বুধবার, ১ নভেম্বর, ২০১৭

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

কালিমাটি অনলাইন / ৫০


গত ২৬শে অক্টোবর ভারতের একটি বহুল প্রচারিত হিন্দী সংবাদপত্র ‘দৈনিক ভাস্কর’এ একটি সংবাদ পড়ে খুব ভালো লেগেছিলবিষয়টা এমন কোনো অভিনব  নয়, কিন্তু যে কোনো ঘটনার সঙ্গেই যেমন স্থান-কাল-পাত্রর একটা ব্যাপার থাকে, ঠিক সেই কারণেই এই ঘটনাটা আমাকে এখানে পুনরাল্লেখ করার উৎসাহ যোগালো। যাঁরা হিন্দী চলচ্চিত্রের অনুরাগী, তাঁরা সবাই একদা চলচ্চিত্র নায়িকা টুইঙ্কল খান্নার নামের সঙ্গে পরিচিত। অনেকে নিশ্চয়ই তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্রও দেখেছেন। তবে টুইঙ্কল খান্না নিজের নামে যতটা পরিচিত, তার থেকে হয়তো বেশি পরিচিত তাঁর একদা সুপারস্টার বাবা-মা রাজেশ খান্না ও ডিম্পল (কাপাডিয়া) খান্নার কন্যা রূপে। এখন অবশ্য তিনি তাঁর স্বামী বর্তমান সুপারস্টার অক্ষয়কুমারের সূত্রেও সুপরিচিত। কিন্তু এসব উল্লেখযোগ্য পরিচিতির বাইরেও তিনি মাঝে মাঝেই সংবাদপত্রের পাতায় উঠে আসেন তাঁর বিভিন্ন বিষয়ে অত্যন্ত সাহসী ও যুক্তিপূর্ণ অভিমত ও মন্তব্যের কারণে। যেমন মাস কয়েক আগে হিন্দী চলচ্চিত্রের নামী প্রযোজক করণ  জোহরের একটি ছবিতে অত্যন্ত ভক্তি ও নিষ্ঠার আবহাওয়ায় প্রদর্শিত হয়েছিল স্বামীর কল্যাণ কামনায় হিন্দুধর্মে বিশ্বাসী স্ত্রীদের করওয়া চৌথ ব্রত পালনের চিরাচরিত প্রথাআরও অন্যান্য ব্রতর মতোই এই ব্রত উপলক্ষ্যেও স্ত্রীরা সারাদিন নির্জলা উপোস করে থেকে রাতে আকাশে চাঁদের উদয় হলে সেই চাঁদ ও স্বামীর মুখমন্ডল আটা-ময়দা চালার চালুনির মধ্য দিয়ে দর্শন করার পর ব্রত ভঙ্গ করেন। টুইঙ্কল ঠিক এই ব্যাপারটাকেই উল্লেখ করে বলেছিলেন যে, এইসব ব্রত পালনকে এভাবে গৌরাবান্বিত করে দেখানোর আদৌ কোনো যৌক্তিকতা নেই, প্রয়োজনও নেই। সারাদিন অনাহারে থেকে কারও কোনো প্রাপ্তিরও আদৌ সম্ভাবনা নেই। বরং মহিলাদের প্রয়োজন পুষ্টিযুক্ত আহারের। সেই প্রয়োজন মেটানোর জন্য সবাই কতটা আগ্রহী ও যত্নবান? বিশেষত অভাবী ও দরিদ্র মহিলাদের জন্য কেউ কি কিছু করার কথা ভেবেছেন?

