স্লেট
এখনকার কথা নয় অবশ্য। আমাদের সময়ের কথাই
বলছি। অক্ষর পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গে স্লেটের ওপর ‘অ’ লিখে দিত মা, আর
তার ওপর চলত হাত ঘুরোনো। হাত ঘুরতে ঘুরতে অক্ষর
মোটা হত, ধেবড়ে যেত, অনেক সময়ে কাত হয়ে পড়ে যেত স্লেটেই। কখনও বা চাপের চোটে
পেন্সিল ভেঙে যেত মট করে। এই কসরতে খুব যে মন
থাকত সব সময়ে তাও না, প্রথম কয়েকবারের পর অবধারিত ভাবেই মন অন্য দিকে
চলে যেত। আর মাথায় একটা চাঁটি
পড়লে আবার মন ফিরত। এভাবেই হাত ঘুরতে
ঘুরতে একদিন নিজে নিজেই লিখে ফেলা গেল ‘অ’, তারপর ‘আ’... আবার ‘ঈ’-তে
এসে আটকাত কিছুদিন। ‘ঊ’-তেও
তাই। ‘ঋ’ লেখা ছিল সব থেকে
শক্ত পর্ব। এই সময়ে কতবার যে
শোনা যেত, এই মেয়ের আর লেখাপড়া
হল না! এরপর ইংরেজি অ্যালফাবেট। তার আবার ক্যাপিটাল
লেটের দিয়ে শুরু হত। বেশ টকাটক এগোত কিন্তু
তখন। আবার স্মল লেটারে এসেই সমস্যার শুরু হত। এরই মাঝে অঙ্ক আছে। হাতে গুণে বা স্লেটের
একপাশে একটা বা দুটো দাঁড়ি কেটে রেখে দেওয়া। কখনও কখনও আবার একটা দাঁড়ি না দুটো,
এই কনফিউশনে অঙ্ক ঠিক হয়েও ভুল হওয়া। আর সবচেয়ে মজার
ব্যাপার হল, ঠিক হোক বা ভুল, সব মুছে দেওয়াই যেন নিয়তি। একটা জল
ন্যাকড়া বা এক টুকরো স্পঞ্জ দিয়ে স্লেট যতক্ষণ না সাফসুতরো হচ্ছে, ততক্ষণ পড়াশোনার হাত থেকে ছুটি নেই।
একটু বড় হলে
স্লেট একঘরে হতে থাকল। প্রেস্টিজে লাগত যেন স্লেটে লিখলে! আমি কী যথেষ্ট বড় হই নি?
এই তো গোটা গোটা করে লিখে দিচ্ছি শব্দ - বাংলা, ইংরেজি দুটোই।
অঙ্কও তো করছি ঠিকঠাক। এখন তো আর দাঁড়ি কেটে রাখতে হয় না, আঙুল গুণেই যোগ বিয়োগ
করতে পারি। আর কারসিভ রাইটিং-এর জন্য চার লাইনের খাতা না হলে তো হয়ই না। আর বাংলা
হাতের লেখার জন্যও রুলটানা খাতা চাই। মনে আছে তো? বাংলা শব্দদের লাইনের মাথা থেকে
লিখতে হয়। লাইনগুলো বাংলা শব্দের ছাদের মতো থাকে। বাংলা শব্দের টিকিরা ছাদ ফুটো করে বেরিয়ে পড়ে। ওরা
কিছুতেই বোঝে না, বৃষ্টি নামলে ভিজে যাবে পুরো খাতা। আর ইংরেজি শব্দের শুরু হয়
লাইনের ওপর থেকে। লাইন যেন ইংরেজি শব্দের মেঝে। স্মল লেটারের লেজগুলো আবার মেঝে
ভেদ করে নেমে যায়। আর টিকিগুলো ওপরের লাইন ছুঁয়ে ফেলে ভাবে, এই বুঝি আমার আকাশ।
এভাবেই একদিন
শব্দের মায়ায় জড়িয়ে যাওয়া। শব্দে শব্দে কেমন যাদু তৈরি হয়, দেখতে দেখতে বুঝে নেওয়া। কিছু শব্দ যেমন
আমার হাতের নড়াচড়ায় জন্ম নেয়, তেমনি কিছু হঠাৎ করে খাতায় এসে পড়ে। যেন আকাশ থেকে
ঠিক সময়ে টুপ করে পড়ার জন্য তৈরি ছিল। এই দৈব শব্দরা কখন এসে উদ্ধার করবে, আর কখন
