শুক্রবার, ১ নভেম্বর, ২০১৯

<<<< সম্পাদকীয় >>>>




কালিমাটি অনলাইন / ৭২


গত ২১শে অক্টোবর ছিল আজাদ হিন্দ ফৌজ দিবসের ৭৬তম বার্ষিকী। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দিনটি পালিত হয়েছে। যেমন জামশেদপুর শহরেও পালিত হয়েছে ‘মিলনী’ মঞ্চে ‘সুভাষ সংস্কৃতি পরিষদ’ এবং ‘মিলনী’র যৌথ উদ্যোগে। ‘সুভাষ  সংস্কৃতি পরিষদে’র সদস্য-বক্তা রূপে আমিও এই অনুষ্ঠানে বক্তব্য রেখেছিলাম। বক্তব্য রাখার আগে পর্যন্ত অন্যান্য আমন্ত্রিত বক্তাদের যে বক্তব্য শুনলাম, তাঁরা প্রত্যেকেই খুবই ভালো বলেছেন, কিন্তু তাঁদের যাবতীয় বক্তব্য ছিল নেতাজী কেন্দ্রিক। অর্থাৎ আজাদ হিন্দ ফৌজে নেতাজীর নেতৃত্ব, পরিচালনা, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কিত আলোচনা ও বিশ্লেষণেই তাঁদের বক্তব্য সীমাবদ্ধ ছিল। এবং এই আলোচনা ও বিশ্লেষণ অত্যন্ত তথ্য ও তত্ত্বপূর্ণও ছিল। কিন্তু আমি বিস্মিত  হয়েছিলাম অন্য কারণে। কোনো বক্তাই আজাদ হিন্দ ফৌজ বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর নাম উল্লেখ করলেন না। এবং শুধুমাত্র এই আলোচনা সভাতেই নয়, আমি লক্ষ্য করেছি, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের আলোচনায় বিশিষ্ট কয়েকজন বিপ্লবী ও স্বাধীনতা সংগ্রামীর কথাই উচ্চারিত হয় বারবার,  বাকি অধিকাংশ ব্যক্তির নামই থেকে যায় অন্তরালে বা অন্ধকারে। সাধারণ মানুষ জানতেও পারেন না তাঁদের লড়াই ও আত্মবলিদানের ঐতিহাসিক আলেখ্য। এটা সত্যিই খুব বেদনার কথা।

আমি তাই সেদিনের বক্তব্যে রাসবিহারী বসু সম্পর্কিত কিছু তথ্য রেখেছিলাম। আজ ‘কালিমাটি অনলাইন’এর সম্পাদকীয় লিখতে বসেও মনে হলো, এই বিশেষ দিনটির প্রাসঙ্গিকতায় তাঁর সম্পর্কেই যৎকিঞ্চিত আলোচনা করা যাক। রাসবিহারী বসুর জন্ম হয়েছিল ভারতের পূর্ব বর্ধমান জেলার সুবলদহ গ্রামে ১৮৮৬ সালের ২৫শে মে। তাঁর বাবার নাম বিনোদবিহারী বসু এবং মায়ের নাম ভুবনেশ্বরী দেবী। নিতান্ত ছেলেবালায় পড়াশোনার জন্য তিনি গ্রামের পাঠশালায় ভর্তি হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি মর্টন স্কুলে এবং ডুপ্লে কলেজে পড়াশোনা করেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি স্কুলের শিক্ষকদের কাছে এবং তাঁর দাদু কালীচরণ বসুর কাছে বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী গল্প শুনে বিপ্লবী আন্দোলনের প্রেরণা পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি দেশের বিপ্লবী কর্মকাণদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এইসময় তিনি অভিযুক্ত হন আলিপুর বোমা বিস্ফোরণ মামলায়। সেটা ১৯০৮ সাল। কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর তিনি দেরাদুন চলে যান বন গবেষণা ইনস্টিটিউটে হেড ক্লার্কের চাকরি পেয়ে। দেরাদুনে থাকাকালীন গোপনে তিনি মিলিত হন বাংলা, উত্তরপ্রদেশ ও পাঞ্জাবের বিপ্লবীদের সঙ্গে। এর পরেই দিল্লীতে বড়লাট হার্ডিঞ্জের ওপর প্রাণঘাতী হামলা হয়। রাসবিহারী বসুর নির্দেশে ও পরিচালনায় বিপ্লবী কিশোর বসন্ত বিশ্বাস বোমা ছোঁড়েন হার্ডিঞ্জকে লক্ষ্য করে। যদিও হার্ডিঞ্জ প্রাণে বেঁচে যান। এটা ১৯১২ সালের ঘটনা। স্বাভাবিক কারণেই রাসবিহারী বসুকে গ্রেপ্তার করার জন্য ব্রিটিশ শাসকেরা মরিয়া হয়ে ওঠে। রাসবিহারী বাধ্য হন পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে ভারত ছাড়ার জন্য। ১৯১৫ সালের ১২ই ডিসেম্বর কলকাতার খিদিরপুর বন্দর থেকে ছদ্ম পরিচয়ে তিনি জাপান যাত্রা করেন। পাসপোর্ট অফিস থেকে রবীন্দ্রনাথের আত্মীয় রাজা প্রিয়নাথ ঠাকুর পরিচয়ে তিনি পাসপোর্ট সংগ্রহ করেছিলেন।

তিনি যখন জাপানে পৌঁছান, বৃটিশ সরকার তাঁর মাথার দাম রেখেছিল ১২০০০ রুপি বা ৫০০০ বৃটিশ পাউন্ড। সেইসময় বৃটিশ ও জাপান মিত্রশক্তি ছিল। রাসবিহারীর পরেই ভারত থেকে জাপানে আসেন আরও এক বিপ্লবী হেরেম্বলাল গুপ্ত এবং আরও কিছুদিন পর লালা লাজপত রায়। বৃটিশ শাসক গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে জাপান সরকারকে তাঁদের গ্রেপ্তার করার জন্য অনুরোধ করা হয়।  স্বাভাবিক কারণেই তাঁরা জাপানের গণমুক্তি আন্দোলনের কয়েকজন নেতার সহায়তায় আত্মগোপন করেন। হেরেম্বলাল ও লাজপত রায় কিছুদিন পরে জাপান ছেড়ে আমেরিকায় চলে যান, কিন্তু রাসবিহারীকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আত্মগোপন করেই থাকতে হয়। এইসময় তিনি জাপানের অন্যতম গণমুক্তি আন্দোলনের নেতা তোয়ামা মিৎসুরুর জ্যেষ্ঠাকন্যা সোওমা তোশিকোর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

