প্রক্রিয়া থাক
বহুভাষিকতার — একভাষিকতার প্রকল্প নয়
ত্রিভাষা সূত্র নিয়ে আবার ঝামেলা শুরু হয়েছে। হিন্দি শেখানো বা না শেখানো নিয়ে।
আমাদের ছোটবেলায় ক্লাস ফাইভ থেকে সেভেন পর্যন্ত হিন্দি শিখতে হতো। এইটে সংস্কৃত।
আমার ছেলে মেয়েদের ফাইভ থেকে সেভেন পর্যন্ত হিন্দি বা সংস্কৃত। কিন্তু তাতে আমার
হিন্দি জ্ঞান যত হয়েছিলো ওদের সংস্কৃত জ্ঞান তার থেকে বেশি বা কম হয়নি। একা তিনশোর
নরেন্দ্রবাবু এবং তাঁর দল হিন্দি-হিন্দুস্থানের সঙ্ঘী লক্ষ্যে বহুভাষিকতার নামে দেশের যোগ-ভাষা হিসেবে ক্লাস এইট পর্যন্ত
আবশ্যিক পাঠ্য করতে গিয়ে দক্ষিণী রাজ্যগুলির চাপে পিছিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু এই
প্রোজেক্ট বা প্রকল্প পরে আবার আসবে, আসবেই।
কিন্তু প্রক্রিয়া হিসেবে বহুভাষিকতা
এদেশের ঐতিহ্য ছিল। শিশিরকুমার দাস ভারতে প্রাচীন রোমকদের মধ্যে তুলনামূলক
সাহিত্যের ‘Suncrisis’ পদ্ধতির অনুরূপ
কোনো পদ্ধতিতে সুপ্রাচীন সংস্কৃত এবং তামিল
সাহিত্যকে কাছে আনার ও পরস্পর সম্পর্কে অধ্যয়নের কোনো প্রয়াস ভারতে না দেখতে পেলেও, একটি প্রাক্-ঔপনিবেশিক ভারতীয় সাহিত্যের ধারণাকে দাঁড় করিয়েছেন প্রাচীন সংস্কৃত পণ্ডিতদের প্রাকৃত-জ্ঞান ও বহুভাষিকতার উপর। তাছাড়াও তিনি অন্য গবেষকদের উপরে নির্ভর করে দেখাতে চেয়েছেন যে দক্ষিণ ভারতে খুব
সম্ভবতঃ প্রাকৃত সাহিত্য প্রাচীন তামিল সাহিত্যের সঙ্গে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করেছিল। এর উদাহরণ ২০০-৮০০ খ্রীষ্টাব্দের
মধ্যে সঙ্কলিত মহারাষ্ট্রীয় প্রাকৃত পদ্যসংগ্রহ গাথাসত্তসাই (গাথাসপ্তশতী)-এর সঙ্গে তামিল সাহিত্যের সম্পর্ক; মধ্যযুগে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ভাষাগুলির সংস্কৃতের সাধারণ উত্তরাধিকার এবং আরবী
ও ফারসি প্রভাবের প্রতি বিভিন্ন মাত্রার উন্মোচনের কারণে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক; এবং মধ্যযুগ থেকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের সুভাষিতর মিল, যা বিভিন্ন ভাষায় লেখা গ্রন্থের আন্তঃসম্পর্ক বিষয়ে সাধারণ পাঠকের
বোধকে বিম্বিত করে। যেমন অন্ধ্রপ্রদেশের একটি প্রবাদ অনুযায়ী বিল্বমঙ্গল জয়দেব হিসেবে, জয়দেব নারায়ণ তীর্থ হিসেবে এবং নারায়ণ তীর্থক্ষেত্রেয় হিসেবে
পুনর্জন্ম পেয়েছেন, যদিও এঁরা আলাদা
আলাদা জায়গায় কয়েক শতাব্দীর ব্যবধানে জন্মগ্রহণ করেন। সমগ্র মধ্যযুগ ধরে’ প্রতিবেশী বা
সন্নিহিত সাহিত্য সমূহের এই মিথস্ক্রিয়া চলতে থাকার প্রমাণ ‘new