গত ২৬শে অক্টোবরের সংবাদপত্রের বিষয়টা অবশ্য আলাদা। সেখানে টুইঙ্কলের একটি ছবি মুদ্রিত হয়েছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, টুইঙ্কল মেঝেতে ছড়ানো একগাদা বইয়ের মাঝখানে বসে আছেন জুতো পড়ে। এবং শুধু তাই নয়, তিনি কোনো মোড়া বা টুলের পরিবর্তে বসে আছেন একথাক বইয়ের ওপর। খবরে জানা গেল, একটি ফ্যাশান ম্যাগাজিনের জন্য তিনি এই ছবিটি শ্যুট করিয়েছিলেন এবং তিনি নিজেই তা কোনো এক সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করেছিলেন। ব্যাস আর দেখতে হলো না, সরস্বতীর বরপুত্র-কন্যারা ঝাঁপিয়ে পড়লেন ‘ট্রোলিং’এ। তাঁরা রীতিমতো রাগ প্রকাশ  করে লিখলেন, “আমাদের দেশে বইয়ের পুজো করা হয়, বইকে স্বয়ং সরস্বতী মনে  করা হয়। আর আপনি সেই বইয়ের ওপর জুতো সহ বসে ফটো শ্যুট করেছেন? আপনার লজ্জিত হওয়া উচিৎ!” এর উত্তরে টুইঙ্কল অত্যন্ত নম্র ভাবে লিখেছেন  সেইসব অতি অল্পে ক্রোধিত ‘ট্রোলার’দের উদ্দেশ্যে, “আমার পা একটি টুলের ওপরে রাখা আছে, বইয়ের ওপরে নয়, কেননা আমি চাই না যে আমার পায়ের  ধুলো বইয়ের কভারে লাগুক। এছাড়া আমার বইয়ের ওপর বসতে, বইয়ের সঙ্গে শুতে, এমনকি বাথরুমে নিয়ে গিয়ে পড়তে কোনো সমস্যা নেই”। সেইসঙ্গে তিনি সংযোজন করেছেন, “বুদ্ধির দেবতা তখনই আপনার কাছে আসবেন, যখন আপনি পড়বেন। পুজো করে তা সম্ভব নয়”।

টুইঙ্কলের এই অভিমতের পরে এই প্রাসঙ্গিকতায় আর কোনো অভিমত প্রকাশ করার কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমি বলে মনে করি না। তাই এখানেই এবারের সম্পাদকীয় লেখার ইতি টানছি।

সবাইকে জানাই হৈমন্তিক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা।




নভেম্বর সংখ্যা ‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের জন্য সম্পাদকীয় লেখা দিন দুয়েক আগেই শেষ করেছিলাম। তখন ভাবতেও পারিনি যে, সম্পাদকীয়তে পুনশ্চ সংযোজন করতে হবে। গতকাল সকালে ঘুম থেকে উঠেই দুঃসংবাদটা পেলাম, আমাদের অতি আপনজন বিশিষ্ট কবি ও গদ্যকার বারীন ঘোষাল, আমাদের সবার প্রিয় বারীনদা, প্রয়াত হয়েছেন ২৯শে অক্টোবর রাত ১টা ১০ মিনিটে। দিন কয়েক  আগেই তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে জামশেদপুরের টাটা মেইন হসপিটালে ভর্তি হয়েছিলেন। শারীরিক অবস্থা সত্যি সত্যিই ভালো ছিল না। কিন্তু এর আগেও বেশ কয়েকবার তিনি সাংঘাতিক অসুস্থ হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, আবার আমাদের সব আশঙ্কাকে মিথ্যে প্রমাণিত করে সুস্থ হয়ে ফিরেও এসেছেন। আর তাই এবারও আমরা আশঙ্কিত হলেও মনের মধ্যে একটা আশার আলো জ্বেলে রেখেছিলাম যে, বারীনদা এবারেও জিতে যাবেন, তিনি আবার ফিরে আসবেন প্রতি  বারের মতোই। কিন্তু বাস্তব বড় নির্মম ও নিষ্করুণ। বারীনদা এবার আর সুস্থ হয়ে  আমাদের কাছে ফিরে আসতে পারলেন না। তাঁর মরদেহের শেষযাত্রায় সামিল হয়ে তাঁকে আমরা রেখে আসতে বাধ্য হলাম নির্জন একাকীত্বে। এখন থেকে বারীনদা আর আমাদের সঙ্গে সাক্ষাতে কোনো কথা বলবেন না। আমাদের যৎসামান্য লেখা পড়ে তিনি আর তাঁর ভালোলাগা বা না-লাগার কথা বলবেন না। কোনো পরামর্শ বা উপদেশ অথবা আলোচনা, কিছুই করবেন না। বরং এখন তাঁর হয়ে আমাদের সঙ্গে নিরন্তর কথা বলে যাবে তাঁর লেখা অজস্র কবিতা, গল্প, ঝুরোগল্প, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, সমালোচনা এবং সেইসঙ্গে অবশ্যই তাঁর লেখা অসংখ্য চিঠিপত্র। আর এভাবেই তিনি শারীরিক ভাবে হারিয়ে গেলেও আমাদের মননে চিন্তনে সজীব তরতাজা থেকে যাবেন চিরদিন।