পরবর্তীকালে রাসবিহারী বসুর তৎপরতায় জাপানি কর্তৃপক্ষ ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের পাশে দাঁড়ায় এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় সহযোগিতা জোগায়। ১৯৪২ সালের ২৮-২৯শে মার্চ রাসবিহারীর আহ্বানে টোকিওতে একটি সম্মেলনে ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ গঠন করা হয়। রাসবিহারী সেই সম্মেলনে একটি সেনাবাহিনী গঠনেরও প্রস্তাব পেশ করেন।  ১৯৪২ সালের ২২শে জুন ব্যাংককে দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে রাসবিহারীর অনুরোধে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগে যোগদান করেন। যেসব ভারতীয় সৈন্য মালয় ও বার্মা ফ্রন্টে জাপানিদের হাতে বন্দী ছিলেন, তাঁরা ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগের সশস্ত্র সেনাবাহিনী ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি বা আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগদান করেন। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক। রাসবিহারী বসু অবশ্য আর বেশিদিন জীবিত ছিলেন না। ১৯৪৫ সালের ২১শে জানুয়ারী তিনি প্রয়াত হন।


আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা : 

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com 

দূরভাষ যোগাযোগ :     
      
08789040217 / 09835544675 

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :

Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002,  Jharkhand, India

অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়




সত্যজিৎ রায়ের ‘আগন্তুক’ ছবির অনুষঙ্গে বাঙালির আড্ডার অনন্য সাধারণতা (Exceptionalism) প্লেটো, সোক্র্যাতিস, আলসিবাইয়াদিস, রবীন্দ্রনাথ, গিয়র্গি সিমেল আরো সাত সতেরো বাজে অবান্তর প্রসঙ্গ-




সত্যজিৎ রায়ের ‘আগন্তুক’ সিনেমার সেই দৃশ্যগুলো নিশ্চয় মনে আছে। ভূপর্যটক নৃতত্ত্ববিদ মনমোহন মিত্র তাঁর ভাগিনেয়ী অনিলা বোস-এর কাছে এসেছেন সারা পৃথিবী ঘুরে পঁয়ত্রিশ বছর পরে। আর এই হারানো ও পুনরাগত মামাকে একটু নেড়ে চেড়ে দেখতে তাঁর ভাগ্নিজামাই সুধীন্দ্র ডেকেছেন তাঁর ব্যারিস্টার বন্ধু পৃথ্বীশ সেনগুপ্তকে। কিন্তু পৃথ্বীশ আসার আগেই অনিলার বান্ধবী ছন্দা রক্ষিতের অভিনেতা স্বামী রঞ্জন রক্ষিত এসে যান। তারপর সন্দেহজনক মামাকে নিয়ে তাঁদের নাড়াচাড়া খুবই সেমসাইড গোলের মতো হয়ে যায়। কারণ পুতুলখেলার প্রদর্শনীতে পাঞ্চিনেলোর (Punchinelo in the puppet show) মতো সংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ, সর্বজ্ঞ (সবজান্তা কিনা প’ড়ে আপনারা বলবেন) তাঁদের সব কথাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া ছাড়াও তাদের সব বিশ্বাসের গোড়া ধরে টান মারেন। পৃথ্বীশের কথা বলছি না। আপনারা জানেন, আর এখানে দরকারও নেই।

কিন্তু রঞ্জনের কথায় কথায় এসে যায় আড্ডার প্রসঙ্গ। বাঙালির অনন্য সাধারণতার অনেক স্তম্ভের মধ্যে একটি যে আড্ডা, সে কথা ব’লে রঞ্জন  মনমোহনের বিশ্বজ্ঞানের তোপের সামনে পড়ে। মনমোহন তাকে জানান যে প্রাচীন গ্রিসের জিমন্যাসিয়ামে তথা ‘আখড়ায়’, যেখানে শরীরচর্চার পাশাপশি বিদ্যাচর্চা হতো, আলোচনাচক্র বসতো, সেখানে দর্শন, রাজনীতি, গণিত, কলা, সাহিত্যের আলোচনায় গ্রিসের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানীগুণীরা, যথা সক্রেটিস, প্লেটো, আলসিবাইয়াদিস ইত্যাদিরা অংশ নিতেন। শুনে চমৎকৃত রঞ্জন বলে এতো একধরনের আড্ডা! মনমোহন জানান, আড্ডা, কিন্তু উচ্চতম স্তরে। সেই আড্ডা  এখানে কোথায়। তিনি বলছেন না যে এখানে, মানে বাংলায়, ‘প্রোডাক্টিভ  আড্ডাজ’ ছিল না, অন্ততঃ তাঁদের সময়ে। কিন্তু এখন তো সবই নিম্নগামী, আড্ডা পরনিন্দা পরচর্চা, গ্রাম্য কোঁদলের জায়গা। তবে সেই তাঁর সময়েও আড্ডা যদি উচ্চকোটির, মানে ‘তেমন তেমন হতো, তবে রবীন্দ্রনাথও আড্ডা দিতেন’। রবীন্দ্রনাথ আড্ডা দিয়েছেন না দেন নি, রঞ্জনের এই স্বগতোক্তি আর পরের প্রশ্নে সুধীন্দ্রর কিছু বলার নেই। তারা একথায় কাত! তাদের আর মনমোহনেরও (সত্যজিৎ-এর ও কী)— জানা ছিল না রবীন্দ্রনাথ আড্ডা দিতেন কিনা।

