়িয়ে, আরও দূর
সীমানার বাইরে যেতে যেতে নিজেকে নিক্ষেপ করতে হবে।
কবি বলছেন –
দু-চোখে
কাপড় বেঁধে
ক্রাচ ঠুকে
ঠুকে এসেছি এতটা পথ
দেখেছি
নৌকার কাঠে গূঢ় অন্ধকার!
মাঝি নেই,
হাল নেই, স্রোতের স্তব্ধতা
(দেবজ্যোতি
রায়)
তবু চলা কিন্তু থেমে নেই। নিরন্তরের এই যাত্রায় গন্তব্য অনির্দিষ্ট হলেও
লক্ষ্য একটা রয়েছে। তা হলো যেতে যেতে স্ফূট আর অস্ফূটের মধ্যে যে শিহরণ, তাকে বীজের রূপে মাটিতে ধারণ করা। যা থেকে অঙ্কুরিত হবে নিজের আখরগুলো। এক
আত্মকীয় অস্তিত্বের ছায়া যেন আকার পেতে থাকে। ডালপালা বিস্তারের বাসনা জাগায়। সাধ
যেন সাধ্যের বাইরে না হয়। একে যদি আসক্তি বলা হয় তো আসক্তি, লোভ বললে লোভ। কিন্তু প্রকাশের জন্যে এটুকুই তাঁর নিজের। বাকি
যা সব এই মহাবিশ্বের। নিঃসঙ্গের মধ্যে আসঙ্গ এই 'আমি'র আমিত্ব। 'আমি'কে দেখা। উন্মোচন করে দেখা। সত্তা এবং ব্যক্তিত্বের গভীরে নিহিত যে সত্য তাকে জাগিয়ে তোলা। এক্ষেত্রে
সেই নিরাসক্তি নিয়ে একটা সংশয় জন্ম নিতে পারে। তাহলে আমরা বলবো এ হলো পরম আসক্তি।
আত্মপীড়নের অরূপ থেকে যার জন্ম হয়। যাত্রা থাকে অপরূপের অভিমুখে। তখন চোখের মধ্যে
আরেকটা চোখের জন্ম হয়। সেই চোখ সীমাহীন একাকিত্বময় সপ্রাণ জীবনকে দেখতে পায়।
তবে 'উন্মোচন' আর 'জাগরণ' কিন্তু এক নয়। নিজেকে খোঁজার যে তাগিদ বা আসক্তি তা হলো 'জাগরণ'। এই আত্মসন্ধানের পথ ধরে গভীরে যেতে যেতে তাকে পাওয়ার যে ধ্যান তা হলো 'উন্মোচন'। এ দুয়ের মিলে কবির সত্তায় শুরু হয় নক্ষত্রের আলোড়ন। সে
ভাষা পেলে তবেই প্রকাশ। না পেলেও পাওয়ার ইচ্ছায় প্রক্রিয়াটি চলতে থাকে। ভাঙার
মধ্যে গড়ে তোলার বাসনা, সেও এক কাম। সৃষ্টি এবং নির্মাণের শঙ্খলাগা মাধুর্য। এক অবাক করা ধ্বনির গুঞ্জন উঠছে। বীজের আভাস ঘটছে। কবির জীবন এই
বীজের জীবন। স্বপ্ন দেখে মন আর চোখ দেখে নিসর্গের বাস্তবতা। যার নির্দিষ্ট কোনও
আকার নেই। কবি যা কল্পনা করেন সেটা তার
বাস্তব। কারণ
যে বাস্তবকে কবি দেখেন তার স্বরূপ বাইরের প্রকৃতি থেকে পাওয়া নয়, ভেতরে ভেতরে গড়ে ওঠা বাস্তবতা।
এই তো শব্দপ্রবাহের সঙ্গে উছলে
উঠছে নদী। সঙ্গে সময় চলেছে কম্পমান একটি রেখা বরাবর। আরেকটি রেখা চলেছে কবির
অনুভবতরঙ্গ ধরে। সমান্তরাল এই চলনের মধ্যে ধরা থাকে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ-এর
জাগতিক বোঝাপড়া। রাত্রি যখন ঘন তমসার বুকে নিজের আসন পেতে বসে