আমাদের প্রণত শ্রদ্ধা নিবেদন করি তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে।

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :
kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com 

দূরভাষ যোগাযোগ :           
08789040217 / 09835544675
                                                        
অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India



সুনীতি দেবনাথ

গণিতবিদমনীষী রাধানাথ শিকদার




Sir, I have discovered the highest mountain in the world! 

হিন্দু কলেজে ডিরোজিওর শিষ্যমণ্ডলীর এক প্রতিভাদীপ্ত উনিশ শতকীয় মনীষা রাধানাথ শিকদার শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর ‘রামতনু লাহিড়ী তৎকালীন বঙ্গসমাজ’  বইয়ে মন্তব্য করেছেন, রাধানাথ শিকদারও “ডিরোজিও বৃক্ষের একটি উৎকৃষ্ট ফল” বাংলার নবজাগরণের অগ্রপথিক রাজা রামমোহন রায় সুদীর্ঘকাল ধরে বিদেশী ইংরেজ সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছিলেন এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিশেষ করে আধুনিক বিজ্ঞান, দর্শন ইত্যাদি প্রচলন করার জন্য কিন্তু বিদেশী সরকারের অযথা ঢিলেমিতে তা হচ্ছিল না এমনি পরিস্থিতিতে রামমোহন, ডেভিড হেয়ার এবং বাংলার উচ্চশিক্ষাকামী উচ্চবিত্ত জনসমাজ পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের জন্য একটা কলেজ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলেন অবশেষে ‘হিন্দু কলেজ’ নামে সেই কাঙ্ক্ষিত কলেজ স্থাপিত হলো পরবর্তীতে এর নাম হয় ‘প্রেসিডেন্সি কলেজ’ ১৮১৭ সালের ২০ জানুয়ারি হিন্দু কলেজ স্থাপিত হয়  

হিন্দু কলেজের তরুণ বয়স্ক স্বাধীনচেতা, মুক্তমনা, প্রবল উদ্দীপনা শক্তির উৎস হেনরি লুইস ভিভিয়ান ডিরোজিও প্রগতিপন্থী মুক্ত ভাবনাচিন্তার ঝড় তুলে  ছাত্রসমাজকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেন তাঁর প্রভাবে নতুন করে গড়ে ওঠা একটা ছাত্রগোষ্ঠী যাঁরা নতুন ভাবনাচিন্তা বিশেষ করে পাশ্চাত্য ভাবনায় জীর্ণ শীর্ণকায় সমাজের স্থলে আধুনিক একটা সমাজ গড়ে তুলতে প্রচণ্ড আন্দোলন শুরু করেন  এঁদের বলা হতো ‘ইয়ং বেঙ্গল’ গোষ্ঠি, ডিরোজিও এঁদের নেতা ছিলেন বলে এঁদের ডিরোজিয়ানও বলা হতো এই গোষ্ঠির প্রতিভাবান একেকজন ভবিষ্যতে সমাজের দিগ্ গজ ব্যক্তি হয়ে  ওঠেন যেমন কৃষ্ণমোহন ব্যানার্জি, রামতনু লাহিড়ী,প্যারীচাঁদ মিত্র প্রমুখরা তেমনি ছিলেন রাধানাথ শিকদারসেকালের প্রতিভাবান অসামান্য গণিতবিদ, লেখক, সুবক্তা, মুক্ত চিন্তার ধারক তথা বাহক এবং সমাজমনস্ক যুক্তিবিদ

ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধে ১৮১৩ খ্রীস্টাব্দের আশ্বিন মাসে কলকাতার জোড়াসাঁকোর  শিকদার পাড়ায় এই অসামান্য ব্যক্তি রাধানাথের জন্ম হয় তাঁর পিতা তিতুরাম শিকদার রাধানাথ ছাড়াও তিতুরামের আরেক পুত্র সন্তান শ্রীনাথ তিন কন্যা ছিলেন রাধানাথ সর্বজ্যেষ্ঠ ছিলেন শিকদারেরা ছিলেন ব্রাহ্মণ বংশীয় এবং কলকাতার অতি পুরোনো বাসিন্দা নবাব আমলে এঁদের পূর্বপুরুষেরা বংশপরম্পরায় পুলিশ কমিশনের কাজ করতেন এঁদের অধীনে থাকত লেঠেল,পাইক, সেনা এসব, যাদের সাহায্যে শিকদারেরা দুষ্ট ব্যক্তিদের ধরপাকড়, কয়েদ করা, সাজা দান এসব করতে পারতেন অনেক ক্ষেত্রে শক্তির অপব্যবহার হতে দেখা গেছে যে শক্তি লোকরক্ষার্থে তাঁদের হাতে অর্পিত হয়েছিল তা তাঁরা লোকপীড়নেও ব্যবহার করতে থাকেন জনশ্রুতি আছে যে কলকাতা ইংরেজদের হাতে চলে যাবার পর ফৌজদারি কার্যভার মুর্শিদাবাদের নবাবের হাতে থাকাকালে কোন এক ব্যক্তিকে শিকদারেরা প্রচণ্ড অত্যাচার করেন খবর পেয়ে ইংরেজরা শিকদারদের হাত থেকে সমস্ত ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়

এই তথ্যাবলী শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘রামতনু লাহিড়ী তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ অনুসারেই সংকলিত

রাধানাথ শিকদারের সমকালে তাঁদের বংশের আর কেউ শিকদারের কাজ করতেন না রাধানাথ তাঁর ছোট ভাই শ্রীনাথ কিছুদিন পাঠশালায় পড়ার পর ফিরিঙ্গি কমল বসুর স্কুলে ভর্তি হন ১৮২৪ সালে রাধানাথকে 'হিন্দু কলেজে' ভর্তি করা হয় এখানে তিনি দশ বৎসর সাত মাস পড়াশুনা করেন রাধানাথের অভ্যেস ছিলো দিনলিপি লেখার, এই দিনলিপি থেকে তাঁর সমকালীন বহু তথ্যই মেলেরাধানাথের কণিষ্ঠ ভাই শ্রীনাথের সহপাঠী ছিলেন রামতনু লাহিড়ী,যাঁর সঙ্গে গভীর অন্তরঙ্গতা ছিলো শ্রীনাথের শ্রীনাথের সঙ্গে প্রায়ই রামতনু তাঁদের বাড়ী আসতেন শ্রীনাথের মায়ের পুত্রতুল্য অকৃত্রিম আন্তরিকতার কথা আদরযত্ন রামতনু কোনদিনই ভুলতে পারেননি