তো, এই অংশের একটা ইউটিউব ভিডিও ক্লিপিং তুলে দিয়ে দিল্লিপ্রবাসী এক অগাধ পণ্ডিত ও ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট বাঙালি কবি, যাঁকে আমি দাদাজ্ঞান করি, আমায় জানালেন / শুধোলেন যে, ‘একটা প্রব্লেম আছে  স্ক্রিপ্টে; আলসিবাইয়াদিস (আইকিবিয়াদিস উচ্চারণও চালু আছে) খুব রাজনৈতিক প্রতিপত্তি অর্জন করেন, কিন্তু জ্ঞানের ক্ষেত্রে উনি খুব বড় মানুষ ছিলেন না বোধহয়। অন্য এক আধটা নাম করা যেত। … ঠিক বলেছি কি?’ আর এই প্রসঙ্গেই উনি জানালেন যে জিমন্যাসিয়াম সম্পর্কে জানলেও সেটা যে ‘বাঙালির আড্ডার পূর্বপুরুষ’ সে সম্পর্কে উনি সচেতন হয়েছিলেন ‘বছর চল্লিশ আগে শিশিরকুমার দাসের কোনো কথাবার্তা শুনে।’   
  
মানে, ব্যাপার দাঁড়ালো আমার প্যাঁচালো মাথায় তিনটে: (১) সক্রেটিস (সোক্র্যাতিস উচ্চারণও চালু আছে, বুব সোক্রাতিস লিখতেন), প্লেটোর সঙ্গে আড্ডাধারী হিসেবে আইকিবিয়াদিসের নাম আসে কিনা; আর (২) গ্রিসের জিমন্যাসিয়াম সত্যজিতের জিমন্যাসিয়াম কিনা; আর (৩) জিমন্যাসিয়াম ‘বাঙালির আড্ডার পূর্বপুরুষ’ কিনা। প্রথমটায় দাদা সন্দিহান। দ্বিতীয়টায় বোধহয় নন। তৃতীয়টায় সন্দেহ পরিষ্কার নয়, উনি ‘নন-কমিট্যাল’ কিছুটা!


প্রথমটার যৌক্তিকতা সম্বন্ধে আমার সন্দেহ নেই। আইকিবিয়াদিস কতটা পণ্ডিত / দার্শনিক সেটাকে বাদ দিয়েই বলি, তাঁর সঙ্গে সোক্র্যাতিসের মজলিশী এবং অন্য সম্পর্ক খুব বেশি ছিল। সোক্র্যাতিসকে আইকিবিয়াদিস গ্রিসের যুগের বৌদ্ধিক সমকামী অর্থে ভালোবাসতেন, কিন্তু সোক্র্যাতিস আইকিবিয়াদিসকে ভালবাসেনন নি, তবে তাকে বহুবার রক্ষা করেছেন, যুদ্ধেই দুবার। পরম সুপুরুষ আইকিবিয়াদিস নিজের কাকা, ভাইঝি ইত্যাদির সঙ্গে ইনসেসচুয়াস সম্পর্ক ছাড়াও অনেক সমকামী সম্পর্কে লিপ্ত হয়ে থাকলেও সতেরো বছরের বড়ো সোক্র্যাতিসকে সারাজীবন প্রেম নিবেদন করেও পাননি। আইকিবিয়াদিস প্লেটো সোক্র্যাতিস এবং আইকিবিয়াদিসের সম্পর্ক নিয়ে আইকিবিয়াদিস১, আইকিবিয়াদিস২ (সম্ভবতঃ জাল) নিয়ে তাঁর চারটি ডায়ালগে বলেছেন। সোক্র্যাতিসকে বাদ দিলে আর কোনো  ঐতিহাসিক চরিত্র প্লেটোর ডায়ালগে এতবার আসেননি। সোক্র্যাতিস পার্টি নিয়ে বেশি উৎসাহী ছিলেন না কিন্তু আইকিবিয়াদিসের জন্যে পার্টি শান্ত হওয়া অবধি অপেক্ষা করেছেন, তাঁকে নিয়ে যেতে। এই দিক থেকে সোক্র্যাতিস, প্লেটোর সঙ্গে আইকিবিয়াদিস হয়তো এসে গেছেন। আইকিবিয়াদিস ১-এ প্লেটো তাঁকে যেরকম কুখ্যাত চরিত্র হিসেবে এঁকেছেন তার মধ্যে একটা ত্রিকোণের আভাসও খুঁজে পাওয়া যায়। আইকিবিয়াদিস সোক্র্যাতিস সম্পর্ক কি ইংরেজি সাহিত্যে কতকটা বসওয়েল-জনসন সম্পর্কের মতো, সমকাম বাদ দিয়ে? এর ওপরে ভাল লেখা আছে ইয়ার্গে লুইস বোর্হেসের। পড়ে নেবেন!

উপরন্তু দুজনের সম্পর্ক ছিল অসাধারণ। অধ্যাপক দাদাই জানালেন জেনোফনের সিম্পসিয়াম-এ আছে যে, ‘সোক্র্যাতিস প্রমাণ করেছিলেন যে ধারণা ছিল যে  তাঁর অতীব টেরা চোখের কারণে তিনি আইকিবিয়াদিসের চেয়ে সুপুরুষ। কারণ এই চোখের ইউটিলিটি [উপযোগিতা] বেশি। নানাদিক আশেপাশের দেখা যায়, আর ইউটিলিটি হলো সেই বেদী যার উপরে যে কোনো সৌন্দর্য নির্মিত হতে পারে। নতুবা নয়’। কী সুন্দর সম্পর্ক বলুন তো! আর টেরাচোখ ছাড়াও সোক্র্যাতিসের কুশ্রীতার আরো অনেক সম্বল ছিল। তার মধ্যে ছিল চ্যাপ্টা নাক, আর ভুঁড়ি। জেনোফনের সিম্পোসিয়ামে বলা ছিল, ‘he was uglier than all the Silenuses in the Satyric drama’। সব সময়ে নোংরা পুরনো পোশাক আর খালি পায়ে ঘোরা সেই কুশ্রীতার সোনায় সোহাগা ছিল। অ্যালসাইবিয়াদিস কিন্তু সোক্র্যাতিসের রূপাভাব নিয়ে কখনও কোনো কথা বলেননি। জেনোফনের সিম্পোসিয়ামে সোক্র্যাতিসের সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘যখন আমাদের রসদ আটকে দেওয়ায় আমরা অনশনে থাকতে বাধ্য হতাম, যা যুদ্ধের সময়ে প্রায়ই হতো, তখন তাঁর সহিষ্ণুতা ছিল অপূর্ব, আমাদের সবার চেয়ে বেশি, অতুলনীয় … খালি পায়ে আর সাধারণ পোষাকে তিনি জামাজুতো পরা সৈনিকদের থেকে ভালো হাঁটতেন, আর তারা তাঁর দিকে রোষকষায়িত দৃষ্টিতে তাকাতো। কারণ দেখে বোধ হতো তিনি তাদের অবজ্ঞা করছেন (দেখুন Bertrand Russell, History of Western Philosophy (London: Routledge Classics, 2004, p. 96)। ফলে সত্যজিৎ যখন সোক্র্যাতিস, প্লেটোর সঙ্গে আইকিবিয়াদিসের কথা এনেছেন তখন হয়তো দুজনের অবশ্যম্ভাবী সদাসঙ্গ  থেকেই তাই এসেছে।




