কালিমাটি অনলাইন / ৭২
গত ২১শে অক্টোবর ছিল আজাদ হিন্দ ফৌজ দিবসের ৭৬তম বার্ষিকী। দেশের বিভিন্ন
অঞ্চলে দিনটি পালিত হয়েছে। যেমন জামশেদপুর শহরেও পালিত হয়েছে ‘মিলনী’ মঞ্চে ‘সুভাষ
সংস্কৃতি পরিষদ’ এবং ‘মিলনী’র যৌথ উদ্যোগে। ‘সুভাষ সংস্কৃতি পরিষদে’র সদস্য-বক্তা রূপে আমিও এই অনুষ্ঠানে
বক্তব্য রেখেছিলাম। বক্তব্য রাখার আগে পর্যন্ত অন্যান্য আমন্ত্রিত বক্তাদের যে বক্তব্য
শুনলাম, তাঁরা প্রত্যেকেই খুবই ভালো বলেছেন, কিন্তু তাঁদের যাবতীয় বক্তব্য ছিল নেতাজী
কেন্দ্রিক। অর্থাৎ আজাদ হিন্দ ফৌজে নেতাজীর নেতৃত্ব, পরিচালনা, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কিত
আলোচনা ও বিশ্লেষণেই তাঁদের বক্তব্য সীমাবদ্ধ ছিল। এবং এই আলোচনা ও বিশ্লেষণ অত্যন্ত
তথ্য ও তত্ত্বপূর্ণও ছিল। কিন্তু আমি বিস্মিত হয়েছিলাম অন্য কারণে। কোনো বক্তাই আজাদ হিন্দ ফৌজ
বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর নাম উল্লেখ করলেন না। এবং শুধুমাত্র এই
আলোচনা সভাতেই নয়, আমি লক্ষ্য করেছি, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের আলোচনায় বিশিষ্ট কয়েকজন
বিপ্লবী ও স্বাধীনতা সংগ্রামীর কথাই উচ্চারিত হয় বারবার, বাকি অধিকাংশ ব্যক্তির নামই থেকে যায় অন্তরালে বা
অন্ধকারে। সাধারণ মানুষ জানতেও পারেন না তাঁদের লড়াই ও আত্মবলিদানের ঐতিহাসিক আলেখ্য।
এটা সত্যিই খুব বেদনার কথা।
আমি তাই সেদিনের বক্তব্যে রাসবিহারী বসু সম্পর্কিত কিছু তথ্য রেখেছিলাম।
আজ ‘কালিমাটি অনলাইন’এর সম্পাদকীয় লিখতে বসেও মনে হলো, এই বিশেষ দিনটির প্রাসঙ্গিকতায়
তাঁর সম্পর্কেই যৎকিঞ্চিত আলোচনা করা যাক। রাসবিহারী বসুর জন্ম হয়েছিল ভারতের পূর্ব
বর্ধমান জেলার সুবলদহ গ্রামে ১৮৮৬ সালের ২৫শে মে। তাঁর বাবার নাম বিনোদবিহারী বসু এবং
মায়ের নাম ভুবনেশ্বরী দেবী। নিতান্ত ছেলেবালায় পড়াশোনার জন্য তিনি গ্রামের পাঠশালায়
ভর্তি হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি মর্টন স্কুলে এবং ডুপ্লে কলেজে পড়াশোনা করেছিলেন।
ছোটবেলা থেকেই তিনি স্কুলের শিক্ষকদের কাছে এবং তাঁর দাদু কালীচরণ বসুর কাছে বিভিন্ন
জাতীয়তাবাদী গল্প শুনে বিপ্লবী আন্দোলনের প্রেরণা পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি দেশের
বিপ্লবী কর্মকাণদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এইসময় তিনি অভিযুক্ত হন আলিপুর বোমা বিস্ফোরণ
মামলায়। সেটা ১৯০৮ সাল। কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর তিনি দেরাদুন চলে যান বন গবেষণা
ইনস্টিটিউটে হেড ক্লার্কের চাকরি পেয়ে। দেরাদুনে থাকাকালীন গোপনে তিনি মিলিত হন বাংলা,
উত্তরপ্রদেশ ও পাঞ্জাবের বিপ্লবীদের সঙ্গে। এর পরেই দিল্লীতে বড়লাট হার্ডিঞ্জের ওপর
প্রাণঘাতী হামলা হয়। রাসবিহারী বসুর নির্দেশে ও পরিচালনায় বিপ্লবী কিশোর বসন্ত বিশ্বাস
