ত্রিমূর্তি : স্পেস এন্ড দ্য ফোর্থ ডায়মেনশান
প্রথম মুখঃ সব্যসাচী ও তার ল্যাবরেটরিতে
সম্ভাব্য টিলিবিসিপ
এক
হাতে গান উঠছে - প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে আরো আরো আরো দাও প্রাণ। অন্য হাতে ফুটছে
টিলিবিসিপ। দুহাতেই নিহিত শিল্পের বিভঙ্গ। উলটে পালটে দেখতে গেলেই দৃশ্যে বেজে ওঠে
অপার সম্ভাবনার সুর। প্রচ্ছদ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আঙুলে উঠে আসে পসিবিলিটির মুখ। ব্যাপক
উচ্চারণের মুখ। যেন কোনো কবিতাগারে আবিষ্কারের উল্লাস। যেন কোনো উপসনালয়ে শব্দউৎসব
শুরু হয়েছে। এক বিস্তীর্ণ উন্মুক্তির উদ্ঘাটন। বিশ্বপ্রবাহের কেন্দ্রে বসে কবি সব্যসাচী হাজরার অনন্য এক
কবিতা উন্মাদনা-
দান্তের
পয়লা-বৈশাখে
দান্তের বয়স এখন
‘+;-;*;/’
ডিসিশন
ইকুয়েশনের চেলো
ঠুন
ধিক
দুই-মা
ফ্রিক
স্বামী
ধিন
আজান
হিং
হ্যাশ
খুলি
আধুলি ধুলি লি
জাতিস্মর
আমাকে লিও করে রাখে
ব্যানার্জীর
আদরে
ইনকায়
ডাকতে র হো
জাগতে র হো... (দান্তের পয়লা-বৈশাখে-১৪)
পাঠক
আপনি ইকুয়েশন নিয়ে জাগতে থাকুন (সামান্য সূত্র - ২০১৪ এ বসে সংখ্যাগুলো নিয়ে যোগ
বিয়োগ গুণ ভাগ করতে থাকুন, হাতে উঠে আসবে দান্তের বয়স ৭৪৯)। আমি ভাবি কেন দান্তে
কেন পয়লা বৈশাখ? ফাদার অফ ইতালিয়ান ল্যাঙ্গয়েজ, ও তার শুভারম্ভ। টিলিবিসিপেও যে
জন্ম শুরুর ইঙ্গিত। জন্ম নিচ্ছে এক নতুন ভাষা। কবির কলমে লেবার পেন। এক নতুনের
আবাহনে মেতেছে বাংলা ভাষা। কবি যে বানান সেঁকে খান আমি তার ধ্বনির আত্মবৃত্ত খুলে
খুলে বাজাই। বাজাতে থাকি। বাজাতে থাকি। কেন যে কানে গান ভাসছে – সখি ভালোবাসা কারে
কয়... এই তো এই তো ভালোবাসা – ভাষার প্রতি কবির ভালোবাসা, শব্দের প্রতি কবির
ভালোবাসা। যাকে এমন করে ভালোবাসা যায় তাকেই তো এমন করে বাজিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। এমন
করে নাড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে। ওই শুনি যেন চরণধ্বনিরে শুনি আপনমনে...
সবুজ
সবুজ চেকে
ওদিকে দেখি না, দেশলাই ভূমিকম্পে বসে আছো...
ফিতে মাপা চিৎকার
লাট্টুতে ঘুরছে চিড়িয়া,
অবাধ পেয়ারায় ঘুমিয়ে থাকল যারা
বেঁটে
বেঁটে লোটাদের কোল...
