মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

কালিমাটি অনলাইন / ৪২


শেষ হলো ২০১৭ কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা। এটা ছিল বইমেলার ৪১তম বছর। বিগত কয়েক বছর ধরে আমরা ঠিক এই সময় মুদ্রিত ‘কালিমাটি’ পত্রিকার একটি সংখ্যা প্রকাশ করে থাকি। বস্তুত ১০০তম ‘কালিমাটি’ প্রকাশের পর আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, এবার থেকে বছরে একটি মাত্র সংখ্যা প্রকাশ করা হবে এবং সেই  সংখ্যাটি কোনো সাধারণ সংখ্যা নয়, বরং কোনো একটি বিষয় বা ভাবনার ওপর বিশেষ সংখ্যা। এভাবেই গত ২০১৫ কলকাতা বইমেলায় প্রকাশ করেছিলাম ১০১তম সংখ্যা,  বিষয় ছিল ‘পরকীয়া’তারপর ২০১৬ কলকাতা বইমেলায় ১০২তম সংখ্যা, বিষয় ‘সমকামিতা ও রূপান্তরকামিতা’আর এবছর ২০১৭ কলকাতায় প্রকাশিত হলো ১০৩তম সংখ্যা, বিষয় ‘অতিপ্রাকৃত’এখানে আর একটি কথা উল্লেখ করা যেতে পারে, ‘কালিমাটি’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যা থেকে ১০১তম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ‘কালিমাটি প্রকাশনা’ থেকে। ১০২তম সংখ্যা থেকে ‘কালিমাটি’ প্রকাশের দায়িত্ব গ্রহণ করে ‘সৃষ্টিসুখ প্রকাশন’। 

প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি, আমরা ‘কালিমাটি’ ১০৩তম সংখ্যায় আলোচনার জন্য কেন বেছে নিয়েছি অতিপ্রাকৃত বিষয়টিকে। এবং এই সূত্রেই    উদ্ধৃত করছি পত্রিকার সম্পাদকীয় বক্তব্য।

“ভূত-ভবিষ্যত-বর্তমান, জীবনের এই তিনটি পর্যায়ে আমরা নিজেদের অজান্তেই সামিল হয়ে যাই। কিন্তু শক্তি অর্থাৎ শরীরের ভেতরের শক্তি এবং শরীরের বাইরের শক্তি, এই দুই বিমূর্ত অনুভবের কাছে আমরা কীভাবে সামিল হতে পারি! যেমন যতদিন পর্যন্ত ভাইরাসের অস্তিত্ব আমাদের গোচরের বাইরে ছিল, আমরা তাকে মেনে নিতে পারিনি। প্রমাণের অপেক্ষায় থেকেছি। আসলে অপ্রাকৃত বা অতিপ্রাকৃত, ইংরেজিতে যাকে ‘সুপারন্যাচারাল’ বলা হয়, এই বিষয়টি এখনও পর্যন্ত আমাদের সবার কাছেই রহস্যময় ও কুয়াশাচ্ছন্ন। আবার অতিপ্রাকৃত বলতে সাধারণত দুটি বিষয়ের ভাবনা মাথায় আসে – ভূত ও ঈশ্বর। বিশেষত এই দুই অশরীরীকে অধিকাংশ মানুষই ভয় করেন। আর ভয় থেকেই আসে ভক্তি। আসলে আমরা সবাই ভয় পেতে ভালোবাসি।

এই ধরুন শরীরের অবয়বের বাইরে যে শরীরীবোধ আছে, যা ধরেও ঠিক ধরতে পারা যায় না; আবার যে ভয়ের প্রতি আমরা আকৃষ্ট হই, তার কূল কিনারা খুঁজে না পেলেও মন অনেক সময় তা বিশ্বাস করতে চায়। এই যেমন কোনো গরু আকাশে উড়বে, এটা নিতান্তই অবাস্তব; কিন্তু গরু আকাশে উড়তে গেলে যা যা প্রয়োজন, তা সবই বাস্তবের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ অভ্যাসগত ভাবে যা কিছু আমরা চাক্ষুস করি, তাই আমরা বিশ্বাস করি। কিন্তু অবিশ্বাসেরও অনেক উপাদান বাস্তব দিয়েই সৃষ্টি করা হয়।

আবার দেখুন স্টকহোমে সংরক্ষিত ডেভিল’স বাইবেল, ন্যাক্রোম্যানসি, নাইট মেয়ারস প্ল্যানচেট, উইচক্র্যাফট – এসবের তাৎপর্যই বা কী! অথবা এই অদ্ভুত জগত না থাকলেও যদি কোনো তরঙ্গদৈর্ঘ্য থাকে, তারাই বা কীভাবে শক্তি বন্টন করে! অনেকেরই বিশ্বাস আত্মা ছিল এবং আছে। কিন্তু ভূত মানে তো অতীত, আর আত্মা মানে এক্টোপ্লাজিমিয় বায়বতা! বিজ্ঞান এসব মানে না, স্বীকার করে না। কারণ এর কোনো ব্যাখ্যা নেই, প্রমাণ নেই। অথচ এই যে সব ‘সুপারন্যাচারাল’ ধারণা বা ‘কনসেপ্ট’, যা বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিকোণে কখনই গ্রহণযোগ্য নয়, তা কিন্তু মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে চলেছে মানবসভ্যতার সেই প্রাকপর্ব থেকেই। আর তাই স্বাভাবিক কারণেই মনুষ্যসৃষ্ট যে কোনো সৃজনেও তার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়  শিক্ষা, সাহিত্য, কলা, সংস্কৃতি, ধর্ম, জীবনচর্যা, প্রথা, আচার আচরণ – সর্বত্রই।

আর ঠিক এই অবস্থানে দাঁড়িয়ে ‘কালিমাটি’ পত্রিকার ১০৩তম সংখ্যায় আলোচনার জন্য আমরা বেছে নিয়েছি ‘অতিপ্রাকৃত’ বিষয়টিকে। এই সংখ্যায় মাননীয় লেখকেরা তাঁদের জ্ঞান, পান্ডিত্য, অভিজ্ঞতা ও উদার স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গিতে বিষয়টির গভীরে প্রবেশ করে গবেষণামূলক অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করেছেন এবং প্রবন্ধ, নিবন্ধ, গল্প ও কবিতার আঙ্গিকে তা পরিবেশন করেছেন। আশাকরি আমাদের এই প্রয়াস আপনাদের ভালো লাগবে”

  
আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

দূরভাষ যোগাযোগ :           
0657-2757506 / 09835544675
                                                         
অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India

      

অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী

শুধু হাসে মহাকাল -


যুদ্ধকালীন পোস্টার ও কার্টুনে নেতাজি  ও আজাদ হিন্দ ফৌজ



আজ থেকে প্রায় পঁচাত্তর বছর আগে এক শীতের রাতে কলকাতায় নজরবন্দি দশা থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের চোখ এড়িয়ে বেরিয়ে যান ভারতের মুক্তিসংগ্রামের  আপোষহীন নায়ক সুভাষচন্দ্র বসু। স্বদেশের শৃঙ্খলমোচনের স্বপ্নে বিশ্রামহীন ও অতন্দ্র একটি মানুষ কীভাবে দেশ দেশান্তর-পাহাড়-সমুদ্র পার হয়ে প্রায় একক প্রয়াসে বিদেশের মাটিতে গড়ে তুললেন এক স্বাধীন সরকার ও মুক্তিফৌজ, সে ইতিহাস আজ আর কারো অজানা নয়। যতদিন সুভাষচন্দ্র ছিলেন ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এক লড়াকু বামপন্থী নেতা, ততদিন তিনি যে নানা উপলক্ষে বারবার পত্রপত্রিকার কলমলেখকদের কটাক্ষ ও রঙ্গব্যঙ্গের  আর ব্যঙ্গচিত্রীদের কার্টুনের বিষয়বস্তু  হয়েছেন, তা আমরা এর আগে একটি আলোচনায় দেখেছি। [দ্রষ্টব্য-- http:// www.kalimationline. blogspot.in/2016/01/blog- post_45.html] কিন্তু ১৯৪১ সাল থেকে সুভাষচন্দ্রের বর্ণময় কর্মকান্ডের প্রেক্ষাপটের দ্রুত পরিবর্তনের ফলে তাঁর  বিচরণের কেন্দ্রস্থলও আবর্তিত হতে থাকে কখনও জার্মানিতে, কখনও বা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিস্তৃত রণাঙ্গনে ফলে যিনি আগে ছিলেন প্রধানত ভারতের পত্রপত্রিকার  কার্টুনিস্টদের ব্যঙ্গবাণের নিশানায়, তিনি অচিরেই হয়ে পড়লেন, নানা দেশের রাজনৈতিক প্রচারের, বিশেষ করে কার্টুন ও পোস্টারের এক বহুচর্চিত বিষয়বস্তু।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রনীতির যে শক্তিসংস্থান, সেখানে যেহেতু সুভাষচন্দ্রের অবস্থানটি ছিল মিত্রশক্তির বিপক্ষে এবং কাজে কাজেই চিরাচরিত কূটনীতির অনুসরণে যেহেতু তিনি যোগ দিয়েছিলেন অক্ষশক্তির শিবিরে, বিবাদমান ওই  দুই পক্ষই অবতীর্ণ হয়েছিল তাঁর বিপক্ষে বা সপক্ষে প্রচারযুদ্ধে। আর কার্টুন আর পোস্টার-লীফলেট যে সেই প্রচারের যে একটি জনপ্রিয় হাতিয়ার, সে কথা তো বলাই বাহুল্য। তাই এই যুদ্ধকালীন সুভাষবিষয়ক পোস্টার ও কার্টুনগুলিকে আমরা মোটামুটি  তিনটি শ্রেণীতে বিভাজন করতে পারি, যথা মিত্রশক্তি অর্থাৎ ব্রিটিশ-আমেরিকানদের আর জাপান সরকারের ব্যবহৃত কার্টুন ও পোস্টার এবং ভারতের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত ব্যঙ্গচিত্র।     

ইঙ্গ-মার্কিন প্রচারপত্রে নেতাজির কার্টুন

পূর্ব এশিয়ার রণাঙ্গণে জাপানের সামরিক সহায়তায় ভারত সীমান্তের দিকে নেতাজি পরিচালিত আজাদ হিন্দ বাহিনী যুদ্ধযাত্রা করেছিল ১৯৪৪ সালে। ব্রিটিশ ও আজাদ হিন্দ ফৌজ দুপক্ষেই ছিল ভারতীয় সৈনিকেরা, যারা ছিল ব্রিটিশ প্রচারের লক্ষ্য। এই প্রচারের প্রধানত দুটি উদ্দেশ্য ছিল - ব্রিটিশ পক্ষের ভারতীয় সৈনিকদের সামনে তাদেরই স্বজাতিভুক্ত সেনাদের স্বদেশের মুক্তি-অর্জনের লক্ষ্যে অসমসাহসিক সংগ্রামের ছবিটাকে ঝাপসা করে দেওয়া আর মুক্তিকামী আজাদী সেনাদেরও মনোবল নষ্ট করে তাদের হতাশাগ্রস্ত করে দেওয়া। এই দুটি উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য ব্রিটিশ তথা মিত্রপক্ষের প্রচারের লাইন ছিল নেতাজি সুভাষচন্দ্রের ভূমিকাকে মসিলিপ্ত করে তাঁকে বিশ্বাসঘাতকরূপে চিত্রিত করা ও সে সঙ্গে জাপানি জুজুর ভারত দখলের ভয়  দেখানো। জাপান, নেতাজি ও তাঁর আজাদ হিন্দ বাহিনীকে [আই এন এ] ব্যঙ্গ করে আঁকা ছবির সঙ্গে নানা ভারতীয় ভাষায়  লেখা বক্তব্য সহ এই লিফলেটগুলো বিমানের সাহায্যে যুদ্ধক্ষেত্রে ভারতীয় সেনাদের অবস্থানস্থলের ওপর ফেলা হতো 


আমাদের আলোচ্য এমন প্রচারপত্রগুলোর প্রথমটিতে দেখা যাচ্ছে এক জাপানী বোমায় আরোহন করে ভারতীয় জনগণের ওপর নেমে আসছে এক ব্যক্তি, তার পিঠে দুটি পাখাও দেখা যাচ্ছে। বোমার ওপর জাপানের পতাকা আঁকা আর বোমাকে জড়িয়ে থাকা লোকটির হাতে লেখা বোস[বাঁ দিকের ছবি - চিত্র-১]  ছবির ইঙ্গিত অত্যন্ত স্পষ্ট জাপান ও সুভাষচন্দ্রের আঁতাত ভারতীয়দের জন্য কী মারাত্মক বিপদ ডেকে আনবে সেটাই প্রচারের মূল বক্তব্য। ছবির সঙ্গে র্দুতে ও প্রচারপত্রের পেছনের  পিঠে আরও তিনটি ভাষায় ভারতীয় দেশপ্রেমিকদেরউদ্দেশে আবেদন জানানো হয়েছে গান্ধী ও সুভাষের দুটি উক্তির উদ্ধৃতি সহ। আবেদনের মর্ম এ রকম - ভারতীয় দেশপ্রেমিকদের প্রতি পড়ুন তাঁরা কী বলেন আর ভাবুন! মহাত্মা গান্ধিঃ- আমি কোনোভাবেই বিদেশী শৃঙ্খল থেকে ভারতের মুক্তির প্রয়াসে সহায়তার জন্য কোন শক্তিকে আবেদন করতে ইচ্ছুক নই। সুভাষবাবুর নীতিতে আমার অনুমোদনের কোন প্রশ্নই ওঠে না। জাপানকে ভারতে ডেকে আনার কাজকে আমি সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করতে চাই। আমি চাই ভারতের প্রত্যেকটি লোক জাপানের বিরোধিতা করুক [হরিজন, ২১-৬-১৯৪২]এর ঠিক নিচে উদ্ধৃত হয়েছে নেতাজির দুটি মন্তব্যঃ- শ্রীসুভাষবাবুঃ- বাইরের সাহায্যগ্রহণ ছাড়া ভারতের বিপ্লব সাফল্যমন্ডিত হবেনা। একজনের স্বদেশের মুক্তি অর্জনের জন্য অন্যান্য রাষ্ট্রের সহায়তাগ্রহণ পৃথিবীর ইতিহাসে কোনও নূতন জিনিষ নয় [ভাষণ, ৬ জুলাই, ১৯৪৩] জাপানের উদ্দেশ্য নিয়ে  সন্দেহ বা অবিশ্বাসের কোনো কারণ আমি দেখিনা[ভাষণ৬ জুলাই, ১৯৪৩]