তখন নৈঃশব্দ্যের আলো এসে তাদের বাসর সাজায়। কবি দেখছেন এই দৃশ্য। এইটুকু সম্বল করে
তাঁর বাঁচা। বহতার মধ্যে একজীবনের দুটো খসড়া। এটাই কবির রচিত পৃথিবী। সৌন্দর্য এবং
মাধুর্যের সমস্ত উপকরণ দিয়েই তাঁর রচনা –
এখানে এলেই
স্নায়ুপথ পিছলে এক্কেবারে গহ্বরে। আর কেবলই পিছিয়ে যাই বিচলিত
আমি,
পথ-পথালি নিয়ে।
ঝোপ বুঝে রঙের পেছনে লুকাই এই নিরাপদ। দুকূল কীভাবে
সামলাব? এখানেই আমি মলম পরিয়ে দমকা হাতে পাই। ছাতার দূরত্ব মাপি।
(কল্যাণী
লাহিড়ী)
কবি দেখলেন এবং এভাবেই আঁকলেন। এই তাঁর রূপাভাস। যা প্রত্যক্ষে হবে না। কেবলমাত্র
অনুভবে। সময় এর মধ্যেই অবস্থান করছে। এটাই কবিতার বিশ্ব এবং কবির চরাচর। এই
নিবেদন। এছাড়া আত্মের আর কোনও উৎসর্গ নেই। অনন্তের সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে কবি
বহুবিচিত্র বাঁক নিয়ে সেই রেখার উপর হয়তো একটু দাঁড়ালেন, তারপর অবলীলায় পেরিয়ে গেলেন
এক একটা বিপজ্জনক খাদ।
নির্মিত হতে লাগলো অনির্ভর কান্নার দুরূহ। একটা ঝরঝর, প্রবাহিত হচ্ছে অদৃশ্য থেকে, তারপর উৎসারিত হলো। অজ্ঞাত বিষণ্ণকে পাশ কাটিয়ে
অন্ধকারের মেধায় আশ্রিত যে আলো তাকে ধরলেন, নৈঃশব্দ্যের গভীরে দুলতে থাকা ছায়াকে ধরলেন। কালের গর্ভে ঘুমিয়ে পড়া
পরিত্রাণকে ডেকে তুললেন। তারপর তার হাত ধরে হেঁটে চললেন আরোগ্যভূমির দিকে।
কিন্তু এই আরোগ্যভূমিটি কোথায়! যেখানে কবি কল্পনায় বিচরণ করতে চান। সত্তা যেখানে
নিরাময়ের সন্ধান দেয়। কবি যদি নিজের সঙ্গে কথা বলতে না পারেন তাহলে এই নিরাময়ের
সন্ধান কোথায় মিলবে! যখনই ভেতর দরজাটি খুলে সামনে এসে
দাঁড়াবেন, নিরাময় এসে হাত ধরবে। আমরা বলছিলাম স্ফূট আর
অস্ফূটের কথা। যেখানে জ্যোৎস্না-আলোকিত
নীরবতা খেলছে অন্ধকার নিয়ে। নিরাময় এসে দাঁড়ায় এদের মাঝখানে। শব্দের চলাচল শুরু হয়। অথচ যার কোনও
শুরু নেই, শেষও থাকে না। শুধু প্রবাহিত নৈঃশব্দ্যের
মধ্যে কথার ঝরনা।
কথা তো কত রকমেরই হয়। দুটি শব্দের মিলন আর মিলিত
প্রাণের বাসনায় নিজেকে জাগিয়ে তোলা। জাগরণের ভোর নিয়ে বসা। ঘোরানো সিঁড়িটি অতলে
নামছে আর কথা হচ্ছে দুজনের। যেন মহাকাব্যের আলো ফেলে ফেলে আজও চরিত্ররা কথা বলে। বলছে
–
–
যুযুৎসুর মায়ের নাম কি তুমি জানো?
–এই মহাজগতে নিমিত্তমাত্র জীব। তার নামে কী এসে যায়!
–
তাহলে শিরোনামহীন রমণের মধ্যে তুমি তাকে কতটা পেলে!
– প্রতিটি সৃষ্টির মূলেই রমণের অভীপ্সা। আচ্ছা, অনুভূতির কোনও নাম হয় নাকি!