অনাব্রেক,
চৌকো অথচ ভি
দুঃস্থ
দুঃস্থ কাকলির চাপ,
কত খুঁড়ে আবলুশ পাই
দুটো দিলখুশ
বালিশে ঝিমোয়... (চৌকো অথচ ভি-২১)
এই
যে কবির আপনভোলা খেলা, এর কোনো নিয়মাবলী নেই। সাফল্যের জন্য চিৎকার নেই। অসাফল্যের
জন্য হাহাকারও নেই। উদ্দেশ্য খুঁজতে গেলেই আঙুলে জড়িয়ে যায় উদ্দেশ্যহীনতা। প্রতিবাদ
বলতে গেলেই অপ্রতিবাদ মাথা তুলে দাঁড়ায়। এ এক অনির্দেশ্য যাত্রা। নিয়মভাঙার খেলা।
ধর্মাধর্ম একাকার করে এক আত্মজগৎ। অসংলগ্ন তার আত্মনিবেশ। সৃষ্টি অভিমুখি এক
অনাসৃষ্টির বৃষ্টিমুখর চঞ্চলতা। স্বীকারেও নেই। অস্বীকারেও। আবার গান উঠছে হে...
আমি চঞ্চল হে আমি সুদূরের পিয়াসি... এই যে পিয়াস, এই যে অপার উধাও সম্ভাবনা তারই
ভেতর ফুটছে টিলিবিসিপ। সংলগ্ন ভাষা থেকে কবি ধ্বনিকে ছুটিয়ে দিয়েছেন অসংলগ্ন
অনিঃশেষ যাত্রার দিকে। দূরে কোথায় দূরে দূরে সেই পসিবিলিটি ডাক দিয়েছে –
পসিবিলিটি
ও নম্বর একটি টিলিবিসিপ,
মাসুদা ছুঁলেই রম্বন ওঠে থঁ পায়
পাহাড়ীদের
নেকুয়া
ঢলায় কুঁয়ো জুড়ে
এবার মনাই ঘুরলো কুড়ি বার... বার কুড়ি নয়
২কৃষ্ণা৩ আজ চতুর্থবার
ভীম + নিউট্রন কেননা পার্থ’র খোঁজে… (২০ ১২ ৯ - ৬২)
কবি
হিলিয়াম-৩কে বেছে নিলেন কেন? আবার সেই পসিবিলিটি। ওইখানে যে ফিউসানের অপার
সম্ভাবনা। আগামী আলোর সম্ভাব্য টিলিবিসিপ। হেবি হাইড্রোজেন, একটা নিউট্রন – আহা
সেই অনন্ত শক্তির খোঁজ। পাঠক আপনি বিজ্ঞান ছেড়ে কাব্যও ধরতে পারেন। মহাকাব্য।
পঞ্চস্বামী পরিবৃত দ্রৌপদী। দুটি কোলের- নকুল সহদেব। তিনটি মাথার মুকুট-যুধিষ্ঠির,
ভীম, অর্জুন। হেবি ওয়েট ভীমকে কতবার (হয়ত চারবারও হতে পারে) ব্যবহার করেছেন
পার্থের আশায়। ওইখানে যে তার আকাঙ্ক্ষা। এ সবই পসিবিলিটির ধারণামাত্র। কেন না কবির
ল্যাবরেটরিতে হয়ত অন্য কোন টিলিবিসিপ। কবি যে আমার তোমার এই সমস্ত রংকে নিজের রঙে
অত্মবিলীন করতে চান। বিন্যাস থেকে অবিন্যাসের জোয়ারে ভেসেছেন। আহা সেই ধ্বনিমগ্ন
নিরুদ্দেশের যাত্রী দূরে কোথায় দূরে দূরে, আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে...