রাধানাথ মেধাবী ছাত্র ছিলেন প্রতি শ্রেণীতেই তিনি ভালো ছাত্রদের একজন ছিলেন প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে তখনকার রীতি অনুযায়ী ষোল টাকা বৃত্তি লাভ করেন শিক্ষনীয় অন্যান্য বিষয় অপেক্ষা গণিতের প্রতি তাঁর বেশি আগ্রহ ছিলো সে সময় .টাইটলার নামে একজন অগ্রগণ্য সুপণ্ডিত শিক্ষক হিন্দু কলেজে ছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয় অনুমান করেন এই .টাইটলার রামমোহন রায়ের গ্রন্থাবলীতে . টাইটলারের সঙ্গে যেসব বিচারের কথা বলা হয়েছে তিনিই হবেন .টাইটলার সংস্কৃত ভাষা পড়তে শুনতে খুব ভালোবাসতেন ছাত্ররা শিক্ষকের এই দুর্বলতা জানতো বলে আবোলতাবোল সংস্কৃত শ্লোক বলে তাঁকে আনমনা করে আপাত শাস্তি থেকে মুুক্তি পেতো সে সময় . টাইটলার সম্পর্কে নানা আজগুবি গল্প প্রচলিত ছিলো

প্রকৃতপক্ষে .টাইটলার গণিত বিদ্যায় অত্যন্ত সুপণ্ডিত ছিলেন কলকাতায় গণিতে তাঁর মত পারদর্শী কেউ ছিলেন না রাধানাথ শিকদার তাঁর কাছেই ' গণিত বিদ্যা শেখেন এবং নিউটনের ‘প্রিন্সিপিয়া’ও পড়েন ডিরোজিও একাডেমিক স্থাপন করলে  ডিরোজিওর শিষ্যদের মধ্যে রাধানাথ একজন অগ্রগণ্য ব্যক্তি হয়ে উঠেন শাস্ত্রী মহাশয় রাধানাথের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আলোচনা করতে গিয়ে বলেন যে, তাঁর শরীর ছিলো বলশালী আর মনও ছিলো সাহসী কথা কাজে ছিলো সাযুজ্য মুখে যা বলতেন তা করে দেখাতেন কাউকে ভয় পেতেন না যেমন, তেমনি কারও মুখাপেক্ষীও ছিলেন না নিজের উপলব্ধি আন্তরিক বিশ্বাসের উপর যুক্তিনিষ্ঠভাবেই তিনি দৃঢ়সংকল্প হয়ে কাজ করতেন তার একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ মেলে তাঁর বিবাহ সম্পর্কিত সিদ্ধান্তে তখনকার প্রথা অনুযায়ী আট দশ বছরের কন্যাকে বিবাহ করতে হতো আত্মীয় স্বজন এমন কি মায়ের অনুরোধেও কোন অবস্থায় তিনি বাল্য বিবাহে সম্মত হননি তাঁর মাতৃভক্তির বিষয় বিখ্যাত ছিলো, মায়ের প্রতি তাঁর যে অগাধ ভালবাসা শ্রদ্ধা ছিলো তাও কিন্তু রাধানাথকে তাঁর যুক্তিসিদ্ধ সিদ্ধান্ত থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি সত্য কর্তব্য নিষ্ঠাই এতে প্রকাশিত হয় আন্তরিক সত্য বিশ্বাসকে কোন মূল্যেই তিনি বিসর্জন দিতে নারাজ ছিলেন

রাধানাথের কর্তব্যনিষ্ঠাও উল্লেখ করতে হয় তাঁদের পারিবারিক অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন স্বচ্ছল ছিলো না তাই ১৮৩২ সালে তিনি হিন্দু কলেজে প্রথম শ্রেণীতে পড়ার সময়ই জি.টি.সার্ভে অপিসে ৩০ টাকা বেতনে কম্পিউটার অর্থাৎ সার্ভেয়ারের কাজ পেয়ে যোগদান করেন একাজ করার সময় তাঁর ইচ্ছে হলো ইংরেজি ভাষার বিজ্ঞান বিষয়ক বই সংস্কৃতে অনুবাদ করেন তাই নিষ্ঠা সহ তিনি সংস্কৃত পড়তে শুরু করেন কিন্তু চাকরির জন্য কলকাতা ছাড়তে হলো বলে তা বেশিদিন করতে পারলেন না দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে তাঁকে চলে যেতে হলো