genres, themes and occasionally styles’-এর আবির্ভাব, যেমন সংস্কৃত ও মালয়ালমের মধ্যে পরস্পর যোগের কারণে ‘মণিপ্রভালম্’ নামের স্টাইলের জন্ম ও চতুর্দশ শতাব্দীতে তার আলোচক কবিখ্যাত সংস্কৃতভাষী গ্রন্থ, লীলাতিলকম্। ভারতীয় সাহিত্যে ফারসী প্রভাব
বাড়ার পর এই আন্তর্ভাষিকতা যে আরো দৃঢ় হয় তার প্রমাণ উর্দুর জন্ম।১
ইউ. আর. অনন্ত মূর্তি জানিয়েছেন
এই বেবেল-টাওয়ার প্রতিম দেশেও দু-তিনটি ভাষা জানলেও যে কোনো জায়গায় মানুষ কাজ চালিয়ে নিতে পারে। বরং অনন্ত মূর্তি তাঁর প্রিয়তত্ত্ব আওড়েছেন যে ভারতবর্ষে কেউ যত বেশি শিক্ষিত ততই
কম ভাষা বলে, যারা ইংরেজি-শিক্ষিত তারা তো কেবল ইংরেজিতেই কথা বলে। তাঁর চেনা যে ছোট শহরগুলিতে যে অর্ধশিক্ষিত মানুষরা তামিল, তেলেগু, মালয়ালম, কিছুটা
হিন্দি এবং কিছুটা ইংরেজি বলে তারাই ভারতবর্ষকে একত্র রেখেছে, শিক্ষিত একভাষীরা নয়। ভারতবর্ষ যে অতীতকাল থেকেই
একটা বহুভাষিকতার বাতাবরণে বাস করেছে, তার প্রমাণ শঙ্করাচার্য (মালয়ালম / সংস্কৃত), আনন্দতীর্থ (ঘরে টুলু,
বাইরে কন্নড়, লেখায় সংস্কৃত), রামানুজ (তামিল / সংস্কৃত),
বুদ্ধ (সংস্কৃত / পালি),
এমনকি ভারতীয় সভ্যতার ‘critical insider’ গান্ধী
(গুজরাটি, হিন্দুস্থানি, ইংরেজি)।২ আমরা এরসঙ্গে একই
যোগ করতে পারি যে রাজিন্দর সিং বেদী, ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, যশপাল, বা সাহির
লুধিয়ানভি পাঞ্জাবি হয়েও হিন্দি বা উর্দুতে লিখতেন, আর সর্দার
কর্তার সিং হিতকারি একে একে সংস্কৃত, ব্রজভাষা এবং পাঞ্জাবিতে
ভক্তিকাব্য লিখেছিলেন।৩ আবার বাংলার মহিষাদলে
জাত বিখ্যাত হিন্দিকবি নিরালার (সূর্যকান্ত
ত্রিপাঠী) প্রথম কবিতা ছিল বাংলায়, যদিও
তিনি বাড়িতে ‘বৈস্বারী’ বা পূর্বীহিন্দি
বলতেন, আর আরো পরে খাড়িবোলি শিখে ত্রিশোর্ধ্ব বয়সে হিন্দি হৃৎভূমিতে,
প্রথমে লক্ষ্ণৌ, তারপর এলাহাবাদে চলে যান।৪ অনন্ত মূর্তির মতে এই বহুভাষিকতার সঙ্গে যোজ্য আরো দুটি ‘ভাষা’, রামায়ণ ও মহাভারত। কারণ বহু ভারতীয় এই দুই মহাকাব্য না পড়েও বিভিন্ন পদ্ধতিতে তার সংস্পর্শে এসেছে, প্রভাবিত হয়েছে, আর তাদের বিবিধ
‘text’-কে আত্মসাৎ করেছে। আধুনিক ভারতীয় লেখকদের কাছে তাই এইসব ভাষার বহু বেণীসঙ্গম ছাড়াও সংস্কৃত, ইংরেজি, অনুবাদে ফরাসী ও পর্তুগিজ,
আর অবশ্যই অনুবাদে এবং ওরিজিন্যালে রুশ, আয়ত্ত
সাধ্য ছিল। তাদের সঙ্গেই ছিল একটি ‘great and
new phenomenon in the Indian languages … the dalits’, যাঁরা প্রথমে