আমাদের আলোচ্য পরবর্তী ব্রিটিশ কার্টুনটির বিষয়বস্তু ভারতের কুইসিলিং সন্তানকুইসিলিংএখানে বিশ্বাসঘাতকবা বিদেশীর তাঁবেদারের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, যা সুভাষচন্দ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধকালে ও তার পরেও তাঁর বিরোধীরা আকছার ব্যবহার করেছে। এখানে জানানো যায় যে, নাৎসি জার্মানি নরওয়ে দখলের পর সেখানে এক তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করে তার মাথায় বসিয়েছিল ভিদকুন কুইসিলিং নামে এক নরওয়েজিয়ান সেনা-অফিসারকে [১৯৪২]সুভাষচন্দ্র যেহেতু জাপানের সহায়তায় বিদেশে এক অস্থায়ী সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেহেতু তিনিও ভারতের আর একজন কুইসিলিং সন্তান রূপে দেখা দেবেন, এই সরলীকৃত ধারণাই ছিল এই  প্রচারপত্রের উপজীব্য।  ছবিটিতে দেখানো হয়েছে ভারতের মানচিত্রের পটভূমিতে মুকুটশোভিতা ত্রিশূলধারিণী ভারতমাতাকে দড়িতে বেঁধে এক জাপানী সেনাপতির হাতে সমর্পন করছেন ধূতি-চাদর পরিহিত সুভাষচন্দ্র। কৌতুকায়িত ভঙ্গিতে চিত্রিত জাপানি সেনাপতির হাতে রক্তরঞ্জিত তরবারি ও তার পেছনে রক্তবর্ণ উদীয়মান সূর্য। ছবির ওপরে ও নিচে ঊর্দু আর ইংরেজিতে লেখাঃ- কুইসিলিং সন অব ইন্ডিয়া’! আর  পেছন দিকে  তিনটি ভাষায় লেখাঃ- ভারতীয় দেশপ্রেমিকদের প্রতি আমি চাই ভারতের প্রত্যেকটি লোক জাপানের বিরোধিতা করুক।মহাত্মা গান্ধী, হরিজন, ২১-৬-১৯৪২” [বাঁ দিকের ছবি - চিত্র ২]






এই ব্রিটিশ প্রচারপত্রের পাশাপাশি উল্লেখ করা যায় এক সুপরিচিত মার্কিন পত্রিকায় একটি সুভাষবিরোধী রচনার সঙ্গে প্রকাশিত করজোড়ে সুভাষচন্দ্রের এক ব্যঙ্গকষায়িত মুখচ্ছবি, যার পাশে বড় হরফে লেখা- গিল্টি’! এটি আসলে মিগুয়েল কোভারুবিয়াস নামে কোনো এক কলমচির লেখা সুভাষচন্দ্রের জীবন-চিত্রের [প্রোফাইল] শিরোনাম। লেখাটির বক্তব্যে অবশ্য কোনো নূতনত্ব নেই, সেই ব্রিটিশকে উৎখাতের জন্য তার শত্রুপক্ষে যোগদান ও জাপানের হয়ে দালালি করার পুরনো অভিযোগই এই রচনার বক্তব্য। সুভাষচন্দ্র যে কতটা নীচস্বভাব, তা বোঝাতে যেভাবে তাঁকে গান্ধী নেহরুর পাশে রেখে তুলনা করা হয়েছে, তার কিছুটা পাঠকদের উপহার দেওয়া যেতে পারেঃ- মোহনদাস গান্ধী ও জওহরলাল নেহরুর কর্মপদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে কিন্তু তাঁদের উদ্দেশ্যের বিশুদ্ধতা নিয়ে কোন সংশয়ের স্থান নেই। ভারতের স্বাধীনতার জন্য এই দুজনের সংগ্রাম কখনও স্বার্থপর অভিপ্রায়ের পরিপূর্তির জন্য দর কষাকষিতে মলিন হয়নি। সুভাষচন্দ্র বসু সম্পর্কে কিন্তু এ ধরনের কোন কোন নরম মূল্যায়ন করা চলেনা। এই লোকটির সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক জীবনকাল জুড়ে দেশপ্রেম ছিল তাঁর অনুতাপহীন উচ্চাভিলাষকে ঢাকা দেবার এক জোব্বা, যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা সম্মান, সততা ও দেশপ্রীতির কোনো তোয়াক্কাই করেনি  

গান্ধী ও নেহরুর থেকে সুভাষচন্দ্র কোথায় আলাদা, তার কারণ নির্দেশ করে এই কলম-লেখক জানাচ্ছেন যে, যুদ্ধের ফলে উদ্ভূত সুযোগ সত্ত্বেও গান্ধী ও নেহরু জার্মানি ও জাপানের প্রস্তাবগ্রহণে বিরত থেকেছেন, প্রথমজন ঘোষণা করেছেন যে, ব্রিটেনের ধ্বংসের বিনিময়ে তিনি ভারতের স্বাধীনতা চান না, আর নেহরু তো বারবার প্রবলভাবেই বলেছেন যে, মিত্রশক্তিই মুক্ত বিশ্বের পক্ষে এক ভরসাস্বরূপ। অপর পক্ষে বসু জার্মানির থেকে অর্থ নিয়েছেন এবং আজ তিনি জাপানের সেনাবাহিনীর এক জেনারেলহিসেবে বার্মায় লড়াই করছেন, ব্যতিব্যস্ত হয়ে তিনি ঘাম ঝড়াচ্ছেন ভারতকে জাপানের শাসনাধীনে আনার জন্য, যাতে তিনি তার কুইসিলিং হতে পারেন। [দা গিল্টি সুভাষচন্দ্র বোস’, কোলিয়ার্স ম্যাগাজিন, ৩০-৯-১৯৪৪ সংখ্যা] এই নমুনাটুকু থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ইঙ্গ-মার্কিন পক্ষ সুভাষচন্দ্রকে কোন্‌ চোখে দেখছিল, অথবা, বলা ভালো, কী ভাবে দেখাতে চাইছিল। দুশো বছরের এক পুরনো সাম্রাজ্যবাদকে উৎখাতের জন্য যিনি জাপানের মতো এক নয়া সাম্রাজ্যবাদীর দ্বারস্থ হয়েছেন, ব্রিটিশদের দোসর মার্কিনদের চোখে তিনি যে অপরাধীপ্রতিপন্ন হবেন, তাতে আর বিস্ময়ের কী আছে! আর এই হিসেব মেনে প্রত্যাশিত ভাবেই লেখাটির সঙ্গের কার্টুনে মাল্যভুষিত সুভাষচন্দ্রের মুখে ফুটে উঠেছে এক ধূর্ত হাসি। [ ডান দিকের ছবি, চিত্র - ২]

জাপান ও আইআইএল-এর প্রচারপত্রে আজাদ হিন্দ ফৌজ

ভারতবর্ষ থেকে মহানিষ্ক্রমণের পর সুভাষচন্দ্র ইতালি ও জার্মানির সমর্থনে ও সহায়তায় গড়ে তোলেন এক ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টার ও অক্ষশক্তির হাতে বন্দী ব্রিটিশ ভারতীয় সৈন্যদের নিয়ে এক সেনাদল, যাকে অভিহিত করা হতো ইন্ডিয়ান লিজিয়ন নামে। কিন্তু বেতারপ্রচার ছাড়া ভারতের স্বাধীনতার সপক্ষে আর কিছু করার সুযোগ সেখানে সুভাষচন্দ্র পান নি। অন্যদিকে পূর্ব এশিয়াতে জাপানের সমর্থনে ও সেখানে নির্বাসিত বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্‌স লীগ ও তার অধীনে যুদ্ধবন্দী ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাদের নিয়ে এক বাহিনী [আজাদ হিন্দ ফৌজ, যা শেষ পর্যন্ত অন্তর্কলহে ভেঙে যায়। এই পরিস্থিতিতে সুভাষচন্দ্র জার্মানি থেকে দুঃসাহসিক এক সাবমেরিন-যাত্রায় এসে উপস্থিত হন পূর্ব এশিয়ায় ও হাল ধরেন ভেঙে যাওয়া আন্দোলনের। অচিরেই তাঁর নেতৃত্বে পুনর্গঠিত হয় আজাদ হিন্দ ফৌজ।