রাধানাথ ডিরোজিয়ানদের মধ্যে একমাত্র ব্যক্তি যিনি শিক্ষাকালীন বিষয়কে আজীবন আঁকড়ে ছিলেন অর্থাৎ 'গণিত বিদ্যা ' তাঁর জীবিকা তথা জীবনের সর্বোচ্চ কৃতিত্বের সহায়ক হয় তিনি বাল্যকাল থেকে গণিতকে ভালোবেসেছেন আর এই বিষয়কে অবলম্বন করে জীবনের মহত্তম বৃহত্তম কাজ সম্পাদন করেন তিনিই সেই মেধাবী বঙ্গ সন্তান যিনি গাণিতিক পরিমাপ করে মাউন্ট এভারেস্ট যে সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ তা আবিষ্কার করে প্রতিষ্ঠা দিলেন  ব্যাপারে তিনিই প্রথম ব্যক্তি গণিতবিদ্যার কুশলতা কোন মাত্রায় গেলে এমন জটিল কাজ করা যায় তা সহজেই অনুমেয় জন্মের দুশো বছর পার হয়ে গেলেও রাধানাথের মনস্বীতা আজো শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়

জি.টি.সার্ভে অফিসে রাধানাথ যোগদান করার আগে থেকে ওয়েলস্-এর একজন বিখ্যাত সার্ভেয়ার ভূতত্ত্ববিদ জর্জ এভারেস্ট ১৮৪৩ সাল পর্যন্ত ভারতের সার্ভেয়ার জেনারেল ছিলেন তাঁর উপর দায়িত্ব ছিলো ' Great Trigonometric Survey of India ' সম্পাদন করা এবং তার সাথে দক্ষিণ ভারত থেকে শুরু করে নেপাল পর্যন্ত প্রসারিত 'meridian arc ' - এর একেবারে সঠিক মাপ স্থির করা এই পদ্ধতির সাহায্যে ' geoid '- এর আনুমানিক আকৃতি স্থির করা যায় এই পদ্ধতিকে বলা হয় 'Determination of the Figure of Earth ' যাই হোক জর্জ এভারেস্ট হিন্দু কলেজের .টাইটলারের কাছে একজন ব্রিলিয়ান্ট যুবক গণিতবিদের জন্য আবেদন জানান রাধানাথকে সুযোগ্য মনে করে তাঁকে নির্বাচন করেন এই গণিতবিদকে স্পেরিক্যাল ট্রিগুনোমেট্রিতে সুদক্ষ হবার শর্ত ছিলো রাধানাথের সে গুণ ছিলো মাত্র উনিশ বছর বয়সে অসীম সাহস নিয়ে রাধানাথ কাজে যোগ দিলেন এই কঠিন কাজে তিনি একজন সার্ভেয়ার হিসেবে যোগদান করেন শীঘ্রই তাঁকে দেরাদুনের কাছে সিরোজে পাঠানো হলো