বোমা ছোঁড়েন হার্ডিঞ্জকে লক্ষ্য করে। যদিও হার্ডিঞ্জ প্রাণে বেঁচে যান। এটা ১৯১২ সালের
ঘটনা। স্বাভাবিক কারণেই রাসবিহারী বসুকে গ্রেপ্তার করার জন্য ব্রিটিশ শাসকেরা মরিয়া
হয়ে ওঠে। রাসবিহারী বাধ্য হন পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে ভারত ছাড়ার জন্য। ১৯১৫ সালের ১২ই
ডিসেম্বর কলকাতার খিদিরপুর বন্দর থেকে ছদ্ম পরিচয়ে তিনি জাপান যাত্রা করেন। পাসপোর্ট
অফিস থেকে রবীন্দ্রনাথের আত্মীয় রাজা প্রিয়নাথ ঠাকুর পরিচয়ে তিনি পাসপোর্ট সংগ্রহ করেছিলেন।
তিনি যখন জাপানে পৌঁছান, বৃটিশ সরকার তাঁর মাথার দাম রেখেছিল ১২০০০
রুপি বা ৫০০০ বৃটিশ পাউন্ড। সেইসময় বৃটিশ ও জাপান মিত্রশক্তি ছিল। রাসবিহারীর পরেই
ভারত থেকে জাপানে আসেন আরও এক বিপ্লবী হেরেম্বলাল গুপ্ত এবং আরও কিছুদিন পর লালা লাজপত
রায়। বৃটিশ শাসক গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে জাপান সরকারকে তাঁদের গ্রেপ্তার করার জন্য অনুরোধ
করা হয়। স্বাভাবিক কারণেই তাঁরা জাপানের গণমুক্তি
আন্দোলনের কয়েকজন নেতার সহায়তায় আত্মগোপন করেন। হেরেম্বলাল ও লাজপত রায় কিছুদিন পরে
জাপান ছেড়ে আমেরিকায় চলে যান, কিন্তু রাসবিহারীকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত
আত্মগোপন করেই থাকতে হয়। এইসময় তিনি জাপানের অন্যতম গণমুক্তি আন্দোলনের নেতা তোয়ামা
মিৎসুরুর জ্যেষ্ঠাকন্যা সোওমা তোশিকোর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
পরবর্তীকালে রাসবিহারী বসুর তৎপরতায় জাপানি কর্তৃপক্ষ ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের পাশে দাঁড়ায় এবং ভারতের স্বাধীনতা
সংগ্রামে সক্রিয় সহযোগিতা জোগায়। ১৯৪২ সালের ২৮-২৯শে মার্চ রাসবিহারীর আহ্বানে টোকিওতে
একটি সম্মেলনে ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ গঠন করা হয়। রাসবিহারী সেই সম্মেলনে একটি
সেনাবাহিনী গঠনেরও প্রস্তাব পেশ করেন। ১৯৪২
সালের ২২শে জুন ব্যাংককে দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে রাসবিহারীর অনুরোধে
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগে যোগদান করেন। যেসব ভারতীয় সৈন্য
মালয় ও বার্মা ফ্রন্টে জাপানিদের হাতে বন্দী ছিলেন, তাঁরা ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স
লিগের সশস্ত্র সেনাবাহিনী ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি বা আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগদান করেন।
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক। রাসবিহারী বসু অবশ্য আর
বেশিদিন জীবিত ছিলেন না। ১৯৪৫ সালের ২১শে জানুয়ারী তিনি প্রয়াত হন।
আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা
:
kajalsen1952@gmail.com
/ kalimationline100@gmail.com
দূরভাষ যোগাযোগ :
08789040217 / 09835544675
অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand,
India