পূর্ব এশিয়াতে নেতাজির আগমনে স্বভাবতই সেখানকার মুক্তিকামী ভারতীয়দের মধ্যে অভূতপূর্ব উদ্দীপনার সঞ্চার হয়। আজাদ হিন্দ ফৌজের এক জনপ্রিয় সঙ্গীতে [সুভাষজি! সুভাষজি! উওহ জান-এ-হিন্দ আ গয়ে] তাঁকে এশিয়ার সূর্যহিসেবে  অভিনন্দন জানিয়ে লেখা হয়েছিল - উওহ এশিয়া কে আফতাব এশিয়া মেঁ আ গয়ে!ভারতীয়দের এই উদ্দীপিত উৎসাহ যে স্বাভাবিক ব্যাপার, এ কথা বুঝতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু জাপানের মানুষের মধ্যেও যে সুভাষকে নিয়ে সাগ্রহ প্রত্যাশার সূচনা হয়েছিল, সেটিকে অবশ্যই অসাধারণ বলতে হবে। সুভাষচন্দ্রের পদার্পনের কয়েকদিনের মধ্যে জাপানের জাতীয় কবি নোগুচি তাঁকে উদ্দেশ করে যে কবিতাটি রচনা করেন, সেটিকে কোলিয়ার্স ম্যাগাজিনের পূর্বোল্লিখিত সুভাষ-সমালোচনাটির বিপ্রতীপে স্থাপন করা যায়। স্বাধীনতা অর্জনের পন্থার নিরিখে ওই মার্কিন কলমচি যেমন সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে গান্ধী ও নেহরুর তুলনা করেছিলেন, এই কবিতাটিতেও জাপানের কবি অনেকটা সে রকম ভাবেই শুরুতে অনশন আর প্রার্থনার মাধ্যমে ভারতকে শৃংখলমুক্ত করার চেষ্টায় গান্ধির ব্যর্থতাতে হতাশা প্রকাশ করে  প্রশ্ন করেন, “সুভাষচন্দ্র বসু, তোমাকে জিজ্ঞাসা করি, কী আছে ভারতের ভবিষ্যৎ মঞ্জুষায়?”  তিনি জানতে চান, কীভাবে ভারতবাসী ব্রিটেনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে, আর কীভাবে তাকে সাহায্য করবে জাপান! কবিতাটির শেষে কবি নোগুচির অধীর জিজ্ঞাসা যে ভাবে উচ্চারিত হয়েছে, তার ভাবার্থ বাংলায় অনেকটা এ রকম দাঁড়ায়ঃ - তরঙ্গদল হল উত্তাল, বইছে প্রবল বায়ু/ সময় হয়েছে নিকট, নিকটতর/ ভারতের জনগণ কেন বিদ্রোহের জন্য/ করছে না মনঃস্থির!/ কেন ধরছ না অস্ত্র, কেন শুরু করছ না যুদ্ধ?/ তোমাদের সঙ্গে হাত মেলাতে/ জাপান রয়েছে সদাপ্রস্তুত!/ আমাদের ভারতীয় বন্ধু! ওঠো, শুরু কর জয়যাত্রা! ইত্যাদি। [সুভাষচন্দ্র বসুর প্রতি, ২০ জুন, ১৯৪৩’]     

নোগুচির এই অধীর প্রশ্নের জবাব মিলেছিল অচিরেই। ভারতের মুক্তিপ্রচেষ্টায় সবরকম সহায়তার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেছিলেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী তোজো। ১৯৪৩ সালের অক্টোবরে গঠিত হয় আজাদ হিন্দ-এর অস্থায়ী সরকার। এর রাষ্ট্রপ্রধান ও আজাদ হিন্দ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে সুভাষচন্দ্র যুদ্ধ ঘোষণা করেন ব্রিটেন আর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। নোগুচির কবিতায় অভিব্যক্ত ভারত আর জাপানের মানুষের প্রত্যাশা আর অভিলাষের বাস্তবায়ন ঘটে ১৯৪৪ সালে আজাদ হিন্দ ফৌজের ভারত অভিযানের সূচনায়। ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের অবিসংবাদী নায়ক হিসেবে নেতাজির ওপর ভারত আর জাপানের মানুষের সেই অসামান্য শ্রদ্ধা আর প্রত্যাশার পরিচয় পাওয়া যায় যুদ্ধক্ষেত্রে ব্রিটিশবিরোধী প্রচারের জন্য ব্যবহৃত সচিত্র প্রচারপত্রগুলোতে।

গুরবচন সিং মাঙ্গত আজাদ হিন্দ ফৌজ বিষয়ে লেখা তাঁর একটি বইয়ে জানিয়েছেন যে, এই বাহিনীর লেঃ জামিল আহমেদের নেতৃত্বে একটি দল তৈরি করা হয়েছিল, যারা অক্ষশক্তির হাতে বন্দী ভারতীয় সেনাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলত, যুদ্ধক্ষেত্রে লাউড স্পীকার আর লীফলেটের মাধ্যমে  ভারতের স্বাধীনতা ও আজাদ হিন্দ ফৌজের পক্ষে প্রচারও করত। এই দলটির তৈরি  এই সব লিফলেট বিমানের সাহায্যে রণাঙ্গণে ভারতীয় সেনাদের ওপর ফেলা হত কিংবা রকেট বা মর্টারের সাহায্যে ছুঁড়ে দেওয়া হতো[ ‘Indian National Army’, Gagan Publishers, New Delhi, 1991]  সাধারণত পোস্টারের আঙ্গিকে আঁকা এই প্রচারপত্রগুলিতে বাংলা, হিন্দি ও র্দুতে লেখা  কোনো বার্তা ছাপা থাকত, যার উদ্দেশ্য ছিল ভারতে ব্রিটিশ শাসনের কুফলের ও তাদের নানা অত্যাচারের কথা স্মরণ করিয়ে ও জাপানের সহায়তায় ভবিষ্যতের স্বাধীন ও সুখী সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখিয়ে ভারতীয় সৈন্যদের তাদের ইংরেজ প্রভুদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে প্ররোচিত করা।

আমাদের আলোচ্য এ-জাতীয় প্রচারপত্রের প্রথমটিতে দেখা যাচ্ছে, অশ্বারোহী নেতাজি সুভাষচন্দ্র ড্রাম বাজিয়ে ভারত অভিযানের ডাক দিচ্ছেন, ড্রামের গায়ে গর্জনরত বাঘের মুখ আঁকা। তাঁর পেছনে উড্ডীন চরকালাঞ্ছিত ভারতের ত্রিবর্ণ পতাকা [যা শুধু কংগ্রেসেরই নয়, আজাদ হিন্দ সরকারের জাতীয় পতাকাও]নেতাজিকে অনুসরণ করছে ঝান্ডা ও সঙিন উঁচিয়ে ধরে ভারতীয় সেনারা। ছবির সঙ্গে হিন্দি ও বাংলায় লেখা বার্তাঃ- দিল্লির দিকে এগিয়ে চল, ভারতে জাতীয় সেনাদলের দিল্লি অভিযানে কোন শক্তিই বাধা দিতে পারবেনা।“ [বাঁ দিকের ছবি, চিত্র-৩]