সিরোজে তিনি ‘জিওডেটিক প্রোসেস’ সম্পর্কে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ নেন এই  বিষয়ে তিনি স্বকীয় কিছু পদ্ধতিও আবিষ্কার করে ফেললেন রাধানাথের কৃতিত্বে জর্জ এভারেস্ট অত্যন্ত অভিভূত হয়েছিলেন সময় রাধানাথ জি.টি.এস.ছেড়ে ডেপুটি কালেক্টর হয়ে চলে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু জর্জ এভারেস্ট তাঁর মত একজন সুযোগ্য সুদক্ষ ব্যক্তিকে হাতছাড়া করতে চাননি তাই তাঁকে বললেন যে, কোনও সরকারি অফিসার এক ডিপার্টমেন্ট ছেড়ে অন্য ডিপার্টমেন্টে যেতে হলে তাঁর ওপরওয়ালার অনুমতি ব্যতীত যেতে পারেন না জর্জ এভারেস্ট বাগড়া দেওয়ার জন্য তিনি আর যেতে পারলেন না ১৮৪৩ সালে জর্জ এভারেস্ট অবসর গ্রহণ করলে জি.টি.এস.- এর ডিরেক্টর হলেন কর্ণেল ওয়াঘ

বিশ বছর উত্তর ভারতে কাজ করার পর ১৮৫১ সালে রাধানাথ কলকাতা বদলি হয়ে আসেন পদোন্নতি হয়ে তখন তিনি চীফ কম্পিউটার এই পদের অতিরিক্ত তাঁকে Mateorological Department - সুপারিনটেণ্ডেডেন্টের কাজও করতে হচ্ছিল এই বিভাগে কাজ করার সময় তিনি স্ব- আবিষ্কৃত কতগুলি পদ্ধতি প্রচলন করলেন যা পরবর্তী বহু দশক ধরে আদর্শ পদ্ধতি রূপে ব্যবহৃত হচ্ছিল এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারটি হলো বিভিন্ন তাপমাত্রায় ব্যারোমিটারের যে রিডিং নেওয়া হয় সেটাকে ৩২ ডিগ্রি ফারেনহাইটে পরিবর্তিত করার ফর্মুলা

কর্ণেল ওয়াঘের নির্দেশে রাধানাথকে চিরতুষারাবৃত হিমালয়ের শৃঙ্গগুলির উচ্চতা মাপার জন্য দার্জিলিং অঞ্চলে যেতে হলো তিনি শৃঙ্গ XV -এর ছয়টি বিভিন্ন দিক পর্যবেক্ষণ করে পরিসংখ্যানসমূহ একত্রিত  করে সাজালেন এবং বিচার বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে XV শৃঙ্গটি পৃথিবীর উচ্চতম শৃঙ্গ এরপর তথ্য সমূহের সম্পূর্ণ রিপোর্ট কর্ণেল ওয়াঘের কাছে পাঠিয়ে দেন ওয়াঘ সে সময় অন্যান্য পরিসংখ্যান নিয়ে সতর্কভাবে বিশ্লেষণ করছিলেন কয়েক বছর পরে সব মিলিয়ে তিনি যখন সন্তুষ্ট হলেন,, তখন জনসমক্ষে এই তথ্য জানালেন যখন কোন শৃঙ্গের নামকরণ করা হতো তখন স্থানীয় নাম প্রাধান্য পাবার রেওয়াজ প্রচারিত ছিলো বিষয়ে এভারেস্ট সাহেব নিজেও গুরুত্ব দিতেন কিন্তু ওয়াঘ ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি তাঁর আগের বসের নামে এই শৃঙ্গের নামকরণের প্রস্তাব দিলেন এভারেস্ট সাহেবও তা মেনে নিলেন এভাবে একটা পরাধীন দেশে বিশাল এক প্রতিভাধর মানুষ বিস্মৃতির অন্তরালে ঢাকা পড়ে গেলেন নামকরণের বিষয়ে স্থানীয় নাম ব্যবহারের প্রশ্ন ওঠে, কিন্তু শৃঙ্গটির নানা অঞ্চলে নানা নাম ছিলো তাই ব্যক্তির নামে নামকরণের প্রশ্ন আসে সে সুযোগে ওয়াঘ সাহেব এক ঢিলে দুই পাখি মারলেন প্রাক্তন বসকে তিনি খুশি করলেন যেমন, তেমনি পরাধীন দেশের উপযুক্ত ব্যক্তিকে বঞ্চিত করলেন শাসক প্রভুর প্রতিনিধি হয়ে  তিনি বিজিত দেশকে, দেশবাসীকে যোগ্য সম্মান দেবার মত উন্নত মানসিকতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন অথচ রাধানাথই শৃঙ্গটির আবিষ্কারকতাঁর শ্রম, নিষ্ঠা আর প্রতিভাদীপ্ত গাণিতিক প্রযুক্তিগত অধিগম্যতাই তাঁকে  এই সাফল্য দিয়েছিল ব্রিটিশ শাসনাধীন একটা দেশে রাধানাথ শিকদারের মত বিশাল মাপের গণিতবিদ তাঁর প্রতিভার যোগ্য সম্মান পাননি সারা পৃথিবীতেই এমন একজন গণিতবিদ দুর্লভ রাধানাথ জীবনের  বিশাল একটা পরিসরকে যে কঠোর কাজে লাগিয়ে অবিনশ্বর কীর্তি স্থাপন করেন, তার যথাযোগ্য মর্যাদা তিনি পরাধীন দেশে পাননি দিনের পর দিন অরণ্য প্রান্তরে জটিল সব অঙ্কের গিঁট খুলে খুলেই তাঁর দিন কেটেছে আর ফল যদিও সুবিশাল তবু তাঁর লব্ধ সত্য প্রকাশ করা হলেও তাঁকে পরাধীন দেশে পর্দার আড়ালে সরিয়ে দেবার কলঙ্কময় প্রয়াসের ইতিহাস রচিত হয়েছে