মারাঠি, তারপর গুজরাটি, কন্নড়, তেলেগু এবং তামিল ভাষায় লিখতে শুরু করেন। এর দ্বারা অনুপ্রেষিত ললিতাম্বিকা অন্তর্জনম, মহাদেবী বর্মা, এবং মহাশ্বেতা দেবীর মতো লেখকদের নারীবাদী
সাহিত্য বা তার আর দলিত সাহিত্যের মিশ্র। ভারতীয় ভাষাগুলিকে অনন্ত মূর্তি আলংকারিক অর্থে ‘জীর্ণাগ্নি’ বা সর্বভুক অগ্নির সঙ্গে তুলনা করেছেন। তারা একসময় সংস্কৃতকে আত্মসাৎ করেছিল, এখন ইউরোপকে করছে।
এই প্রক্রিয়া আবার চালু হোক বা থাকুক। বলিউডি ছবির কারণে সারা ভারত কথ্যহিন্দি জানে। কিন্তু একে আবার প্রোজেক্ট
করলেই বিপদ। আর
মোদি কোন হিন্দিকে যোগ-ভাষা করতে চাইছেন? ১৯০৪ সালে গ্রিয়ারসন যে Linguistic survey of India বের করেছিলেন তার মধ্যে বিশাল বিশাল পঞ্চম খণ্ড
অংশতঃ বিহারি, ষষ্ঠ খণ্ড পূর্বী হিন্দি, নবম খণ্ড পশ্চিমা হিন্দিকে নিয়ে। ১৯৬১-র যে
ভাষাভিত্তিক সেন্সাস হয়, তার ১৬৫১টি ভাষার মধ্যে অনেকগুলি হিন্দির নাম ছিল।
একটা কারণ অবশ্যই সব্বাই ভাষাগত আত্মপরিচয় বজায় রাখতে চেয়েছিল। জানি কেউ বলবেন ১৯৫১
সালে ভারতীয়ত্ব তত জোরালো ছিল না। কিন্তু ২০১১ সালের সেন্সাসেও কেবল দশ সহস্রের
বেশি কথক অনুযায়ী কেবল হিন্দি ভাষীর সংখ্যা হলো, গোষ্ঠি হিসেবে গোষ্ঠি হিসেবে
হিন্দি ৫২,৮৩,৪৭,১৯৩; অবধী ৩৮,৫০,৯০৬; বাঘাটি/বাঘাটি পাহাড়ি ১৫,৮৩৫; বাঘেল/বাঘেলখণ্ডী
২৬,৭৯,১২৯; বাগড়ি রাজস্থানী ২,৩৪,২২৭; বাঞ্জারি ১৫,৮১,২৭১; ভদ্রওয়াহি ৯৮,৮০৬; ভাগোরিয়া ২০,৯২৪; ভারমোউরি/গড্ডি ১,৮১,০৬৯; ভোজপুরী ৫,০৫,৯৭,৪৪৭;বিশ্নয় ১২,০৭৯;
ব্রজভাষা ১৫,৫৬,৩১৪; বুন্দেলি/ বুন্দেলখণ্ডী ৫৬,২৬,৩৫৬; চাম্বিয়ালি/চামরালি ১,২৫,৭৪৬;
ছত্তিসগড়ী ১,৬২,৪৫,১৯০; চুরাহি ৭৫,৫৫২; ঢুণ্ঢরী ১৪,৭৬,৪৪৬; গাড়ওয়ালি ২৪,৮২,০৮৯;
খাড়ি বোলি ৫০,১৯৫; খোরঠা/খোট্টা ৮০,৩৮,৭৩৫; কুলভি ১,৯৬,২৯৫; কুমায়ুনি ২০,৮১,০৫৭; কুর্মালি
থর ৩,১১,১৭৫; লামানি/লাম্বাডি/লাবানি ৩২,৭৬,৫৪৮; লারিয়া ৮৯,৮৭৬;লোধি ১,৩৯,১৮০; মগধী/মগহী
১,২৭,০৬,১২৫; মালবী ৫২,১২,৬১৭; মান্ডিয়ালি ৬,২২,৫৯০; মাড়োয়াড়ি ৭৮,৩১,৭৪৯; মেওয়ারি
৪২,১২,২৬২; নাগপুরিয়া ৭,৬৩,০১৪; নিমাডি ২৩,০৯,২৬; পাট্টনি ১৬,৫১০; পাদারি ১৭,২৭৯;
পঞ্চি ১৩,৮১২; পাহাড়ি ৩২,৫৩,৮৮৯; পালমুহা ২৩,৫৭৯; পাঁচ পরগনিয়া ২,৪৪,৯১৪;
পান্ডো/পান্ডোয়ানি ১৫,৫৯৫; পাঙ্গোয়ালি ১৮,৬৬৮; পাওয়াই/পওয়ারি ৩,২৫,৭৭২;
পুরান/পুরান ভাষা ১২,৩৭৫; রাজস্থানি ২,৫৮,০৬,৩৩৪; সদন/সাদ্রি ৪৩,৪৫,৬৭৭; সিরমাউরি
১,৪৭,৪০১; সোন্দওয়ারি ২,২৯,৭৮৮; সুগালি ১,৭০,৯৮৭; সুরগুজিয়া
১৭,৩৮২৫৬; সুরযপুরি ২২,৫৬,২২৮; অন্যান্য ১,৬৭,১৭০।
এই হিন্দি
উপভাষাগুলির ওই একক হিন্দির বিষয়ে কী দৃষ্টিভঙ্গি তা বুঝতে কেবল মৈথিলী আর হিন্দির