এই যে অশ্রুপাত বা অপ্রকাশের প্রকাশ সেখানে নির্বাণ আছে
কিন্তু মুক্তি নেই।
রথের চাকা ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে মাটিতে,
ডুবে যাচ্ছে আলো –"পিতার মাংসের আলো"। বেলা যায়। বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকে সূর্য। তার
শরীর থেকে একটু একটু করে খসে পড়ে তেজ-আভা-দীপ্তি-অহংকার। শুধু পাঠ নয়, সেই রাত্রির অষ্টমীর চাঁদের নীচে দাঁড়িয়ে
কেউ আমাদের অনুভব করতে শেখায় মহাবিশ্বের সমস্ত যুদ্ধই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। আর সমস্ত কান্নার রঙ হলো 'উপলব্ধি'। আত্মপ্রশ্নে গড়ে তোলা একান্ত ব্যক্তিগত নির্জনে নিজের
মুখোমুখি হওয়া।
এভাবেই কথারা আত্মজীবনের সংকেত পাঠায়। এভাবেই প্রতিটি আকষ্মিকতার
মধ্যে নামহীন প্রয়োজনের বোধ। সমস্ত কবিরই ভেতরবাড়ির যন্ত্রণা এক, বিষাদ এক। সমস্ত মাতৃত্বের যেমন গর্ভযন্ত্রণা। প্রতিটি আমি বা
আমির আমিত্ব যখন আমিহীনতার দিকে যাত্রা করে তখনই কবিতার মুহূর্তের জন্ম হয়। সে এক
ক্ষরণ। ক্ষরণের তীব্র অভিঘাত বাজিয়ে চলেছে নৈঃশব্দ্যবীণার তার –
কাঠের ওপর
জঙ্ঘা, বাকিটা নারীর; হাঁটলে সম্ভাবনা
উল্টে পড়ে,
তখনই তরল হয়ে যায়
আগুন
লাগিয়ে দেখিনি কতটা পোড়ে
কতটা
সিল্যুট, কুঠার ঘামে না কখনো
আমরাই
ক্লান্ত হই, হাতে ঘষে বিভূতি বানাই
(অনিন্দ্য
রায়)
এভাবেই চোখের বাইরেই ভেতর দেখার প্রক্রিয়াটা শুরু হয়। জীবন ও মৃত্যুর মাঝামাঝি এই
অবর্ণনীয় দশার অন্য কোনও ব্যাখ্যা নেই,
কারণ এর কোনও আকার নেই, বাস্তবতা নেই, অবস্থান নেই। তবু সেখানে দাঁড়িয়ে একজন কবি নিজেকে খুঁজছেন, কথা বলছেন শব্দের সঙ্গে। শব্দ তাঁকে অহমের অরূপবেদনা থেকে অপরূপের দিকে
টেনে নিয়ে চলেছে। বলছে – ওঠো, জাগো, দেখো।
এই অব্যক্ত বেদনাই অক্ষরের নির্যাস।
দেহ, দেহের মধ্যে তমসার ঘরগেরস্তি। যেখানে নির্জনতা এবং কোলাহল মেশামেশি। যেন দুধে জলে
মেশা। এখন দুধ থেকে জলটুকু সরাতে হবে। দুধ ও জল – যে যেমন বুঝবেন। কোলাহল ও নীরবতা, তমসা ও আলো। এরই মধ্যে সৃষ্টির অন্ধকার এসে উৎসার ঘটায়।
অক্ষরজন্মের প্রস্তুতি নেয় সাদাপাতা। কবির আশ্রয়। এই আশ্রয় হলো বীজসত্তা। সমস্ত বিভ্রম মুছে যাবে যখন বীজের মধ্যে মহাবিস্ফোরণের সম্ভাবনা জেগে
উঠবে। দুলে উঠবে শ্রমের অধিবাস নিয়ে ক্ষেত্রভূমি। মিলনের উৎসব শুরু হবে। অর্থাৎ
জাগরণ। অনেকটা সঙ্গমের মতো। প্রতিবার মিলনের আগে আত্মহত্যাঠোঁট চুমু খায় মৃত্যুকে।
এভাবেই রাত্রিময় নীরবতা সামনে এসে দাঁড়ায়। প্রশ্ন করে – কেন মিলনকালে
একবারও মনে হয়নি এই অনামিকা নারীটির নাম জানতে চাওয়াও এক ধর্ম! অন্তত তার অস্তিত্বের সম্মান জানানোর জন্যে !