দ্বিতীয় মুখঃ পারদের সোমনাথ শাসন
ও তার তাপমাত্রা
নির্জনতা
মুছে ফেললে একটা শাসন আরও তীক্ষ্ণ হতে থাকে আর ওইপারে চড়তে থাকে কবি সোমনাথ সেনের পারদস্তম্ভ। লাল দাগে পৌঁছবার আগেই নিশ্চিহ্ন করে
ফেলে নির্জনতা। নৈঃশব্দ্যের শব্দ ওঠে না আর। অথচ শব্দের কাছেই আমাদের যেটুকু আশ্রয়
যেটুকু নিরাময়। এক টুকরো নির্জনতা।তুমি তো কৃপণ নও প্রভু। তবু কেন এই ঝনাৎকার।
বাহুবলের। বুদ্ধিবলের। কীভাবে এই অনুপ্রবেশ কীভাবে এই বিভাজন। শাসনের নিচে যতটা
অনাস্থা ততটাই জরুরি অবস্থা।অবস্থানের বিস্ময় মুছতে মুছতে জড়ো করে তুলছি এই জীবন,
আভূমি নতমুখ আর অনুভূমিক জল বা জলকেন্দ্রিকতা।
আর
তুমিও হরফ পালটে উন্মুক্ত শরীর দেখালে সারাদিন। পরিখার আশেপাশে জমে ওঠল প্রবাহের
জলকণা। যেনবা বৃষ্টিপাতের ধারণা থেকেই এই খনন। কিছুটা আত্মগোপনের হরফ। অথচ
উন্মুক্ত করলেই একটা ধ্বংসস্তূপের ধারণা, যেখানে পরিবর্তিত হয় মাটি আর সূর্যাস্তের
রং। যেন এই আত্মগোপনের অন্ধকার থেকেই বিস্তৃত হয়ে পড়ছে ক্যামোফ্লাজের আড়াল।
জলছাপের দাগে ঘনিয়ে উঠছে পৃথিবীর ঠিকানা। যে ঠিকানা হাতড়ে বেড়াচ্ছে স্মৃতি আর
পিচ্ছিল রক্তপাতের মুখ। শহরকেন্দ্রিক এই আরামকেদারা আর শরীরকেন্দ্রিক এই হরফ
পালটাতে পালটাতে ক্রমশ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে আঘাতের দিকে। আয়নার ধারণা থেকে জমে উঠছে
ঘুমজ্বর। ঘুমন্ত শহরের শীত ভেঙে জেগে উঠছে লিঙ্গ, বিস্তৃত হয়ে উঠছে যৌনতার
ক্যামোফ্লাজ।
শুধুমাত্র
কাচ নামানো ছিল বলে এতক্ষণ বুঝতে পারিনি নিষ্ক্রিয়তা। একটা শূন্য থেকে আরেকটা
শূন্য পর্যন্ত এই নিষ্ক্রিয়তা আর একটা তাপপ্রবাহের পর গুটিয়ে যাওয়া স্নায়ুপ্রবাহ
জন্মান্তরের প্রশস্ত মুহূর্ত। যেখানে এক বিম্বিত মুখ ঢলে পড়ে প্রতিবিম্বের দিকে। পারদের
গায়ে লেগে থাকা শাসন থেকে উপচে ওঠে অনিয়মের পরিচর্যা। যেন অবস্থান পাল্টালেই
স্নায়ুপ্রবাহে উন্মুক্ত মুখ ঠেলে দেবে হিংস্রতার দিকে। আর ক্রমশ নিষ্ক্রিয় হয়ে
উঠবে ঝুলন্ত সেতু পেরোনো স্বাভাবিকতা।
এখানে
আরও একটা মসৃণতা গোলাকার হতে থাকে। আর অমসৃণ পরিখা থেকে উঠে আসে এক বৃত্তের আড়াল।
যেখানে পরিবর্তিত হয় আমাদের অবস্থান। আসলে পূর্ণতা এক অলীক ধারণামাত্র। প্রাপ্তির
আকাঙ্ক্ষায় শুরু হয় আমাদের আঁধার আর ব্যক্তিগত অনুচ্ছেদ। অণু থেকে উন্মুক্ত হয়