পরস্পর সম্পর্ক বুঝলেই একটা খেই পাওয়া যাবে। বিহারের মাতৃভাষা হিসেবে সরকারিভাবে
স্বীকৃত মৈথিলী হিন্দিকে ভারতের সরকারি ভাষা বা রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে চাইলেও
হিন্দির মধ্যে নিজের সত্তা হারানোর বিরোধী—মৈথিলীকে হিন্দির উপভাষা বলতে রাজি
নন। মৈথিলীর বিশাল মুখপাত্র, ডঃ অমরনাথ ঝা ১৯৪৩ সালে মৈথিলীভাষার বই হিন্দি সাহিত্য
সম্মেলনের দ্বারা প্রকাশকে ১৯৪৩ সালে ‘লজ্জাকর’ বলেছিলেন। ১৯৪৭ সালে অ্যালাহাবাদ
বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অভ হিন্দি যে তিন খণ্ডের হিন্দি সাহিত্যের
ইতিহাস বের করতে উদ্যোগী হয়েছিল, তাতে তৃতীয় খণ্ডে অবধী, ভোজপুরী, বুন্দেলি,
মাড়োয়াড়ি এবং মৈথিলীর ইতিহাস থাকার কথা ছিল। মৈথিলী ভাষাবিদ ডঃ উমেশ মিশ্রকে এর
উপরে একটা লেখা দিতে বললে তিনি গররাজি হন এই কারণে যে মৈথিলী একটি স্বাধীন ভাষা।
তার আলাদা ইতিহাস আছে।৫
আসলে এখানে ভাষা আত্মপরিচয়ের বাহন ও বাহক। অনেক পণ্ডিত হিন্দির জয়যাত্রায় ‘কবীর মীরাবাঈ তুলসীদাস সুরদাস, নরসিং
মেহতা-দাদু-রসখান-লালদেদ-নাভাজীদাস’ ইত্যাদির কথা বলতে গিয়ে আবেগে একঘর হন। এঁদের
কোন হিন্দি উপভাষায় রাখতে হবে তাঁরা বলতে পারবে তো? রুশ পর্যটক লেবেডেভ সাহেব কলকাতার যে স্থানীয় হিন্দির
অভিধান/ব্যাকরণ করে গেলেন, তা কলকাতায়
মারোয়াড়িরা আসার আগে আপ-কান্ট্রি হিন্দিভাষীদের জগাখিচুড়ি, যাতে পাঞ্জাবী,
উত্তর প্রদেশের, বিহারের মানুষের মুখের ভাষা ছিল মিলে মিশে। সেটা
রাশায় বলে এলাম।
ভারতের
মানুষের ভাষার অধিকারের আবেগ এইভাবে সমাধান করা যাবে না। ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে ইন্দো-ইউরোপীয়
ভাষাগোষ্ঠির ৫৪টি ভাষা বলেন জনসংখ্যার
প্রায় তিন-চতুর্থাংশ মানুষ; কুড়িটি
দ্রাবিড়ীয় ভাষাগোষ্ঠির ভাষী প্রায় এক-চতুর্থাংশ মানুষ; ২০টি Mon
Khmer ভাষাগোষ্ঠির এবং ৯৮টি Sino-Tibetan ভাষাগোষ্ঠির ভাষী হলেন জনসংখ্যার
মাত্র দুই শতাংশ।৬
অনন্তমূর্তি কোথাও লিখেছেন কোনো
ভাষার নিজস্ব সাহিত্য হতে গেলে তার রাষ্ট্র আর সেনাবাহিনী চাই। কিন্তু ভারতবর্ষে
অনেক ভাষার তো নিজস্ব রাজ্যই নেই, যদিও
তাদের জনসংখ্যা ইউরোপের অনেক ভাষার চেয়ে বেশি। তাদের মধ্যে
প্রায় পঁয়ষট্টি লক্ষ সাঁওতালির কিয়দংশের মাথার উপর ঝাড়খণ্ডের সীমিত ছাদ আছে, কিন্তু প্রায় তেইশ লক্ষ ডোগ্রির, প্রায়
চোদ্দ লক্ষ বড়োর, পঁচিশ লক্ষ কোঙ্কানির, ঊনত্রিশ লক্ষ নেপালির, ছাব্বিশ লক্ষ
সিন্ধির, দশ লক্ষ ভিলির, সাতাশ