– আপনি
ভেবে দেখুন অনামিকাও একটি নাম হয়ে ওঠে।
– আচ্ছা,
প্রতিটি আকস্মিকতার মধ্যে কি সৃষ্টির রহস্য লুকিয়ে থাকতে পারে?
এ প্রশ্ন সেই রহস্যজন্মের শুরু থেকেই। মানুষ যেদিন আগুন জ্বালতে
শিখলো। যে কোনও আত্মনিবেদনই হলো সঙ্গহীন আসঙ্গের নিভৃতলোক। কোনও জয় নেই, পরাজয় নেই শুধু খনন আর খনন। আত্মভ্রমণের পথ ধরে কবি খুঁড়ে চলেছেন
আত্মভূমিকে। ভেতর বাহির নিয়ে দুই সত্তার প্রবল অভিঘাত। এই অভিঘাত আসলে কোনও
দ্বন্দ্ব নয়, সংঘাত নয়। একটা চলা রয়েছে, যেখানে আমাদের যাত্রাধ্বনিটুকু বাজে আবহমান মিলনবাঁশির সুরে। তবে সুরটাকে ধরা যায় না সেভাবে। শুধু বেজে যাওয়ার ধ্বনিটুকু কানে এসে বাজে। আমরা
শব্দের মধ্যে নৈঃশব্দ্যের কথা যেমন বারবার বলতে চেয়েছি। নীরবতার আশ্চর্য সরগম
তোলা। কবিকেই সেসব উদ্ধার করতে হয়। এই উদ্ধার হলো এক যাত্রা। জীবন থেকে মহাজীবনের
পথে পাড়ি দেওয়া। যেতে যেতে বহুমিশ্ররাগে,
ছায়াচিত্রের আবহে ফিরে ফিরে দেখা – কে আমি! কেন আমি! কোথায় আমি!
রূপ অরূপের খেলাটা রূপসাগরে অতলডুবের মধ্যে নিহিত। এই জগতের সমস্ত রূপ সেই জলের
ধারণায় অসীম। তার দিকে তাকিয়ে একটা জীবন চলতে চলতে জীবনের মধ্যে মৃত্যুকেও অনুভব
করা যায়। যে পাখিটা এই মাত্র আকাশে ডানা মেলে দিলো তাকে যেমন কবি একটা রূপের মধ্যে
দেখলেন তেমনি অরূপেও দেখতে পারেন। একটা বাইরের, একটা ভেতরের।
আমরাও নিরন্তর ভেতর থেকে বাইরে, বাইরে
থেকে ভেতরবাড়ির কোণে কোণে একটা বোবাসুর তুলে চলেছি। কিন্তু বুঝে উঠতে পারি না তার কোনও পায়ের ছাপ কি
পড়লো! এও জানি না এই যে জীবন
তাকে ঠিক জীবন বলা যায় কী না! একমাত্র কবিই জানেন এই
আপাত পাগলপারা রহস্যজাল কতদূর বিস্তার করে আছে! যার কোনও নির্দিষ্ট অর্থ হয় না। শুধু এক
নিহিতার্থের ঘাট। নিরালা আসন পেতে বসা। কবি
হয়তো কিছুটা উদ্ধার করতে পারলেন। হয়তো এভাবে –
তেপায়ার
নীলে শুয়ে।
সময় গড়াচ্ছে নীচে সান্ধ্যভাষায়
আর এক
অদৃশ্য-পা আমার দোলনা।
শূন্যে টাঙানো
দুলে দুলে
দেখি দূর বজরা চলেছে
নদী বাঁকে-বাঁকে বনের
জানালা।
তীরের প্রবাহে ভেসে গহনশ্মশান
(সমীরণ ঘোষ)
এই নিহিতার্থের ঘাটটি কি দেখা যায়!