দ্বিতীয় প্রসঙ্গে বলি, গ্রিসের জিমন্যাসিয়াম কি সত্যি সত্যজিতের জিমন্যাসিয়াম ছিল, যেখানে শরীরচর্চার সঙ্গে বিদ্যা ও জ্ঞানের চর্চাও হতো, অজস্র আলোচনাচক্রে, যেখান থেকে বেরিয়ে আসতো অজস্র ডায়ালগ, ফলে তাকে আমাদের আড্ডার সঙ্গে তুলনা করা যাবে? না বোধ হয়! যতই কেন বলুন সত্যজিতের নায়ক! প্রথমতঃ Kenneth S. Cooper তাঁর People in Time and Place (Silver Burdett Ginn, 1993, p. 88), বইতে বলছেন, গ্রিসের  জিমন্যাসিয়াম মূলতঃ শরীরচর্চার জায়গা হলেও সেখানে মানুষরা আলোচনা ও পড়ার জন্যেও জমায়েত হতে পারতেন। কতকটা সত্যজিতের মনোমোহনের কথার মতো। কিন্তু জিমন্যাসিয়ামগুলো ছিল মূলতঃ শরীরচর্চার জায়গা, গ্রীসের আত্মপরিচয় বজায় রাখার জায়গা, আর পুরুষ-পুরুষ যৌনতার ও প্রবীণ-বালক সমকামিতা তথা pederasty-র জায়গা। জিমন্যাসিয়ামে শরীরচর্চার প্রাথম্য বিষয়ে অনেকে বলেছেন, যেমন Eric Chaline,The Temple of Perfection: A History of the Gym (London: Reaktion Books, 2015, পৃঃ ৩৩) বইতে। William Smith কর্তৃক সম্পাদিত A Dictionary of Greek and Roman Antiquities (London: James Murray, 1870, পৃঃ ৫৭৯) বইতে বলা হয়েছে যে ব্যাকরণ, সঙ্গীত এবং জিমন্যাস্টিক্স (অ্যারিস্টট্ল পরে অঙ্কন বা চিত্রবিদ্যা যোগ করেন) গ্রীক তরুণের শিক্ষার প্রধান অংশ হলেও জিমন্যাস্টিক্স একাই  বাকি সব কটার সমান সময় ও মনোযোগের সমান ভাগ নিতো! কিন্তু সমকামী যৌনতার বা প্রবীণ-বালক সমকামিতার জায়গা হিসেবে জিমন্যাসিয়ামের ভূমিকা নিয়ে খুব দ্বিমত নেই, দেখুন Debra Hawhee, Bodily Arts: Rhetoric and Athletics in Ancient Greece (Austin: University of Texas Press, 2004, pp. 105, 116-17)। Wolfgang Decker সহ বেশ কিছু গবেষক অবশ্য শরীরচর্চা, বিদ্যার্জন, ঔৎসবিক প্রতিযোগিতা, কলা ও বিজ্ঞানে প্রশিক্ষণ, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধগুলির সঞ্চার, আর স্থানীয় সামাজিক সংযোগ জাল বিস্তারের জায়গা হিসেবে জিমন্যাসিয়ামকে দেখিয়েছেন, কিন্তু তারাও বলেন, ‘The life of the gymnasium is half of the story of Greek athletics, complemented by festival competitions’। দেখুন (Ed.) Thomas Francis Scanlon, Sport in the Greek and Roman Worlds: Greek Athletic Identities and Roman (Oxford: Oxford University Press, 2014, p. 27)। তবুও একথা কিছুতেই গৌণ করা যাবে না যে, সমকামিতা ও যৌনতা গ্রিসের জিমন্যাসিয়ামের প্রাণবস্তু  ছিল। সেখানে বালক ও তরুণরা ন্যাংটো হয়ে শরীরচর্চা করতো। বাকিরাও। তার একটা কারণ ছিল গ্রীক হেলেনিক আইডেন্টিটি বজায় রাখা। একটা নগ্নতার মাধ্যমে জামাকাপড় পরা বর্বরদের থেকে নিজেদের পার্থক্য বুঝে নেওয়া, দেখুন Erkki Koskenniemi, Greek Writers and Philosophers in Philo and Josephus: A Study of Their Secular Education and Educational Ideals (Leiden; Boston : Brill, 2019), p.8। কিন্তু আরেকটা অবশ্যই যৌনতা, দেখুন Kenneth James Dover, Greek Homosexuality (Cambidge, Mass.: Harvard University Press, 1989), pp. 54, 150, 163। প্রথম যুগের ক্রিশ্চানদের মত পেগান গ্রীকরাও জানতেন যে নগ্নতা pederasty-কে উদ্রিক্ত করে। প্লেটো লিখেছিলেন, সেই সব poleis-এই pederastic প্রেমের বাড়বাড়ন্ত  যেখানে জিমন্যাস্টিক্স-এর চর্চা বেশি হতো (Laws, 1, 636c)। সিসেরো লিখেছিলেন যে pederasty-র উদ্ভব গ্রীক জিমন্যাসিয়ামে, যেখানে এই ধরনের প্রেম মুক্ত ও অনুমত (Tusculan Disputations, IV, 33) কাতুল্লুস (Catullus) Atttis-এর মুখে বসাচ্ছেন এই উক্তি, ‘আমি মেয়ে হবো, যে আমি ছিলাম কিশোর, আমার palaestra-র অর্থাৎ কুস্তির আখড়ার ফুল (LXIII)? আর প্লেটোর ডায়ালগগুলো স্পষ্ট করে দেয় যে প্রত্যেক palaestra একটি কিশোরকে তার শ্রেষ্ঠ ‘beauty’ হিসেবে তুলে ধরতো! [William A. Percy,Pederasty and Pedagogy in Archaic Greece(Urbana: University of Illinois Press, 1996,p. 84)] Pederasty আথেন্স-এই বেশি ছিল। তবে অন্য গ্রীক নগররাষ্ট্রেও pederasty-কে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে প্রণীত আইন (যেমন Berea Gymnasum- এ) এর অস্তিত্বকেই প্রমাণ করে, দেখুন Andrew Lear& Eva Cantarella, Images of Ancient Greek Pederasty: Boys Were Their Gods (London and New York: Rouledge, 2008), pp. 1-2। জিমন্যাসিয়ামের ভিতরে প্রচুর খোলা ফাঁকা জায়গা এবং বালক-কিশোর-যুবকদের নগ্ন শরীরচর্চা যে প্রশিক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে  seduction-এর ‘আখড়া’ ছিল তাতে সন্দেহ নেই। Calame বলেছেন আথেন্স-এর জিমন্যাসিয়ামের একেবারে প্রবেশ পথে বসানো কামদেব Eros-এর স্ট্যাচু, আর অনেক জায়গায় graffiti আর pederastic acclamations হলো সব চেয়ে ভালো প্রমাণ যে শারীরিক অনুশীলন আর চর্চার জন্যে নির্দিষ্ট জায়গাটা Eros-মন্দিরও বটে, ‘asymetric erotic desire’-এর নিবৃত্তির জায়গাও বটে, দেখুন Claude Calame, The Poetics of Eros in Ancient Greece, trans. Janet Lloyd (Princeton, NJ: Princeton University Press, 1999/2013), pp. 93, 99, 101, 106। এটাকে বাঙালি আড্ডার মতো জায়গা বলা যাবে?