লক্ষাধিক গোণ্ডির, প্রায় এগারো লক্ষ হো-র, প্রায় আঠারো লক্ষ কুরুখ/ওঁরাওর, প্রায় এগারো লক্ষ
মুণ্ডারির, সতেরো লক্ষাধিক টুলুর, প্রায় ছাব্বিশ লক্ষ সিন্ধির ভাষার উপর মাথার উপর
রাজ্যের ছাদও নেই; রাষ্ট্র আর সেনাবাহিনী (গেরিলা বাহিনী
বাদে) কল্পনারও বাইরে। তার চেয়েও বড়
কথা চোদ্দ হাজারের কিছু বেশি সংস্কৃতভাষী আছেন, আর ইংরেজিভাষীর সংখ্যা অনেক
ভারতীয় ভাষার থেকেও বেশি, প্রায় তেইশ লক্ষ।৭ ভাষাগুলির
মধ্যে স্কুলে পড়ানো হয় ৫৮টি, খবরের কাগজ আছে ৮৭টিতে, ৭১টিতে রেডিও
প্রোগ্রাম, ১৫টিতে চলচ্চিত্র,৮ আর
অন্ততঃ এই বছর থেকে ইউ.পি.এস.সি.র মূল (Mains) পরীক্ষাতেও
পরীক্ষার্থী সব কটি আঞ্চলিক ভাষায় বসতে পারে। বাকি মানুষরা
ভারতবর্ষের ভাষা-সংখ্যালঘু।৯ এঁদের অনেকেরই নিজস্ব লিপিই নেই অথবা তার দাবি মানা হচ্ছে না। এর পরেও গোদের উপর
বিষফোঁড়া হিসেবে আছে ভাষা-ইতিহাস রচনার (historiography) কাঠামোয় বহিষ্করণের রাজনীতি, যার শিকার কেবল
অরুণাচলের মতো প্রান্তিক ভূমি বা তার মানুষ নয়,১০
কোথাও-কখনো এমনকি ঊর্দুর মতো সমৃদ্ধ সাহিত্যও।১১ বাকি অবজ্ঞাত ভাষা/সাহিত্যগুলির ‘খবর কে রাখে’, যদিও প্রায়ই তাদের ‘কোন্ দূরের হাওয়া’ ভারত সাহিত্যের সন্নিষ্ঠ ‘সুরের পাগলাকে’ রসবাণিজ্যের ডাক দিয়ে যায়।
তাহলে কেউ বলবেন এতো ভাষা বৈচিত্র্যের
মধ্যে ভারতে কথা হবে কী করে? কী করে হবে নয়, ভাবুন কী করে হচ্ছে। এই বহুভাষিকতা
নিয়ে কবি যশোধরা
রায়চৌধুরীর একটি পোস্টে স্মিতা খাটোর (Smi Ta) নাম্নী আমার এক অতিসাম্প্রতিক ফেসখী পারিবারিক কারণে তাঁর রাজস্থানী হিন্দি আর
বঙ্গদেশের দু’তিনটি জেলার বাংলাভাষা বলা মার কথা বলেছিলেন। আর সেই প্রসঙ্গেই তাঁর
নিজের কাজের অভিজ্ঞতায় পাওয়া বহুভাষিকতা
নিয়ে একটা নিজের আগের পোস্ট দিয়ে দিয়েছিলেন। ঋণ স্বীকার করে তাঁর সেই বক্তব্য
হুবহু তুলে দিচ্ছি।
“ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমরা ভাষা নিয়ে অনেক আলাপ আলোচনা
করি। বহুমুখী সমৃদ্ধ এই আলোচনার মধ্যে যদিও খুব একটা খেয়াল
করিনি এমন আলোচনা যেখানে আমাদের দেশজোড়া পরিযায়ী শ্রমিকদের ভাষাজগৎ, তাঁদের ভাষাগত সমস্যার দিক উঠে আসে। উড়িষ্যার অজন্মাপীড়িত, খরাবিধ্বস্ত কালাহাণ্ডি
আর বোলাঙ্গির জেলা থেকে কাতারে কাতারে যে নারী এবং পুরুষরা তেলেঙ্গানা আর অন্ধ্র প্রদেশের
ইটভাঁটাগুলোয় কাজে যান অনেকেই বাধ্য হন স্কুলপড়ুয়া সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে যেতে, দেশের বাড়িতে যেহেতু তাদের দেখভাল করার কেউ থাকে না। কোথাও কোথাও পরিযায়ী শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য স্কুল আছেও, কিন্তু ভাষা এত বড়ো একটা সমস্যা যে অধিকাংশই পড়াশোনার