কিন্তু তার অস্তিত্ব বর্তমান। তবে একে ঠিক গন্তব্য বলা যায় না। অগন্তব্যের অন্ধকার
রাত্রির হাড় বাজিয়ে মহাভোজের প্রস্তুতি নিয়ে চলেছে। রণক্ষেত্র বেদনার্ত হচ্ছে।
তারই মধ্যে আলো বয়ে ফিরছেন একমাত্র কবি। শ্মশানের গহন জুড়ে সেই মহাভোজের আরতি
চলছে। এই মহাভোজ হলো নিস্তব্ধতার সমারোহ। শব্দের মধ্যে যেমন নৈঃশব্দ্যের আরোহণ, এ তারই এক
অরূপমাধুরী।
তিলমাত্র কথার ভেতর যেমন এক বিস্ফোরণের আবহ,
তাকে অনুভবের শ্রম চিতার মতো জ্বলছে, অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিচ্ছে। নিরাভরণ
অগ্নি সেই সমারোহকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলছে তার নিরাকার অবিরোধ দিয়ে। এভাবেই
শবযাত্রা থেকে শব্দযাত্রায় আমাদের পথ আলোকিত হয়। প্রকৃত বিস্ময় মেলে ধরে তার রূপের
বৈভব।
এতো এতো অপ্রসঙ্গেই এসে পড়ে ছায়াপথের কথা, ছায়ার ঘূর্ণি। যেখানে শব্দ, বর্ণ আর ধ্বনি মিলে উৎসবের সাজ। হাহাকারের মধ্যে জীবিতের
কঙ্কাল কথা বলে। শূন্যের মাঝখানে আরও শূন্য হয়ে দুলতে থাকে। কবি দেখছেন কুয়াশার
ভেলাটা ভাসছে। জগৎ সম্পর্কে যাবতীয় মোহ, তাপ,
অস্থিরতা কখনও ভেসে ভেসে, কখনও
পায়ে পায়ে
এগিয়ে চলেছে। চরাচর জুড়ে মায়া। দুহাতে আগলে রাখা রাত্রির নীরবতা। যেন আমাদের সমগ্র মনোভূমি ও বস্তুভূমি জুড়ে এক
শিশুর পদচারণা। হাঁটছে ঘুঙুর পরা পায়ে আর পৃথিবীটা দুলে দুলে উঠছে। রহস্যময় এই জগৎ, ব্যাখ্যাতীত অন্ধকারের মধ্যে সে আলোময়। আসলে শব্দের একটা নিজস্ব দর্শন আছে, আলোর আত্মীয়তা নিয়ে এই বোধ সবসময় বিপরীতমুখে ছুটতে চায়। আমাদের নতুন নতুন উদঘাটনের দিকে ঠেলে দেয়।
প্রকাশ করতে চায় অব্যবহৃত সম্পর্কগুলো ।
এই অনন্ত রহস্যের মধ্যে সমস্ত ভেদ-অভেদ একই সঙ্গে স্পষ্ট
এবং অস্পষ্ট।
অনেক আলো অনেক অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে অনেক রাত্রি এবং দিন ফেরি হয়ে যাচ্ছে
নিহিতার্থের ঘাট বেয়ে। দূর থেকে হাতছানি দিয়ে এক একটা ডাক কখনও নিবিড় হচ্ছে, কখনও ধোঁয়াশা। একান্ত পরিসরে নিভৃতের কোলে মাথা রেখে কবি
দেখলেন আর কোনও প্রভেদ থাকছে না শূন্য এবং অশূন্যের।
কবির জীবন এমনই। যতটুকু বাঁচা
তা শুধু নিজের। এই জীবনপ্রবাহ তো প্রলাপ
মাত্র।
প্রলাপের বাইরে এই আমি – নিরবয়ব আমির আর কোনও ঠাঁই নেই, আশ্রয় নেই।
ঘর নেই, সংসার নেই। এক অপার নৈঃশব্দ্য লিখে চলেছে
তাকে। আর তাকে যে পড়ছে সে-ই শুধু
জানে এই নীরবতার মানে, বিষাদের মানে। একটা শরীর থেকে শেষ গন্তব্যের আলো মিলিয়ে গেলো। আত্মজিজ্ঞাসার
ছেঁড়াপালে লাগছে তিরতিরে হাওয়া। ভাসছে আলো আলো ছায়া ছায়া অক্ষরের গান। ভাসতে ভাসতে
এগিয়ে চলেছে। শূন্য নিয়ে। সিঁড়িটা নেমে যাচ্ছে আরও গভীর শূন্যের দিকে। মাঝে মাঝে
প্রকাশিত হচ্ছে কৈশোরের মাঠ ঘাট, বাঁশবন,
জোনাকির মিহিতান।
সবই যেন অপ্রকাশের প্রকাশ হয়ে ওঠে। একে কি নৈর্ব্যক্ত বলা যায়! নাকি অব্যক্তের প্রবল ব্যক্ততা! …