এর থেকে তৃতীয় প্রসঙ্গে আসা খুব সহজ, মানে জিমন্যাসিয়াম ‘বাঙালির আড্ডার পূর্বপুরুষ’ কিনা। খেয়াল করুন উত্তর কতকটা প্রায় দেওয়া হয়েই গেছে। রবি ঘোষ তথা রঞ্জন রক্ষিত যে চায়ের দোকানে, রাস্তার মোড়ে, ‘পার্কে বেঞ্চিতে পথে শানে’ (এটা সত্যজিৎ তথা মনোমোহনের থেকে নয়, বিষ্ণু দে-র থেকে নিলাম) এককাপ চা হাতে নিরন্তর কথা বলার কথা বলেন তাতে শারীরিক  অনুশীলন আর চর্চা একেবারে নেই। বাঙালির আড্ডা আর শরীরচর্চা প্রায় বিপ্রতীপ। শরীরচর্চা করতে বাঙালি যেতো কখনও ব্যায়ামাগারে, কখনও কুস্তির ‘আখড়ায়’, সেই আখড়া একেবারে আলাদা। আখড়ার প্রথম মানে প্রাথমিকভাবে হরিচরণের মতে ‘যাত্রা-থিয়েটার সম্প্রদায়ের অভিনয় শিক্ষার স্থান’, পঞ্চম মানে বোষ্টমদের ‘আশ্রয় ও সাধনভজনের’ স্থান। তবে তার রসঘন পরিবেশে সমকাম, বিপরীতকাম, প্রবীণ-নবীন কাম চলতো, না চলতো না, তা এখানে বিচার্য নয়!  তবে প্লেটোর সিম্পোসিয়ামের যে ফাইন্যাল মানে শেষ ডায়ালগে সোক্র্যাতিস বক্তৃতা দেওয়ার সময় আইকিবিয়াদিস যখন এক মাতালদের দঙ্গলের সঙ্গে ঢুকলেন, সেটা আমাদের পরিচিত আড্ডার চেহারাই নয়, হোমো সাপিয়েন্স-এর  পূর্বপুরুষ নিয়ান্ডারথাল মানুষের মতো অর্থেও নয়। সেখানে ঝামেলা চলছে সোক্র্যাতিস, আগাথন (সিম্পোসিয়ামের সব চেয়ে সুপুরুষ) আর আইকিবিয়াদিসের মাঝখানে ফন্দি ক’রে বসে পড়ার জন্যে। সোক্র্যাতিস আইকিবিয়াদিসকে তার জেলাসির ব্যাপারে অভিযোগ করছেন। পরে এরিক্সিম্যাকাস (Eryximachus) আইকিবিয়াদিসকে সোক্র্যাতিসের প্রশংসা করতে বললে তিনি সোক্র্যাতিসকে কেবল চেহারায় নয় গুণেও ‘statue of Silenus and the satyr Marsyas’-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। সোক্র্যাতিস নাকি ‘statue of Silenus and the satyr Marsyas’-এর মতো! ‘Marsyas lures people with his music and Socrates does so with his words. Alcibiades says everyone is “transported, completely possessed” when Socrates speaks’। পরে অবশ্য আইকিবিয়াদিস সোক্র্যাতিস-এর আরো খোলাখুলি প্রশংসা করেছেন। সেখানে তিনি বলছেন সোক্র্যাতিস সুন্দর ছেলেদের প্রেমিক হলেও তাদের ‘physical beauty, riches, or fame’-এর কারণে নয়। তাই তিনিও ভুল করে ভেবেছিলেন যে সোক্র্যাতিস তাকে কামনা করেন। কিন্তু অনেক সুযোগ দিলেও সোক্র্যাতিস তাঁকে সিডিউস করেন নি! এই নাকি বাঙালির আড্ডার পূর্বপুরুষ! 