যেসব অনুরণন তাদের অবস্থানগুলো এমন আপেক্ষিক এমন সূত্রহীন যেন গাঁথতে বসলেই
অনিশ্চয়তার দিকে আরো এক পা। আমি সাবমেরিনের পথেঘাটে ন্যটিক্যাল মাইলের নিয়ন্ত্রণ
খুঁজি। কম্পার্টমেন্টের তালিকায় তখন চাপের অন্তর্বাস। আর অন্দরমহলে ক্রমশ বেড়ে ওঠে
তাপপ্রবাহ। অণু ভাঙতে ভাঙতে ক্রমশ আইনস্টাইনের আলোয়।
আমাদের
প্রচেষ্টা বাড়তে থাকে প্রিয় বলয়ের দিকে। যেখানে আলো থেকে খুলে যায় আঁধারের
জ্যামিতি। জ্যা টেনে টেনে একটা পরিখা খুঁড়তে থাকি। জলজ পরিধি ঘিরে পরিস্ফুট হতে
থাকে গোপন অবয়ব। স্পর্শযোগ্য হতে থাকে আত্মবীক্ষণে। আলোকে আধেয় বললে শরীরী
শব্দগুলো পেরিয়ে যায় নিরুত্তাপ সুড়ঙ্গ। ভাঁজে ভাঁজে জমতে থাকে লীনতাপ। গ্রহণকালের
গর্ভদশা কাটতে থাকলে আমরা পৌঁছে যাই অনুভূতির শীর্ষে যেদিকে প্রিয় বলয় প্রিয়
স্মৃতির আলোকপ্রপাত।
স্কার্ট
তুলে যেই দেখালে একটা ব্রহ্মাণ্ডের করুণ আকুতি। এক মহাশূন্য অস্থিরতা টলমল করে উঠল
ঘর্মাক্ত কোষের কক্ষে কক্ষে। রক্তকণিকার মুখ ঘুরে গেল ঈশ্বরকণার দিকে আর পরিমাপে বসল
অবস্থানের ভারসাম্যগুলো। যেন ওই জন্মকণার উৎসমুখেই লেগে আছে আমাদের পরিচয়পত্রের
ঘ্রাণ। যেন ওই দুরন্ত কণার যাত্রাশেষেই বিবর্তনের বিকেল বসবে। যেখানে আমাদের
একান্ত আলাপচারিতা। যেখানে আমাদের আধেয় ঘিরে জলজ সমাগম। স্থবির প্রাচীর ভেঙে তিরতির
কেঁপে যাবে শব্দতরঙ্গ।
এক
এক করে খসে পড়ে নক্ষত্রের বিলাপ। আর মন্থনপাত্রে ছায়া এসেপড়ে। ঐ যে হেঁটে আসছে
আঁচল, এক বিপজ্জনক ঢেউ তুলে ক্রমশ ঢলে পড়বে হৃদয়রহস্যের দিকে। যেভাবে সম্পর্ক এক
অপ্রত্যাশিত অভিনয় থেকে প্রত্যাশিতের দিকে। আড়াল থেকে অনেকটা ভেতরে, এক উন্মুক্ত
নগ্নতায়। আর এভাবেই অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়বে আমাদের অভিজ্ঞতাগুলো। প্রত্নগুহার
উপস্থিতি পেরিয়ে শুরু হবে এক রহস্যযাত্রা। যেন খুব প্রাসঙ্গিক এই নীলজল দিগন্ত
ছুঁয়ে দূর, আর সুদূর থেকে হেঁটে আসা নারকেল গাছের বিকেল।
এই
অবসাদ প্রসঙ্গে তোর স্মৃতিচিহ্ন পরিস্ফুট হয়। আর স্মৃতির ভেতর লুকিয়ে পড়ে এক
বিরামহীন বৃত্ত। বৃত্ত ভেঙে তুই উপমা হলেই খুলতে থাকে সত্ত্বাচিহ্ন।আমি পাহারায়
থাকা পাঁচিল থেকে খুঁটে তুলি শ্যাওলার সবুজ। তোর মুখাবয়বের নিচে নগ্ন মোমবাতির