পাট চুকিয়ে বাবা মার কাজে হাত লাগায়। সারা দেশের বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরত
অভিবাসী শ্রমিকদের,
বিশেষ করে যেখানে ইটভাঁটার মতো পরিবারকে
ইউনিট ধরে কাজ হয় সেখানে এটা খুব বড়ো একটা সমস্যা। এক সাংবাদিক বন্ধু যখন অন্ধ্র প্রদেশের সাঙ্গারেড্ডি জেলার আন্নারাম গ্রামের ইটভাঁটায়
কাজে গিয়েছিলেন তখন উড়িষ্যার নুয়াপাড়া জেলার কুরুমপুরি গ্রামের পরিযায়ী শ্রমিকরা এটা
শুনে খুব খুশি হয়েছিলেন যে তিনিও তাঁদেরই জেলার মানুষ। তাঁদের মধ্যে বয়সে বড়ো একজন শ্রমিক বলেছিলেন, ‘বহুদিন বাদে এমন কারও দেখা পেলাম যে ওড়িয়া ভাষায় কথা বলছে’।
কেরলের
কান্নুর জেলার চেরুমাভিলায়ি গ্রামের নির্মাণশ্রমিক মুহাম্মদ শফি সারাদিনের ইঁট, চুন, সিমেন্ট, সুরকির কাজ শেষ হলে অনুবাদের কাজে হাত লাগান। কিশোর বয়সে কাজের সন্ধানে দেশান্তরী হন। ব্যাঙ্গালোর শহরে একটা চায়ের স্টল দেন। সেখানে আসতেন তামিল শ্রমিকরা। তাঁদের মধ্যে থেকেই তিনি তামিল রপ্ত
করেন। একটি রাশিয়ান গল্প তামিল থেকে মালায়লামে অনুবাদ করেন। সি পি আইয়ের মালায়লাম দৈনিক জনযুগমে পাঠান। ১৯৮৫ সালে সেটি প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে অনুবাদ করেছেন পেরুমলমুরুগন
সহ আরও অনেকের লেখা গল্প, উপন্যাস। একবার পিসাইনাথ আমাদের বলেছিলেন পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে এমন অনেককে তিনি দেখেছেন
যাঁরা সহজেই পাঁচ সাতটা ভাষা গড়গড় করে বলতে পারেন... পেটের দায়ে তাঁরা নিজেই শিখে যান আর কি! অবশ্য এসব তাঁদের স্কিলের পরিচায়ক নয়, তাঁদের পরিচয়
'আনস্কিল্ড লেবার' হিসেবেই।”১২
ফলে ভারতের
যোগসূত্র ভাষার সমাধানসূত্র এই বাধ্যতঃ নিরক্ষরদের হাতে ছেড়ে রাখলে বহুভাষিকতা প্রক্রিয়া হিসেবে চলবেই। তাকে প্রকল্প করার
দরকার এই।
এদের মধ্যে ওই হিন্দভি বা
হিন্দকী কোথায়? ওঁকে বলবে ‘কবীর মীরাবাঈ তুলসীদাস সুরদাস বহু কণ্ঠস্বরকে একাকার করে এই রথযাত্রা।
নরসিং মেহতা-দাদু-রসখা -লালদেদ-নাভাজীদাস কত বুলি একাকার হল এই cultural melting
point-এ’ সেটা এই ভাষাগুলির কোনটায় কোনটায় রাখবো? মীরাবাঈকে বোধহয় মেওয়ারিতে রাখতে
হবে (৪২,১২,২৬২ কথকের); কবীরকে আর বাকিদের কোনগুলিতে তা
আমিও অনুমান করার চেষ্টা করতে পারি। করছি না।
রুশ পর্যটক লেবেডেভ সাহেব কলকাতার যে স্থানীয় হিন্দির অভিধান করে গেলেন, তা কলকাতায় মারোয়াড়িরা আসার আগে আপ-কান্ট্রি