তাহলে বাকি রইলো কী! একথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে ‘মানডে ক্লাব’ তথা  ‘মণ্ডা ক্লাব’-এর প্রতিষ্ঠাতা সুকুমার রায়ের ছেলে বাঙালি ‘প্রোডাক্টিভ আড্ডাজ’-এর কথা জানতেন না! আসলে মনোমোহনকে দিয়ে বলান নি! আর, রবীন্দ্রনাথ আড্ডা দেন নি? জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে ঠাকুরবাড়িতে যে বিদ্বজ্জন সমাগমসভা বসতো, শেষে খ্যাঁট, তাতে রবীন্দ্রনাথ থাকতেন না, এটা কি একটা কথা? জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সবকিছুতে ছোটো ভাইটি থাকতেন। ঠাকুরবাড়ির ‘বিচিত্রা’র আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই আড্ডায় ঠাকুরবাড়ির লোকের চেয়ে বাইরের লোকজনের আগমন ছিল বেশি। বিখ্যাত লেখকরাও আসতেন, যথা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, বাপ সুকুমার রায়, যতীন্দ্রমোহন বাগচি, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ। ‘ভারতী’র আড্ডার কথা ভুললে চলবে? রবীন্দ্রনাথের ‘শোকসভা’ প্রবন্ধে তো তিনি এই সাহিত্যিক আড্ডাকেই ‘পাব্লিক’ বলে আখ্যাত ক’রে ভারতীয় ‘গার্হস্থ্যপ্রধান সমাজ’-এ তার কদরের অভাবে ক্ষেপে গিয়েছিলেন। এর কথা আমি সবিস্তারে লিখেছি Society, Politics and Colonialism: An Alternative Understanding of Tagore’s Responses, Foundation Books (New Delhi: Cambridge University Press, 2010) বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ে (আত্মপ্রচার / বিজ্ঞাপন মার্জনীয়)। যদিও সেখানে দেখিয়েছি যে রবীন্দ্রনাথের খ্যাপার কারণ ছিল আলাদা।

আসলে একটা কথা বোঝা দরকার। কেবল মেলামেশার জন্যেই মেশা, পৃথিবীতে সর্বত্র, সর্বকালে ছিল, আছে। এই সামাজিকতার ব্যাপারটা যিনি সব চেয়ে ভালো ধরেছিলেন তাঁর নাম গিয়র্গি সিমেল, প্রবাদপ্রতিম জর্মান পণ্ডিত ও সমাজতত্তত্ববিদ। তিনি এর নাম দিয়েছিলেন ‘sociation’- যার আবার অনেক আঙ্গিক আছে। একটা হলো ‘pure sociation’, দেখুন Georg Simmel,The Sociology of Georg Simmel, trans., ed., with introduction Kurt H. Wolff (New York: Free Press, 1950) - যার মধ্যে যেমন আছে আমাদের আড্ডা, তেমনি পশ্চিমের বড়ো বড়ো শহরে ‘ইয়ং স্ট্রিট কর্নার গ্যাং’ যার সামাজিক মনস্তত্ত্বের উপর গুরুস্থানীয় প্রাবন্ধিক বিনয় ঘোষের ভালো লেখা আছে। এই আড্ডা, মেলামেশা যে আধুনিক সমাজে উঠে যাচ্ছে, যার ফলে আমেরিকায় মানুষ ‘বোলিং’ খেলতেও ক্লাবে না গিয়ে নিজের বাড়িতে ‘অ্যালি’ ক’রে নেওয়ায় সামাজিকতার কী সর্বনাশ হচ্ছে, তার কথা লিখে জগজ্জোড়া নাম করেছেন রবার্ট পাটন্যাম, দেখুন Robert D. Putnam,Bowling Alone: The Collapse and the Renewal of the American Community (New York: Simon Schuster, 2000)।

শেষে একটা কথা চুপে চুপে বলি। আড্ডার প্রাণই হলো উদ্দেশ্যহীনতা, আর ভিত্তি হলো অনৈক্যমত্য বা dissensus। ‘প্রোডাক্টিভ আড্ডা’ হলো সোনার পাথরবাটি, শশকশৃঙ্গ বা কাঁঠালের আমসত্ত-র সহোদর ভাই! আড্ডা সমমর্যাদার, সমক্ষমতার মনুষ্যদের সমাবেশ নয়। আমাদের সল্টলেকের বা নিউ টাউনের কমিউনিটি হলেও নয়। সেখানে সোক্র্যাতিস, প্লেটোর সঙ্গে আইকিবিয়াদিসরাও আসবেন। কারণ তখনও ইতিহাস আমের আর মাকালের তফাৎ করে দেয় নি! 




পুনশ্চঃ — আমায় গালি দেবার আগে কিন্তু মনে রাখবেন আমি সত্যজিৎ রায়ের ফ্যান নয়, খালি ফ্যানাভাত! উনি বোধহয় এক ওপিনিয়নেটেড মনোমোহনকে  তৈরি করেছিলেন আমাদের কূপমণ্ডুকতাকে ভেঙে দিতে এক ইউনিভার্সালিজম সাহায্যে, যে স্বদেশ-বিদেশ, আধুনিক-প্রাগাধুনিকের বিভেদ মানেই না নিজের হারমেনিউটিক প্রজ্ঞার ফলে। কিন্তু তাকে তৈরি করেছেন যে গড়পাড়ের মানুষটি তিনি বেঙ্গলি এক্সেপশন্যালিজ্‌মের প্রায় প্রতীক, তাঁর বিশ্বজনীনতার সঙ্গে। তবে আড্ডা দিতেন না। আমিও দিই না সার!   
                                                      

শিবাংশু দে



জরাসন্ধ আর গণেশ পাইনের রানি ৪













আজ সকলই কিংবদন্তী, পাতালে বাস করলে গুঁড়ো
সন্ধ্যেবেলায় পা ছড়িয়ে বসতে নাকি পাহাড়চুড়োয়?
নিত্যি নতুন পোক্ত তাড়ি
সর্বনাশের স্বপ্নে মেশা আঁধার করা বিষের হাঁড়ির -
শক্তি, খেতে একচুমুকে, মন্দ নয় সে-কান্ডখানা!
জগজ্জীবন চমকে দিয়ে ভাসতো সুবাস হাস্নুহানার-
আজ সকলই কিংবদন্তী!...”