নিঃসঙ্গ আলোতে দেখি খসে পড়া জানলার অবশ্যম্ভাবী দৃশ্যসকল।
আর
সেই প্রলেপ থেকে একে একে দারুচিনি গাছের ফাঁক দেখা যায়। তার ছায়ার সর্বাঙ্গীণতায়
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে ওড়নার রং পাল্টাতে থাকে। পাল্টাতে পাল্টাতে সম্ভাবনার করিডোর
থেকে ওই দারুচিনি সকাল তার সময়চিহ্ন মুছে হেঁটে যায় উদ্ভাসনে। বিলুপ্ত বাগানের
অবস্থান সম্পর্কিত দ্বন্দ্বের ভেতর সম্ভাব্য যৌনতা ও তার অস্থির উচ্চারণে নিঃসঙ্গ
অণুবীক্ষণ। এ সবই এক রূপান্তরের গল্প বলে। এক দরজা খোলার মুহূর্ত। প্রসারিত আকাশের
বিশ্বপ্রবাহে এক আবহমানের অন্তর্লীন শিকড়। সম্ভাবনার নিকটবর্তী আড়াল থেকে প্রখর
হয়ে ওঠে অনিবার্য দাগ।
কবির
আত্মগোপনের পরিখা খুঁড়লে আঙুলে উঠে আসে যে পঙ্ক্তিগুলো -
নির্জনতা
মুছে ফেললে একটা শাসন আরও তীক্ষ্ণ হতে থাকে
আর তুমিও হরফ পালটে উন্মুক্ত
শরীর দেখালে সারাদিন
শুধুমাত্র কাচ নামানো ছিল বলে
এতক্ষণ বুঝতে পারিনি নিষ্ক্রিয়তা
এখানে আরও একটা মসৃণতা গোলাকার
হতে থাকে
আমাদের প্রচেষ্টা বাড়তে থাকে
প্রিয় বলয়ের দিকে
স্কার্ট তুলে যেই দেখালে একটা
ব্রহ্মাণ্ডের করুণ আকুতি
এক এক করে খসে পড়ে নক্ষত্রের বিলাপ
এই অবসাদ প্রসঙ্গে তোর
স্মৃতিচিহ্ন পরিস্ফুট হয়
আর সেই প্রলেপ থেকে একে একে
দারুচিনি গাছের ফাঁক দেখা যায়
পাথরের সামনে এসে দাঁড়াই
শেষরাতে আদরের গতিপথ বেয়ে নেমে
আসে রুমালের দাগ
তবুও তো এক অভাবনীয় কার্নিশের
ওপর পাল তুলে দিলাম আমরা
শেষ
রাতে আদরের গতিপথ বেয়ে নেমে আসে রুমালের দাগ
ছুরিতে
লেগে যাচ্ছে মাংস রান্নার দাগ
এই
জঙ্গল, এই ঘুমভাব কাটিয়ে অনেকটা ফিরে আসা
তৃতীয় মুখঃ নেমেসিস ও অর্জুনমঞ্চ
সীমান্তবর্তী
যুদ্ধ ও মর্টারের শব্দ প্রথম অবস্থান আর সেখান থেকেই টেবিল ও খাতার সঙ্গে সংঘর্ষ
দ্বিতীয় জেগে থাকা। ছুটন্ত ট্রেনের হু হু হাওয়ার মধ্যে জেগে উঠছে দ্বিতীয় অবস্থান,
শোকের চিহ্ন নিয়ে সাইপ্রাস গাছের শাখা। খুব ব্যক্তিগত, খুব একান্ত এক সলিটারি সেল
থেকে জেগে উঠছে কবি অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেমেসিস। কার পাপ
কার মৃত্যু কার প্রতিশোধ। আমি সেই দ্বিতীয় অবস্থান থেকে সাপেদের ঢলে পড়া দেখি। আর
সেই সীমান্ত যেখানে ছড়িয়ে আছে গ্ল্যাডিয়েটারের বর্ম আর সীজারের ছায়া। সেই