হিন্দিভাষীদের জগাখিচুড়ি, যাতে পাঞ্জাবী, উত্তর প্রদেশের, বিহারের মানুষের মুখের ভাষা ছিল মিলে মিশে। সেটা রাশায় বলে এলাম। কবীরের সব
দোঁহা প্রধানমন্ত্রী পড়ে অর্থ উদ্ধার করতে পারবেন তো?
গ্রন্থসূত্র
1. Sisir
Kumar Das, ‘Comparative Literature in India: A Historical Perspective’, Journal of the Comparative Literature
association of India, 1(February 2011): pp. 18-29, esp. 18-21.
2. U. R. Ananthamurthy, ‘Towards the Concept of a New Nationhood: Languages
and Literatures in India’, in U. R.
Ananthamurthy Omnibus, (ed.) N. Manu Chakravorty (Gurgaon, Delhi: Arvind
Kumar, 2007), pp. 289-99, Omnibus.
3. Carlo Coppola and Amrita Pritam, ‘Amrita Pritam’ in Mahfil 5(3) Amrita Pritam Number: 5-6 (1968-1969), courtesy http://www.jstor.org/
stable/40874236, accessed: 24 July 2013.
4. Heidi Pauwels, ‘Diptych in Verse: Gender Hybridity, Language Consciousness,
and National Identity in Nirālā’s “Jago Phir
Ek Bār”’, Journal of the American Oriental Society
121:3 (2001): 449-81, esp. 450.
5. Paul R. Brass, Language, Religion and
Politics in North India (Lincoln, NE : iUniverse, 2005),pp.69-72.
6. U. R. Ananthamurthy, ‘The Fragmented
Vision’, Omnibus, pp. 300-302.
7. এই ভাষাভাষীদের যথাযথ সংখ্যার জন্য
দেখুন, Statement 1 and 4, Census
of India, 2001, Office of the Registrar General and …, censusindia.gov.in/, ২৪শে জুলাই ২০১৩-তে দৃষ্ট।
8. www.indiansaga.com/languages/, ২৪শে জুলাই ২০১৩-তে দৃষ্ট।
9. Myron Weiner, ‘India’s Minorities: Who are They? What
Do They Want?’, in Partha Chatterjee, State
and Politics in India (ed.) Partha Chatterjee (Delhi: Oxford University
Press, 1998), pp. 463-67.
10.
Stuart
Blackburn, ‘Unscripted: The People of Arunachal Pradesh in Literary and Other
National Histories’, in Hans Herder (Ed.) Literature
and Nationalist Ideology: Writing Histories of Modern Indian Languages (New
Delhi: Social Science Press, 2011), pp. 305-23.
11.
Navina
Gupta, ‘The Politics of Exclusion? The Place of Muslims, Urdu and Literature in
Ramachandra Shukla’s Hindi Sahitya Ka
Itihas’, Herder, Literature and
Nationalist Ideology, pp. 259-81.
12.
সৌজন্যে স্মিতা খাটোর ও তাঁর
পোস্ট।
1