দশটার মধ্যে বাড়ির চাবি আমাকে গচ্ছিত করে কৌশিক তো ভেগে গেলো  আমি ঘরে উঁকি
দিয়ে দেখি দুজনে দুটো তক্তপোশে একেবারে পপাত চ। দেড় বোতল ঠররা তখনও স্টকে
রয়েছে। ভাবলুম ঘুমোক যতোক্ষণ পারে  আমি একটু খাবারদাবারের ব্যবস্থা করি নাহয় 
সদর বাজার ঘুরে আসতে আসতে দেখি দু'জনেরই ঘুম ভেঙে গেছে  হাতমুখ ধোয়াধুয়ি  
চলেছে কুয়োতলায়। আমি ঘরে ঢুকে পাতাফাতা সাজাতে সাজাতে দেখি কৌশিক ফিরে 
এসেছে।

-কী হলো, চলে এলি ?
-আরে বলিস না সুব্রতদা'কে তো চিনিস, আমার ব্রাঞ্চ ম্যানেজার...
-চিনি তো..
-সে কম বয়সে পদ্যটদ্য করতো। গিয়ে বললাম আজ আমার বাড়িতে বুড়ো এসেছে, 
শিবাংশুকে একা ঠেকিয়ে দিয়ে এসেছি... ছেড়ে দিলে ভালো হতো..
-ছেড়ে দিলো ?
-দিলো তো... পদ্যের মহিমা খুব পাওয়ারফুল...

"কোথায় গেলি রে..." হুংকার দিতে দিতে নায়কের প্রবেশ  খালি গায়ে, কৌশিকের একটা 
লুঙ্গি জড়িয়ে, চুলের থেকে জল ঝরছে...
-আছি, আছি, তোমাদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করছি..
-বাহ বাহ, লক্ষ্মী ছেলে, বেদম খিদে পেয়েছে বুঝলি....
আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, আরেহ, এটা কে আবার ?
-  হলো শিবাংশু, জামশেদপুরের, তোমাদের লাইনের লোক...
-অ্যাই ব্যাটা, তুই জামশেদপুরের, কমল'কে চিনিস?
-হুমম, চিনি...
-ও পেয়েছেটা কী ? শক্তি চাটুজ্যে পদ্য দিলে লোকে কভারে সেটা ছাপে, আর  বলে কি 
দেরিতে পেয়েছি, ছাপবো-ই না...
- এই গপ্পোটা তো আমি জানিনা। ঠিক আছে দেখা হলে জিগাবো এখন...
-জিগাবি কী ? ওর বদলে এখন তোকে পেয়েছি, তোকে মেরে আমি এখন খন্ড'ৎ বানাচ্ছি দাঁড়া 
- অ্যাই বুড়ো, শিবাংশু'র সঙ্গে ঝাড়পিট কোরোনা, পাক্কা বিহারি, নিজে মার খেয়ে যাবে...
-হ্যাঁ, ঠিকই বলেছিস, ওকে এবার ছেড়েই দিই তবে...

কাছারির সামনে সরাইকেলা হোটেলে মাটনলিভারের একটা ফ্রাই দারুণ বানাতো। সেটার
সঙ্গে রুটিফুটি আর কিছু আনুষঙ্গিক নিয়ে এসেছিলুম  জমপেশ খাওয়া হলো একেবারে। শুধু
সেই ঠাকুরবাড়ির কবি ক্ষণে ক্ষণে এলিয়ে পড়ছিলো  ওস্তাদ বললেন,  ব্যাটা আসল মাল
কখনও খায়নি তো, স্কচ-ফচ খায়, টেঁসে না যায় আবার...
আমি কৌশিককে বলি, যা লেবুটেবু খাইয়ে বমি করিয়ে দে, নয়তো পরেশান করবে...
একটু পরে দু'জনে ফিরে আসে  ঠাকুরকবি কিস্যু না বলে সোজা তক্তপোশে গিয়ে শুয়ে পড়ে 
বাইরে তখন প্রচন্ড রোদ, এপ্রিলের শেষ  কৌশিক শুধায়, কী বুড়ো নিমডি যাবে নাকি?
-নাহ, আমি আর কখনও নিমডি যাবোনা  আমাকে একটা খাতা-কলম দে, আর বকবক
করিসনা একদম... নয়তো মেরে খন্ড'ৎ...
আমরা বেরিয়ে পাশের ঘরে চলে যাই।
রোদ একটু পড়তে কবি বললেন, হ্যাঁরে লুপুংগুটু যাওয়া যাবে ?
-হ্যাঁ, যাওয়া যায়, কিন্তু হেঁটে যেতে ঘন্টা খানেক লেগে যাবে..
-চল তাহলে...
-তোমার চ্যালার কী হবে ?
-আরে ওকে ঘুমোতে দে, সুখী বালক...

চাইবাসার অন্ধিসন্ধি কবির জানা। আমাদের জন্মের আগে থেকে, সমীর'দার প্রথম চাইবাসা
বাসের সময় থেকে ওঁদের এই সব গলিঘুঁজি নিয়ে কারবার। নিজেই রাস্তা চিনে চললেন তিনি 
এস পি জি মিশনের পিছনের মাঠ পেরিয়ে সোজা নামোদিকে আমরা চললুম লুপুংগুটু  ওখানে
একটা ক্ষীণ পাহাড়ি জলধারা ছিলো  পুরোনো বনস্পতি আর রোদে পোড়া ঘাসের মাঠ, 
মাঝখান দিয়ে পায়েচলা মেঠো রাস্তা  আর একটু এগোতেই একটি চেনা দৃশ্য। মৌয়া সেদ্ধ 
করছে কয়েকজন  গার্হস্থ্য ভাটি, শাদা ধোঁয়া আর   করছে মৌয়ার বাস  এই গন্ধটা 
আমার কখনও সহ্য হয়না  সুদূর কলকাতার কবিরা এই গরল সেবন করতে রাত জেগে 
ট্রেনে চেপে আসেন,কতোকাল হলো। কবি বলেন, ব্যস এখানেই বসা যাক । চাখনা বলতে ভেজা চানা আর
নুন-লংকা, আর কী চাই?
ঘর্মাক্ত শরীর, এলোমেলো কথামালা, কে জানে গরলই কি না প্রকৃত পানীয়, অমৃতই
বিষ...
ফিরে আসার সময় কবির হেঁটে আসার সাধ্য নেই। রিকশা নিতে হলো।