ধোঁয়াদেশে অবাক কবির অপরিহার্য দ্বন্দ্বমুখর তন্ময়তা। কবিরই তো থাকে এই অন্তহীনতা
আর তার একান্ত নিভৃতি। এইখানেই জেগে ওঠে উপমহাদেশ আর তার মেঘমরিচার আলো। এই
দ্বিতীয় জাগরণ থেকে নড়ে ওঠে রুমাল। কোলাহলের দিকে তাকিয়ে থাকা টেবিল থেকে এক
অভাবনীয়ের বীজমন্ত্র।
খোঁজ।
এক অপরিকল্পিত অন্বেষণ। কীসের খোঁজ কবি জানেন না। সামনে খোলা থাকে শুধু
আর্কিমিডিসীয় খাতা যেখানে অপেক্ষা করে আছে এক আত্মমগ্ন আবিষ্কার। কবির যাত্রা
রাতভর্তি নৌকো নিয়ে। কোথায়। জানা নেই। তবু সেই যাওয়া। আগুনের স্কেচ থেকে রণজিৎ
দাশের বাঘ থেকে নিরীহ ব্যাথ্যা থেকে অ-নিরীহ ঘটনা থেকে যাওয়া এবং যাওয়া। নিরুদ্দেশ
চলন অথচ জাগ্রত নিবিষ্টতা। এমন নির্মোহ ছবি যেখানে কোনো রঙের প্রলেপ নেই। অথচ
জীবনযাপনের সিঁড়িগুলো জেগে উঠছে নগ্ন স্কেচে। রেখা থেকে অরেখায় যাত্রা। অক্ষর
ফুটছে আবিষ্কর্তা গুটেনবার্গের প্রিন্টিং মেশিনে। অশব্দে শব্দ বসাচ্ছে ১০৫
খ্রীষ্টপূর্বাব্দের শাইলুন -
ফাঁক দিয়ে পুকুরে
যাওয়া, আর যে ঠোঁট জোড়া, ফুটবলবাবু তুমি জানো তার মহিমাও আছে। পুণ্যতোয়া লোশন
তোমার দরজা অবধি যায়। যেতে যেতে পৌঁছে দাও শাখা, ভাড়াটিয়া দিন। আর আমার টেবিলে
পুকুর... (নেমেসিস-১৬)
সাইকোলজির
ডাক্তারের চেম্বারে বসে কবি এক দ্রুত অপস্রিয়মাণ দৃশ্যের
মুখোমুখি। উড়ে যাওয়ার বিভঙ্গে রচিত হচ্ছে কল্পজগৎ। সেই কল্পলোকের নিঃসীম নির্ভারে
দৃশ্য ও বস্তু একাকার। নিঃসঙ্গ যাত্রা আলো আলো করে পৌঁছে যায় আরো গাঢ়তম অন্বেষণে।
গভীর নিস্তরঙ্গ শূন্যতায় আমলকি গড়িয়ে যায়। গড়াতে গড়াতে নির্বিকার অচৈতন্যে স্থির
হয়ে ওঠে ব্যথার শব্দ। কাব্যের ব্যথা। দোঁহারের পদ। পদাবলী। যেন খুব অর্থহীন
উন্মাদনা। যেন খুব অস্বাভাবিক আত্মনির্মাণ। অথচ অর্থকে উপেক্ষা করলে, স্বাভাবিকতাকে
পিছনে ফেলে এলে অনুভূতির কম্পাঙ্কে রণিত হয় এক ধ্বনিমুখর রহস্যলোক। যার পরতে পরতে
জীবনগন্ধ মাখা সোহিনী সুর। আর সেই সুরের আবহে শুরু হয়ে যায় কবির গল্প। খুংখার
পিরানহার লোভে পড়ার গল্প। মঞ্চালোকে নির্মিত হচ্ছে কার্নিশে ঝুঁকে থাকা এক নিবিড়
সোনাটিয়া যাপন। সে দৃশ্যের শুধু মুখটুকু আলোকিত। আর বুকের ভেতর নিঃশব্দ দ্রিদিম।
দ্রিম দ্রিম। আলোকিত অবাস্তবের ঘন্টা বাজছে। শুনতে পাচ্ছি সেই তন্ময় অন্বেষণের
মন্ত্র –
...ছায়াকে ডালিয়া বলি...