জাপানের সহায়তায় প্রচারিত এ-ধরনের আর একটি প্রচারপত্রের বিষয়বস্তুও বীর রসাত্মক।  এটিতে দেখা যাচ্ছে, ভারতের মানচিত্রের ওপরে ভারতীয়দের মৃতদেহ ও হাড়গোড় ভোজনরত এক বিশাল সিংহের মাথা তরোয়ালের কোপে কেটে ফেলেছেন সামরিক পোষাক পরিহিত নেতাজি। সিংহটার পিঠে আঁকা ইউনিয়ন জ্যাক ও লেজে বাঁধা মার্কিন পতাকার  নকশা আঁকা বো-টাই থেকে বোঝা যায় আজাদ হিন্দ ফৌজের ব্রিটেন ও আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাকেই এখানে বোঝানো হয়েছে। সুভাষচন্দ্রের পেছনে দেখা যাচ্ছে তেরঙা পতাকাবাহী সাঁজোয়া গাড়ির সারি। ছবির সঙ্গে বাংলা-হিন্দি-র্দু তিন ভাষায় লেখা বার্তাঃ- সুভাষ বসু বৃটিশ সিংহের মাথা  কেটে দিয়েছেন। জয় সুভাষ বাবুর জয়।” [ডান দিকের ছবি, চিত্র-৩]

জাপান ও আই এন এ/ আই আই এল [ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগ]-এর তরফে প্রচারিত একটি লীফলেটের উপজীব্য নেতাজির সেনাদলের ভারত-অভিযান। নেতাজি উন্মুক্ত তরবারি হাতে নিয়ে সশস্ত্র ভারতীয় সেনাদের পরিচালিত করছেন দিল্লির দিকে, তাঁর পাশে এক সৈনিকের হাতে ভারতের চরকালাঞ্ছিত পতাকা। অদূরে দিল্লি প্রাসাদকূটেউড়ছে ব্রিটিশ ইউনিয়ন জ্যাক। আক্রমণোদ্যত ভারতীয় সেনারা বেয়নেট বাগিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। ছবির সঙ্গে তিন ভাষায় লেখাঃ- দিল্লীর দিকে এগিয়ে চল। সুভাষ বাবুর পরিচালনায় স্বাধীনতা পতাকার নিচে জড়ো হও। স্বাধীনতা ও মুক্তি তোমাদের দরজায় এসেছে।“ [বাঁ দিকের ছবি, চিত্র-৪]



এ ধরনের আর একটি সচিত্র প্রচারপত্রে ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের স্মৃতি জাগিয়ে তুলে ভারতবাসীকে ঐ ব্রিটিশ  বর্বরতার প্রতিশোধ নিতে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে। ছবির সামনের দিকে মৃতদেহের স্তূপের মধ্যে দাঁড়ানো এক ভারতীয় নারীকে মৃত প্রিয়জনকে কোলে করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যচ্ছে। দূরে  পটভূমিতে দেখা যাচ্ছে, ব্রিটিশ সেনাদের তাড়া করে খেদিয়ে দিচ্ছে সঙ্গিন  ও তেরঙা পতাকা হাতে নিয়ে আজাদী সেনা ও কাস্তে-গাঁইতি হাতে সাধারণ কৃষক শ্রমিক। ছবির গায়ে দুজায়গায় লেখা দুটি বাণীঃ- যে সকল ভারতবাসী অমৃতসর হত্যাকান্ডের কথা স্মরণ করিয়াও উত্তেজিত হয়না, তাহাদের ভারতীয় বলা যাইতে পারেনা।এবং- প্রতিশোধ লইবার এই অপূর্ব সুযোগ।“  [ডান দিকের ছবি, চিত্র-৪]


এর পাশাপাশি আই আই এল-এর দুটি নিজস্ব লিফলেটের উল্লেখ করা যেতে পারে [চিত্র ৪ক], যার প্রথমটিতে আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠা ও তার ব্রিটেন- আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার বার্তা প্রচারিত হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, এক শিখ সিপাহী বন্দুক বাগিয়ে ছুটে চলেছে, পদতলে লুন্ঠিত ব্রিটিশ পতাকা আর পেছনে উড্ডীন ভারতের ঝান্ডা। দ্বিতীয়টিতে দেখা যাচ্ছে পরস্পরের দিকে উদ্যতায়ুধ দুই ভারতীয় সৈন্য - একজন ব্রিটিশ পক্ষের আর একজন আজাদ হিন্দ ফৌজের। ব্রিটিশ বাহিনীর ভারতীয় সেনাটিকে বিরত করে গান্ধিজি বলছেন, “থাম! আমাদের সঙ্গে একত্র হয়ে ইংরেজদের তাড়িয়ে দাও হিন্দি বাংলা, র্দু আর তামিলে লেখা এই  প্রচারপত্রটিকে তুলনা করা যায় সেই ব্রিটিশ প্রচারপত্রটির সঙ্গে, যেখানে গান্ধির উক্তি নেতাজি ও জাপানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল। এখানে যেন তার জবাব হিসেবেই গান্ধিকে দেখানো হয়েছে ব্রিটিশবিরোধী ও আজাদ হিন্দ আন্দোলনের সমর্থক হিসেবে। এই প্রচারপত্রগুলো থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, মিত্রশক্তিরা বিশ্বযুদ্ধে নেতাজির ভূমিকাকে কালিমালিপ্ত করে তাঁকে বিশ্বাসঘাতক তথা দেশদ্রোহী হিসেবে দেখাবার চেষ্টা করলেও পূর্ব এশিয়ার অগণিত মানুষের চোখে তাঁর ভূমিকাটিকে শরৎচন্দ্রের ভাষায় বর্ণনা করতে গেলে বলতে হয় পরাধীন দেশের রাজবিদ্রোহী, মুক্তিপথের অগ্রদূত’!

ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টির ব্যঙ্গচিত্রে নেতাজি

ভারতে বামপন্থা ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার প্রবক্তা হিসেবে সুভাষচন্দ্র তিরিশের দশকের শেষের দিকে অল্প কিছু সময় ভারতের কম্যুনিস্টদের সহযোগী হিসেবে পেয়েছিলেন। ১৯৩৯ সালের কংগ্রেস সভাপতি পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সুভাষচন্দ্রকেই সমর্থন করেছিলেন কম্যুনিস্ট মতাবলম্বীরা। কম্যুনিস্টরা সুভাষচন্দ্র-সংগঠিত বাম সমন্বয় কমিটিতে অল্প কিছুদিনের জন্য যোগ দিলেও পরে তাঁরা তাঁর নানারকম সমালোচনা শুরু করেন। ১৯৪০ সালে সুভাষচন্দ্র যখন রামগড়ে আপোষবিরোধী সম্মেলন করছেন, অক্লান্তভাবে ব্রিটিশবিরোধী গণ-আন্দোলনের ডাক দিচ্ছেন, কলকাতায় পরিচালনা করছেন হলওয়েল মনুমেন্ট তুলে দেবার দাবিতে সত্যাগ্রহ আন্দোলনে, তখনও কিন্তু কম্যুনিস্ট পার্টির পত্রপত্রিকায় তাঁর প্রতি প্রায়ই তোপ দাগা হচ্ছে ও তাঁর বিরুদ্ধে সংগ্রামে অনীহা ও শুধু শ্লোগান-নির্ভরতার অভিযোগ আনা হচ্ছে!

সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে ভারতের কম্যুনিস্টদের এই অম্লমধুর সম্পর্ক রাতারাতি শত্রুতায় পরিণত হয় সুভাষচন্দ্রের অক্ষশক্তির শিবিরের সাহায্য নেওয়ার পর থেকে, কারণ নাৎসি জার্মানির সোভিয়েত রাশিয়া আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গেই কম্যুনিস্টদের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে মূল্যায়নও রাতারাতি পালটে যায়। সোভিয়েত পথনির্দেশে নির্ভরশীল এই গোষ্ঠীর কাছে ভারতের স্বাধীনতা থেকে বেশি মূল্যবান হয়ে দাঁড়ায় সোভিয়েত রাষ্ট্রের স্বার্থ আর কাজে কাজেই সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ তাদের কাছে হয়ে দাঁড়ায় জনযুদ্ধ। এই পরমুখাপেক্ষী নীতির ফলে ভারতে কম্যুনিস্টদের মুখপত্রগুলিতে সুভাষচন্দ্রের প্রচেষ্টার কটু সমালোচনা শুরু হয়। কম্যুনিস্ট পার্টির সর্বভারতীয় মুখপত্র পীপলস্‌ ওয়ারআর তার বঙ্গীয় সংস্করণ জনযুদ্ধের বিভিন্ন সংখ্যায় লেখকেরা উঠে পড়ে লাগেন নেতাজি ও আজাদ হিন্দ বাহিনীর লড়াইকে হেয় করার মিশনের রূপায়নে। 

সুভাষচন্দ্রের বিরুদ্ধে কম্যুনিস্টদের অভিযোগে অবশ্য বিশেষ কিছু নতুনত্ব ছিল না,   ইঙ্গ-মার্কিন মহলের সেই বহু উচ্চারিত ফ্যাসিস্টদের তাঁবেদারি আর বিদেশীর সাহায্য নিয়ে দেশের ক্ষতি করার অভিযোগই পীপল্‌স ওয়ার পত্রিকার লেখা আর কার্টুনের  মধ্য দিয়ে প্রচার করা হচ্ছিল। সুভাষচন্দ্র ও ভারতে তাঁর সমর্থক, বিশেষ করে ফরোয়ার্ড ব্লক গোষ্ঠীর লোকজনকে এরা পঞ্চমবাহিনী’ [ফিফথ কলাম] আখ্যা দিয়ে তাঁদের ব্রিটিশের শত্রুর সহায়তা ও ব্রিটিশ সরকারের ক্ষতিসাধনের নীতিকে আক্রমণ করে যাচ্ছিলেন। এর নমুনা হিসেবে ঐ পত্রিকায় বি টি রণদিভের একটি লেখার অংশ আমরা তর্জমা করছি অরুণ শৌরির একটি নিবন্ধ থেকেঃ- জাপানী-জার্মান ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যাসোসিয়েশানের আসাম অফিস সুভাষ বসুর একটি বার্তা প্রকাশ করেছে, যাতে নৈরাজ্যবাদ আর নাশকতামূলক কাজকর্মকে স্বাধীনতার যুদ্ধবলে গৌরবান্বিত করা হয়েছে! জাপানী সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী সুভাষ বসু ঘোষণা করেছেন সরকারি সম্পত্তি ও রেলওয়ের ধ্বংসসাধনে গেরিলারা কাজ করে যাচ্ছে। আমি আমার স্বদেশবাসীদের কাছে  আবেদন করছি মনপ্রাণ দিয়ে স্বাধীনতার লড়াইয়ে যোগ দিতে। আমি বিশেষ ভাবে আবেদন করছি  ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টিকে এই সুযোগ গ্রহণে অগ্রসর হবার। আমরা সর্বতোভাবে সাহায্য করব। 

এই আবেদন অবশ্যই বৃথা যাবে না। কম্যুনিস্ট পার্টি এই সুযোগ গ্রহণে এগিয়ে আসবে ও সেই জবাবই দেবে যা বিশ্বাসঘাতক আর কুইসিলিংদের সৎ দেশপ্রেমিকেরা দিয়ে থাকে। বসুর ভাড়াটিয়া মুক্তি’-সেনাদল, ধ্বংস আর লুন্ঠনকারীর দল যদি লুঠতরাজ ও ডাকাতির কাজ সম্পন্ন করতে ভারতের মাটিতে পা রাখার সাহস করে, তাহলে তারা আমাদের জনগণের তীব্র ক্রোধ ও ক্ষোভ টের পাবে [১০-১-১৯৪৩]  অবর্ণনীয় দুঃখভোগ ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে এক দল মুক্তিসেনা যখন তাদের স্বদেশভূমিকে পরাধীনতার বন্ধনমুক্ত করার জন্য জীবনকে বাজি রাখার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, তখন তাদেরই গুটিকতক স্বদেশবাসী তাদের প্রচেষ্টায় কালিমা লেপনের জন্য কী ভাবে ব্রিটিশ শাসকদের তাঁবেদারি করছিল, তার এ রকম বহু নমুনা ছড়িয়ে আছে কম্যুনিস্ট পার্টির তখনকার পত্রপত্রিকার পাতায় পাতায়। এর সঙ্গে উল্লেখ করতে হয় অবশ্যই পীপল্‌স ওয়ার-এ প্রকশিত সুভাষবিরোধী কার্টুনগুলোর, যা এদেশের কলঙ্কের ইতিহাসে স্মরণীয় দলিল হিসেবে স্থান পেয়েছে।

এই জাতীয় কার্টুনের নিদর্শন হিসেবে আমরা প্রথমে উল্লেখ করব পীপলস ওয়ারে প্রকাশিত [২১-১১-১৯৪২] একটি রেখাচিত্র, যেখানে জাপানি বোমার আরোহী হয়ে সুভাষচন্দ্রকে নেমে আসতে দেখা যাচ্ছে ভারতের বুভুক্ষাপীড়িত মানুষের ওপর। [ডান  দিকের ছবি, চিত্র - ১] এটি থেকে  বোঝা যায় যে, এই কার্টুনিস্টের ভাবনাচিন্তায় কোনো নতুনত্ব বা মৌলিকতা নেই, ছবিটিও একটি ব্রিটিশ প্রচারপত্রের নকল, যেটির  কথা আমরা আগেই বলেছি। আর একটি তথ্য মনে রাখলেও আজ কিছুটা কৌতুকের সঞ্চার না হয়ে পারে না। ইংরেজ শাসক আর সে সময় তাদের ধামাধারী ভারতের কম্যুনিস্টদের প্রচারিত এই দুটি কার্টুন থেকেই মনে হতে পারে, ভারতের দরিদ্র আর  ক্ষুধার্ত জনগণের জন্য বুঝি ব্রিটিশপ্রভুদের দরদের অন্ত ছিল না! কিন্তু আজ আমরা জানি যে, ওই কার্টুন প্রকাশের মাত্র এক বছরের মধ্যে ব্রিটিশ সরকারেরই তৈরি কৃত্রিম দুর্ভিক্ষে বাংলাদেশ প্রায় ত্রিশ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল। তখন কিন্তু আজাদ হিন্দ সরকারের প্রধান হিসেবে নেতাজি সুভাষ ব্রিটিশ সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন বাংলার মানুষের ত্রাণের জন্য খাদ্যশস্যের একটি জাহাজ পাঠবার, কিন্তু ব্রিটিশ শাসকেরা তাতে কর্ণপাত করেনি।