----------------------------------------

“প্লাতেরো আমারে ভালোবাসিয়াছে, আমি বাসিয়াছি
আমাদের দিনগুলি রাত্রি নয়, রাত্রি নয় দিন
যথাযথভাবে সূর্য পূর্ব হতে পশ্চিমে গড়ান
তাঁর লাল বল হতে আলতা ও পায়ের মতো ঝরে
আমাদের-প্লাতেরোর, আমার, নিঃশব্দ ভালোবাসা ।"

মধুরিমার বাবা ছিলেন একটু অন্যধরনের মানুষ। টাটাবাবার স্মেলটারের আগুন আর 
পুড়িয়ে দেওয়া উত্তাপ তাঁর ভিতরের জলধারাকে শুকিয়ে দিতে পারেনি। গান-কবিতাজীবনের
গভীরতর সন্ধানের দিকে অমলিন টান রয়ে গিয়েছিলো । শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের 'চতুর্দশপদী
কবিতা' ছিলো তাঁর প্রিয় বিলাস । আমাদের বিভিন্ন আড্ডা-জমায়েতে অবাধ আসতেন।
বয়সের ফারাক বা বোধের পরিণতি আলাপের মধ্যে কোনও অস্বস্তির কারণ হতো না 
কখনও। চাইবাসা থেকে ফিরে মাঝেমাঝেই তাঁর বৈঠকখানায় আড্ডা হতো আমাদের। 
শক্তি ও বিনয়'কে নিয়ে আমার পাগলামির প্রতি তাঁর বিশেষ দুর্বলতা ছিলো। এই দুই 
কবির কবিতা নিয়ে কথাবাত্তা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে উঠতো প্রায়ই। সেই কথা 
চালাচালির চালচিত্রে শিবের মতন দাঁড়িয়ে থাকতেন জীবনানন্দ । রিমা আগের মতো 
ওদের বাড়ি গেলেই ঘরে এসে বসতো না । কখনও সখনও আসতো, কিন্তু মৌনতাই হয়ে 
যেতো তার অবয়ব। একদিন রাতে ওদের বাড়ি থেকে বেরোবার সময় এগিয়ে দিতে এলো 
বাগান পেরিয়ে । সেদিন চাঁদ ছিলো, হাওয়া ছিলো, ভাসাভাসি হাস্নুহানার গন্ধও ছিলো 
চারদিকে। এ রকম একটা সময়ে সে আমায় বলে, শিবাজিদা, আমাকে কোনোদিন
শক্তির কবিতা শোনাবে, বুঝিয়ে দেবে একটু?
-সে কী রে? তুই বাংলা কবিতা শুনবি ? তাও আবার শক্তির,...?
-কেন, কবিতা কি শুধু পর্ণার জন্য...? আমি....
-আরে শোন শোন... নিশ্চয় শোনাবো...
সে আর অপেক্ষা করেনি, রুদ্ধশ্বাসে ছুটে ফিরে গিয়েছিলো । এতো অচেনা হয়ে গেলো
মেয়েটা ।

অচেনা হয়ে গেলো তো অন্য মেয়েটাও। দিল্লির স্কলারশিপটা পর্ণাকে এগিয়ে দিয়েছিলো
অনেকদূর । ওখান থাকতেই ইন্ডিয়ানা থেকে একটা স্পন্সরশিপ পেয়ে যায় । আমিও খুব
উৎসাহী ছিলুম । যাবার আগে যতোদিন বাড়িতে ছিলো রোজ দেখা করতে চাইতো। সেই
পুরোনো যাবো কি যাবোনা,  হ্যামলেটীয় সংলাপও শুনতে হতো আমাকে । আরে দু'টো 
বছর তো, পলকে কেটে যাবে।

-তোমাকে বিশ্বাস করিনা...
-সেটা ঠিক, কিন্তু একটু করেই দেখোনা, ঠকবে না...
-নেচার অ্যাভরস ভ্যাকুয়াম...
-ভ্যাকুয়াম কোথায় ? ঘাড়ে চড়ে তো আছো-ই...
-সেটাই তো ভয়, সামনে আছি তাই ভালো ছেলে... নয়তো দেশে মধুরিমাও তো আছে...
-আহা ঐ মেয়েটাকে কেন বারবার না জেনে চিমটি কাটো...
-বাহ, স্বরূপ বেরিয়ে পড়েছে দেখছি.. এতো দরদ...
-লো, সুধরেগি নহি বিলকুল...
-নিজেকে শুধরাও আগে, আমি কিছুতেই যাবোনা....
-আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়া গেছে...
-ঠিক, আমিই পাগল..

দিল্লি গিয়েছিলুম পর্ণাকে সী অফ করতে । কী দুর্বল চড়াইয়ের মতো ভাবসাব। এয়ারপোর্টের
গেটে দাঁড়িয়ে, যেন ঢুকলেই বিপদ । ওর বাবা-মা আমাকে বলছেন, ওকে বোঝাও।
বিদেশ-বিভুঁই জায়গা, কতো শক্ত হতে হবে...। কে কাকে বোঝায় ?

আমার বন্ধু সন্দীপন তখন কলম্বস, ওহায়োতে। ওর ঠিকানা দেওয়া ছিলো । খুব পরোপকারী
ছেলে, কোনও অসুবিধে হতে দেবেনা। কিন্তু কোনও আশ্বাসই যথেষ্ট নয় । তখন
অ্যারোগ্রামের জমানা। পাৎলা নীল কাগজ হয়ে অনেকদিন পর্ণা আমার কাছাকাছি ছিলো ।
কিন্তু সব নীল কবে জলের আল্পনা হয়ে মিলিয়ে গেলো, তার খতিয়ান আর রাখা হয়নি।
"হঠাৎ হারিয়ে গেলো, এলোমেলো হাওয়া, ভুল চাঁদ
তার নিচে দাঁত খুলে খোয়াই পেতেছে নীল ফাঁদ
বনের ভিতর হিংস্র জন্তু আছে, মানুষেরা আছে
গাছের শিরার মতো সাপ আছে ছড়িয়ে সেখানে-
এখন কোথায় সে কে জানে?
এখন কোথায় সে কে জানে? .....
...পাথর গড়িয়ে পড়ে, গাছ পড়ে বোধে
মানুষ হারায়, তা কি মানুষেরই ক্রোধে ? "



(ক্রমশ)


(সৌজন্য-গুরুচণ্ডালি)