...সেতুকে মধ্য বলি...
...পরতে উচ্ছাস বলি...
...মুকুলে দক্ষিণ বলি...
...সোলোকে রাত্রি বলি...
...রোদকে মাধব বলি...
...ফিরৎকে ছুটবি বলি...
...জীবনকে গোঁসাই বলি... (নেমেসিস-১৬)
প্রত্যাবর্তন
অর্থাৎ ফেরা। যেন প্রতিটি যাত্রাই শুরু হয়েছিল এই একান্ত ফেরার স্বপ্নে। যেখানে
বসত রয়েছে গড়ানো। যেখানে বনবাস সচল রাখার টেনশন। আর সেখান থেকেই স্পার্ক। মাথার
বাসায় জমাট স্পার্ক। সেমিকোলনহীন। কমাহীন। মাঝিমাল্লাহীন নৌকো। কবিকে শেষমেশ উঠে
পড়তেই হয়। তারপর স্পার্কিত সংসারে ডুব দেয় আ-গ্রাস। গ্রাসে গ্রাসে হাওয়াবাহী কাগজে
নামে লিপি। উড়ে যায় উড়ে আসে অবয়বহীন প্রাণের গন্ধ খুঁজে। বস্তুর প্রতিটি মৌল সত্তা
একে একে জড়ো হয়ে ওঠে অতি স্পর্শসচেতন বাড়ির ভেতর। যেখানে ফেরা। দৃশ্যের প্রতিটি
রেখা প্রতিটি স্কেচ নির্মিত হয়ে ওঠে নিরপেক্ষ তন্ময়তায়। যার বীজ অবধারিত নিহিত ছিল
সামগ্রিক অস্তিত্বে। এই সমগ্রতায় অন্তর্লীন কবির যাওয়া। কবির ফেরা। একাগ্র
নির্নিমেষ সেই চলন। উদ্দেশ্যহীন নিরুদ্দেশ চলন। যার কেন্দ্রে কখনো ঝলকে ওঠে
নীলাভবর্ণের ভুল কখনো অমূর্ত দ্যুতি কখনো গোপন রহস্যের ইঙ্গিত। আর সেই অন্তহীন
প্রাণস্রোতের জোয়ারে কবি দেন –
দরজাকে জামরুল কথা
মজাকে জরুরির কথা
কুৎসাকে খগোল কথা
যাবতীয়কে গভীর কথা
ভিতরকে বাহির কথা
কফিনকে ঝলক কথা
প্রস্তুতিতে কিচির কথা
চড়াইকে মিচির কথা
দ্বন্দ্বকে যাহোক কথা
ছুটিকে তপোবন কথা
থতকে মতোর কথা
ঠুঁটোকে জগন্নাথ কথা
আর কষ্টকে যাঃ... (নেমেসিস-২০)
জীবনমঞ্চ
জুড়ে এক নাটক অভিনীত হয়ে চলেছে। আমরা সবাই এক একজন কুশীলব। কারোর মাথায়
ভায়োলেট শাওয়ার এসে পড়েছে। কারো মুখে মেদুর হয়ে উঠছে সবুজ বেবী। আমাদের নাটক চলতে
থাকে। ঘুরে ঘুরে যায় এক অপরিসীম বৃত্তে। উড়ে উড়ে যায় তার অনির্ণেয় বিন্যাস। খুলে
খুলে যায় তার অনির্দেশ্য লক্ষ্য। আর সেই খেলা শুঁকে শুঁকে চোখের নীচে
সমীরণ এসে নক্ করে হাওয়া। মঞ্চ জুড়ে দীর্ঘ হতে থাকে তার ছায়া। স্টেজের পর্দা নেমে
এলেও অভিনয় কিন্তু শেষ হয় না। কথা বলতে থাকে এক অন্তর্লীন জেগে থাকা। গমগম করে ওঠে
তার প্রতিধ্বনি। এলোমেলো উতরোল উচ্ছ্বাসে ঋজু দাঁড়িয়ে থাকে নিরবধি সময়। পায়ে তার
নিমগ্ন স্তব্ধতা। জিনজার সীমা ফেলতে চায় তরণী শেষে। উদাসীন অন্যমন অনর্থে আগুনে।