এই শাসকদের সহযোগী ভারতের কম্যুনিস্টদের প্রধান পত্রিকায় প্রকাশিত অন্যান্য কার্টুনগুলোও বক্তব্যে বা ব্যঙ্গনৈপুণ্যে খুব উচ্চশ্রেণীর ছিল, এমনটা বলা যায় না। উদাহরস্বরূপ একটি ব্যঙ্গচিত্রে দেখা যাচ্ছে [১৩-৯-১৯৪২], নাৎসি জার্মানির প্রচারমন্ত্রী গোয়েবল্‌স একটি বেড়ালের ঘাড় ধরে মাইক্রোফোনের সামনে তুলে ধরেছেন, যার মুখটা সুভাষচন্দ্রের। [বাঁ দিকের ছবি, চিত্র- ৫] জার্মানির বেতার থেকে সুভাষচন্দ্রেকে ভারতের স্বাধীনতার সপক্ষে প্রচারের সুযোগ নাৎসি সরকার দিয়েছিল, তাকেই এখানে কটাক্ষ করা হয়েছে। আর একটি কার্টুনে [৮-৮-১৯৪২] দেখা যাচ্ছে, নেতাজির মুখোশের পেছনে উঁকি মারছে এক জাপানী সমরনায়কের মুখ। [ডান দিকের ছবি, চিত্র - ৫] একই ইঙ্গিত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে করা হয়েছে আরও কয়েকটি কার্টুনে, যেমন ধরা যাক, একটিতে [১৯-৭-৪২ তারিখের পীপল্‌স ওয়ার-এ প্রকাশিত] গাধা-রূপী  নেতাজির পিঠে সওয়ার বিশালদেহী এক জাপ সমরনায়ক বা আর একটিতে [২৬-৯-১৯৪২] বামনাকৃতি সুভাষ হাত ধরে নিয়ে আসছেন বিশালদেহী এক জাপানী সেনাপতিকে। [দ্রষ্টব্য দুটি ছবি, চিত্র - ৬] সেই একই কুইসিলিং-তত্ত্ব!



এর সঙ্গে আমরা উল্লেখ করব পীপল্‌স ওয়ার-এ ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত আর একটি  কার্টুনের, যেখানে দেখা যাচ্ছে, [আন্দামানের?] সমুদ্রের ধারে এক তালগাছ বেয়ে উঠে সুভাষচন্দ্র  চোখে দূরবীন দিয়ে দেখছেন সাগরপারের ভূখন্ডের [ভারতবর্ষ?] দিকে, নিচে দাঁড়িয়ে আছে অস্ত্রধারী এক [জাপানী?] সৈনিক। [বাঁ দিকের ছবি, চিত্র - ৭] এই ব্যঙ্গচিত্র মনে করিয়ে দেয় আন্দামানের সমুদ্রতীরে এক তালগাছের নিচে দাঁড়িয়ে  দূরে ভারতের মূলভূমির দিকে তাকিয়ে থাকা নেতাজির এক বাস্তব ছবির কথা। [ছবি-৮] আমরা জানি যে, জাপান সরকার তাদের অধিকৃত আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ আজাদ হিন্দ সরকারকে হস্তান্তরের পর নেতাজি যখন ওই দ্বীপ সফরে যান, তখন ঐ ছবি তোলা হয়েছিল। এগুলি ১৯৪৩ সালের ঘটনা, ব্যঙ্গচিত্রটিও ঐ বছরেই প্রকাশিত হয়। তাই মনে হয় যে, এই কার্টুনে সম্ভবত সেই ঘটনাকেই কটাক্ষ করা হয়েছে।

সাধারণভাবে বলা যায় যে, সুভাষবিরোধী এই কম্যুনিস্ট কার্টুনগুলির বক্তব্য বা শৈলী খুব  অভিনব তো ছিলই না, কার্টুন হিসেবেও এ গুলিকে খুব উচ্চশ্রেণীর বলা যায় না। নেতাজির মতো একজন সর্বজনস্বীকৃত নেতাকে জন্তু হিসেবে দেখানোটাও নিতান্ত নিম্নরুচির পরিচয়! ভারতের কম্যুনিস্ট নেতাদের সম্পর্কে বলা যেতেই পারে যে, সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক বিরোধিতা বা অক্ষশক্তির পক্ষে যোগ দেওয়ার সমালোচনা তাঁরা করতেই পারেন, কিন্তু একদা তাঁর সঙ্গে একই মঞ্চে কাজ করার অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও তাঁরা যে ভাবে তাঁর দেশপ্রেমকেও সন্দেহ করেছিলেন, তা সত্যিই বেদনদায়কঅতীতে বাংলাদেশে শনিবারের চিঠির কলমচি ব্যঙ্গ করে যখন সুভাষচন্দ্রকে সিংহচর্মশোভিত রাসভবলেছিলেন, তখনকার মতোই তোজোর গাধা হিসেবে তাঁকে চিত্রিত করে এই কম্যুনিস্ট কার্টুন প্রকাশের সময়েও নিশ্চয় মহাকাল হেসেছিলেন তাঁর  সেই ক্লাসিক হাসি, যা ভবিষ্যৎ ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে তিনি বারবার হেসেছেন। তখন কে জানত যে, সেই হাসি অট্টহাস্যে পরিণত হবে সত্তরের দশকে যখন স্বাধীন ভারতের পশ্চিমবাংলায় শাসনক্ষমতা লাভ করে এক কম্যুনিস্ট নেতা বলবেন, “নেতাজি সম্পর্কে আমরা কম্যুনিস্টরা অতীতে যা বলেছিলাম, তা ভুল, আমরা আজ আমাদের সে ভুল স্বীকার করছি। কারও পদানত হয়ে থাকার জন্য নেতাজি কখনও কারও সাহায্য নেন নি[জ্যোতি বসু, ২৯-১-১৯৭০] কে জানত যে, মহাকাল আবার হাসবেন, যখন আর এক কম্যুনিস্ট নেতা সুভাষচন্দ্রের জীবনী লিখে দেশপ্রেমের জ্বলন্ত প্রতীক হিসেবে তাঁকে অকুন্ঠ শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন ও স্বীকার করবেন যে, নেতাজি নিশ্চিত ভাবেই জানতেন যে, ফ্যাসিস্টরা একটি নির্দিষ্ট সীমার বাইরে তাঁকে সাহায্য করবে না এবং সেই সাহায্য নেবার জন্য তিনি কখনও নিজের আত্মসম্মানকে অবনমিত করেন নি। [হীরেন মুখার্জির বই দি বো অব বার্নিং গোল্ড’, ১৯৭৭]

মহাকালের হাসি - যুদ্ধশেষেও!