১৮৬২ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন জেনারেল এসেমব্লিজ ইনস্টিটিউশনে পরে তাঁকে গণিত বিদ্যার শিক্ষক নিয়োগ করা হয়এটাই পরবর্তী সময়ে স্কটিশ চার্চ কলেজ হয় সংক্ষিপ্ত পরিসরে রাধানাথের জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক আলোচনা করা যায় বন্ধু প্যারীচাঁদ মিত্র ‘মাসিক পত্রিকা’ নামে একটি ম্যাগাজিন বের করেন  রাধানাথও এই পত্রিকার সহযোগী ছিলেন পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য ছিলো নারী শিক্ষা নারীর ক্ষমতায়নের জন্য প্রয়াস চালিয়ে যাওয়া রাধানাথের লেখার ভাষা ছিলো সহজ সরল অনাবশ্যকতা বর্জিত সে যুগের লেখালেখিতে এটি আদর্শ স্টাইল বলে গণ্য হয়


পিতার মৃত্যুর 'বছর পরে তিনি বাড়ি ফিরে আসেন তাঁর আচার বিচার, চালচলন এমনকি খাদ্যাভ্যাস ইংরেজের মত হয়ে গেছে শেষদিকে চন্দননগরে গঙ্গাতীরে গোঁদলপাড়াতে একটা বাগানবাড়ি কিনে শান্ত পরিবেশে বাস করছিলেন তাঁর নিজের কোন সন্তান নেই, তবু শিশুদের খুব ভালোবাসতেন আত্মীয় স্বজনদের শিশুদের এনে তাদের সঙ্গে গল্প করতে, খেলতে ভালোবাসতেনসেখানেই পৃথিবীর আশ্চর্য এক মনীষী ১৮৭০ সালের ১৭ মে সব গননার কাজ শেষ করে চিরনিদ্রায় শুয়ে পড়েন পেছনে যে ইতিহাস রেখে গেলেন তা যুগপৎ আমাদের গর্বোন্নত করে এবং এক অসহায় বেদনায় নিজেদের বড় ছোট ভাবায় বৃহৎমনা বলেই নিজ জীবনের বঞ্চনাকে তিনি তুচ্ছ করতে পেরেছিলেন