বাড়ি ফেরার সময় হয় যেখানে দরজা খোলার কোনো প্রতিষ্ঠিত ডোরবেল নেই। সমস্তটাই
ঘোষনাহীন আত্মজাগরণ। অস্বীকৃত অনিশ্চয়ের দিকে অলীকভ্রমণ।
যে কবিদের গ্রন্থশালায় আমার এই ফিরে দেখা তাঁদের সংক্ষিপ্ত
পরিচয়-
সব্যসাচী
হাজরাঃ জন্ম ১৯৮৬, পেশা শিক্ষকতা, শখ কবিতাপাঠ ও গান শোনা, প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ-
তৃতীয় ফ্লাওয়ার শো(২০১০), ওভ্যানোর ওভেনে(২০১১), পসিবিলিটি ও টিলিবিসিপ(২০১৩),
উটবিকার(২০১৫), ৯ আঁকা ০(২০১৬), আনুপাহাড়ের জলছবি(২০১৭)। কবি মনে করেন “লেখায়
অনুভব ও পর্যবেক্ষণ বেজে ওঠার প্রয়োজনীয় তরঙ্গটুকু থাকা দরকার
কারণ এগুলোই পথ, যার লোকাস লেখকের মগজে। বেজে ওঠা যেকোনো সৃষ্টির ক্ষেত্রে একমাত্র সাধারণ যোগাযোগ। বেজে ওঠার তারটাই মস্তিষ্কে বাঁধা। আর সবকিছুর ওপরে নতুনের দাবি। লেখার আনন্দই লেখালেখির সম্পদ। সেই আনন্দ যদি
লেখায় ছড়িয়ে থাকে তবে একজন না একজন তা টের পাবেই। রচনার রহস্য আর দেখার বিস্ময় ফুরোলে সৃষ্টি ফুরোয়”।
সোমনাথ সেনঃ জন্ম ১৯৮৩, বিজ্ঞানে স্নাতক। জন্ম বাঁকুড়ায়,
বর্তমানে কলকাতাবাসী। কলেজ জীবনেই কবিতার সংস্পর্শে আসা। তারপর চাকরিসূত্রে দেশে
বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় ক্রমপরিবর্তনশীল স্থান-কাল-সমাজের ভাবাবেশেই পরীক্ষা
কবিতার হাতেখড়ি। আন্তর্জালে ও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি শুরু। প্রথম বই পারদ
শাসন (২০১৪)।
অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়ঃ শূন্য দশকের কবি, গল্পকার ও
অনুবাদক। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ-২০ মিনিটের
জন্য সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়, উন্নয়ন বিরোধী যেসব ক্রিয়াকলাপ এখন শহরে হচ্ছে(ইবুক);
বাংলা-লেখা সংকলন- ডাক্তারকে যা বলেছিলাম, সারং থেকে জৈতকল্যাণ যত দূরে;
গল্পসংগ্রহ-ডি মেজর; অনুবাদ- খাঁচার ভেতর খাঁচা (মহসিন মখমলবাফের নাটকের অনুবাদ)।
ধারাকবিতার বহুকিছুকে গরিমায় বহন করেও নতুনের দিকে চ্যালেঞ্জ ছোঁড়া শব্দস্রোতে গড়ে
তোলেন নিজের বিমূর্ত পৃথিবী যেখানে নাগরিক দ্বন্দ্ব, সামাজিক জটিলতার স্পর্শ থাকে
বিনির্মিত ভাবনায়। অথচ সে কখনও উচ্চকিত নয়, দার্শনিকতার ভারে ন্যুব্জ নয় বরং
ক্রমাগত নতুনের সম্প্রসারণ ভাবনায়, চেতনায়।