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে জাপান ও আজাদ হিন্দ বাহিনীর আত্মসমর্পনের পর দিল্লির লালকেল্লায় বন্দী আজাদী সেনাদের তিন সেনাপতির বিচারকে উপলক্ষ করে সারা ভারতের আকশে বাতাসে দেশপ্রেমের তড়িৎপ্রবাহ প্রবাহিত হতে থাকে। এই বিচারপর্ব শুরু হয় ১৯৪৫ সালের নভেম্বরে। সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে এই বাহিনীর অসমসাহসিক সংগ্রামের কাহিনী দেশবাসীর গোচরে আসার সঙ্গে সঙ্গে দেশব্যাপী অভূতপূর্ব আবেগ ও  গণ-উন্মাদনার সঞ্চার হয়। যারা জাপানের কুইসিলিংসুভাষচন্দ্রের  ভারতে পদার্পকে রুখতে কিছু দিন আগেও লম্ফঝম্প করছিলেন, সেই কংগ্রেস ও কম্যুনিস্ট  নেতারা আজাদ হিন্দ বন্দীদের মুক্তির দাবিতে গলা মেলান, এমন কি মুসলিম লীগও পিছিয়ে থাকে না! নেহরু এমন কথাও বলেন, এদের দন্ডিত করার অর্থ হবে সমগ্র ভারতবাসীকে দন্ডিত করা! বিচার চলাকালেই দেশের নানা স্থানে শুরু হয় গণ-বিক্ষোভ। তিন আজাদী সেনানায়কের যাবজ্জীবন কারাদন্ডের আদেশ হলেও ভারতের ব্রিটিশ সেনাধ্যক্ষ অকিনলেকের বিশেষ আদেশে তাঁদের বিনা শর্তে মুক্তি দেওয়া হয়।

ভারত জুড়ে তখন ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে মহাকালের সেই হাসি। জনমানসের অদৃশ্য নায়ক তখন সুভাষচন্দ্র বসু। জানুয়ারির ৪ তারিখ তিন আজাদ হিন্দ সেনানায়ককে মুক্তি দেওয়া হয়। এই পরিস্থিতিতে ১৯৪৬-এর ২৩শে জানুয়ারি সুভাষ দিবসপালনকে কেন্দ্র করে বোম্বাই, কলকাতা আর দিল্লিতে জনতার সঙ্গে পুলিশের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। বোম্বাইতে দুহাজার লোকের এক শোভাযাত্রার ওপর পুলিশ চড়াও হয় লাঠি, গুলি ও কাঁদানে গ্যাস নিয়ে, কারণ পুলিসের নির্দেশিত পথ দিয়ে যেতে জনতা অস্বীকার করেছিল। বিক্ষুব্ধ জনতা পুলিশভ্যানও আক্রমণ করে। এই হাঙ্গামায় প্রায় ৮০ জন লোক মারা যায় ও শপাঁচেক আহত হয়। উল্লেখ্য যে, এই সুভাষ দিবসের আয়োজন হয়েছিল স্থানীয় কংগ্রেস নেতৃত্বের সম্মতি ছাড়াই।

এই ঘটনাকে উপজীব্য করে পরের দিন ফ্রী প্রেস জার্নালের প্রথম পাতায় কুট্টির এক কার্টুন প্রকাশিত হয়। এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে, নেতাজির ফোটোর সামনে সমবেত জনতার উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছেন বোম্বাইয়ের পুলিশ কমিশনার হ্যারল্ড এডুইন বাটলার, তাঁর পরনে প্রাচীন রোমানদের মতো পোষাক, হাতে টিয়ার গ্যাসের বাল্ব, তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে বন্দুক আর গ্যাস-মুখোশধারী পুলিশ। বাটলারের মুখে বসানো হয়েছে শেক্সপীয়রের জুলিয়াস সীজার নাটকের  ব্রুটাসের সেই বিখ্যাত উক্তিঃ- “If you have tears, prepare to shed them now.” অর্থাৎ তোমাদের যদি চোখের জল থাকে, তবে এখন সেই অশ্রু বিসর্জন কর!নাটকটির সঙ্গে যারা পরিচিত তাঁরা জানেন যে ঐ ভাষণের মাধ্যমে সীজার-বিরোধীদের চক্রান্তকে পরাভূত করে তাঁর অনুগত ব্রুটাস জনগণের মন ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন সীজারের সপক্ষে। আলোচ্য পরিস্থিতিতেও সুভাষবিরোধী ব্রিটিশ সরকার, কংগ্রেস ও কম্যুনিস্টদের সব বিরোধী প্রচার সত্ত্বেও ভারতের মানুষের মনে নেতাজির সপক্ষে ভাবাবেগ জন্মানোর ফলে পরিস্থিতি ঘুরে গিয়েছিল। কিন্তু এই কার্টুনে ব্রুটাসের বাণী উচ্চারিত হয়েছে ব্রুটাসবেশী পুলিশ কর্তার মুখে, যিনি নেতাজির কোনো অনুরাগী নন, বরং সুভাষবিরোধী ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধি [ছবিতে তাঁর গায়ে লেখা বোম্বে ব্যুরোক্র্যাটস’] ও তিনি জনতাকে অশ্রুবিসর্জন করতে বলছেন কোনো সুভাষ-প্রীতির বশে নয়, তাঁর হাতে ধরা অস্ত্র কাঁদানে গ্যাসের প্রভাবে, এ-ভাবেই এই ব্যঙ্গচিত্রটির অনবদ্য শ্লেষ প্রকাশিত হয়েছে। [ডান দিকের ছবি চিত্র - ৭]



সব শেষে উল্লেখ করতেই হয় যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই নেতাজি আর তাঁর আত্মোৎসর্গ ও সংগ্রামকে ব্যঙ্গবিদ্রুপের মাধ্যমে হেয় করার ধারাটি পালটে যাবার যে পরম্পরার সূচনা হয় ও কুট্টির এই কার্টুনটি যার অন্যতম ঐতিহাসিক পরিচয় বহন করছে, তা এটি প্রকাশের পরেও অব্যাহত ছিল ও নেতাজির দৃষ্টান্তে উদ্বুদ্ধ দেশপ্রেমের  গণপ্লাবন পরিণতি পেয়েছিল সে বছরেই [১৯৪৬] ভারতের নৌসেনা ও পুলিশবাহিনীর  বিদ্রোহে, যা  সেনাদের উদ্দেশে লিফলেট ছেপে নেতাজিকে দেশদ্রোহী প্রতিপন্ন করার চক্রী ব্রিটিশ কর্তারা ও তাদের ভারতীয় ধামাধারীরা কল্পনাও করতে পারেন নি। তাঁরা দেখতে পান নি মহাকালের সেই ব্যঙ্গের হাসি, বুঝতে পারেন নি ইতিহাসের রসিকতা। কিন্তু কেউ কেউ অবশ্যই তা বুঝেছিলেন, যেমন ভারতে ব্রিটিশ শাসনের শেষ পর্বের ভাষ্যকার মাইকেল এডওয়ার্ডস লিখে গেছেন ক্ষমতা হস্তান্তরের সেই দিনগুলোর কথা, যখন সন্ত্রস্ত ব্রিটিশপ্রভুদের চোখের সামনে হ্যামলেটের পিতার মতোই লালকেল্লার প্রাকারে প্রাকারে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সুভাষ বসুর প্রেতাত্মাআর তাঁর  সেই সহসা-বিশালায়িত ভাবমূর্তিই প্রভাবিত করেছিল ভারতকে স্বাধীনতা দেবার ব্রিটিশ সিদ্ধান্তকে। [দি লাস্ট ইয়ার্স অব দি ব্রিটিশ রুল ইন ইন্ডিয়া’] 




আকর-সূত্র  


 Axis Propaganda to Indian Troops/SGM Hebert A Friedman

 Profile of Chandra Bose with caricature by Miguel Covarrubias, Collier’s Magazine 30th September 1944 

The Great Betrayal/ Arun Shourie – The Illustrated Weekly of India,
1-4-1984

“Not Just Bose, Bombay Too” - Mumbai Mirror, Cover Story, Sunday 19 April 2015

Indian Independence League - Gandhi WW2 Propaganda Leaflet - stampomania. Blogspot.in- 3 July, 2010


The Bow of Burning Gold/ Hiren Mukherjee [Peoples Publishing House, 1977]