বুকে তৃষ্ণা জাগিয়ে ছটফট করাবে, কেউ জানে না। যে শব্দ মুগ্ধতা ছড়ায়, সে
শব্দই তার কালো রূপ দেখিয়ে বিতৃষ্ণা আনে। যে শব্দ প্রেম জাগায়, তারই কুটিল ঈর্ষা ভরা মুখ দেখে বিস্ময় জাগে। শব্দ যেন মোহাচ্ছন্ন
এক নারী। শব্দ যেন বিষাদগ্রস্থ
এক প্রকৃতি। শব্দ যেন হতাশ এক
পুরুষ। শব্দ যেন আদিম কোনো পৃথিবী। শব্দ যেন সিলেবাস
মুখস্থ করা কোনো পরীক্ষার্থী। শব্দ চাকরি পাওয়া
যুবক। শব্দ মৃত্যুর মতো আত্মহত্যাপ্রবণ! আসলে সে এক খামখেয়ালী বালিকা! আমাদের
বোধশক্তির ঊর্দ্ধে সে থাকে।
কিছুদিন বাদে এও
বোঝা গেল, দৈবশব্দ বলে
কিছু হয় না। পুরোটাই পরিশ্রম আর তার ফসল। আর অভ্যেস। কবেই তো কে যেন বলে গেছেন,
লিখতে লিখতে সরে। কতটা সরবে, মানে তোমার কলমের সামনে যে বড় বড় পাথরগুলো পড়ে আছে,
তাদের তুমি কতটা সরাতে পারবে, পুরোটাই তোমার
ব্যাপার। আমি লিখতে বসলেই পাই কাঁকড় বিছানো খাতা। আমার পেন চলতে থাকে খরখর
শব্দ করতে করতে। আমি এই শব্দের সঙ্গে আমার বর্ণমালা দিয়ে তৈরি শব্দ মেশাতে গিয়ে
বুঝি সেই স্লেটের দিনগুলোই যত নষ্টের মূল। স্লেট যদি না
থাকত, সেই ধূসর রঙ যদি শব্দের হাত না ধরাতো, আজ এই সংঘর্ষের পথে আসতে হত না। আসলে
স্লেট ধূসর ছিল না, এখন বুঝি। স্লেট
ছিল বর্ণচোরা। যেদিন ওর একটা কোণা ভাঙল, সেদিন ওকে আরও ম্যাড়ম্যাড়ে
দেখাচ্ছিল। তখন মনে হত, আবার কবে একটা নতুন যে আসবে! তবু যদ্দিন না নতুন আসত, ওই কোণা
ভাঙা স্লেট দিয়েই কাজ চালাতে হত। এক সময়ে আরও একটু ভাঙত, তখন মনে কেমন যেন মায়া
জাগত ওর ওপর। মোছার পর ওর ঠান্ডা গা গালে চেপে ধরলে এক ধরনের আরাম হত। তখন বুঝতাম
না, এখন বুঝি ওই ঠান্ডা স্পর্শটা আসলে শুশ্রূষার মতোন ছিল। জ্বর হলে কপালে মায়ের ঠান্ডা হাত
বোলানোর মতো। তবে
এ ক্ষেত্রে ওই ভাঙা স্লেটের ঠান্ডা ছোঁয়া আর আমার গাল দুই
পক্ষই শুশ্রূষা পেত, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
শব্দের সঙ্গে
শব্দ মেশানোর কথায় আবার ফিরে আসি। খাতার খরখর শব্দ যেদিন মসৃণ হয়ে ধরা দিয়ে
বর্ণমালায় মিশে যাবে, সেদিন ওই মিলিত
শব্দ কানে সুর হয়ে ধরা দেবে। ততদিনে হয়ত অনেক কলমের কালি ফুরিয়ে
যাবে, অনেক লেখকের মৃত্যু হবে, অনেক নতুন শব্দেরও জন্ম হবে, মৃত্যু হবে আরও
অনেকের। মাঝের এই ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মতো যে চেষ্টা লেগে
থাকবে, সেটুকুই বরাবরের মতো থেকে যাবে। সুর আর অ-সুরের বোধ থাকে মনের ভিতর। যার সেই বোধ নেই, তার
মানব জন্ম অসার্থক। ‘অ’ টুকু তুলে নিলেই সুর
থেকে যায়। ব্যথারও সুর থাকে, সুখেরও। জীবনে কে কতটা সুরকে
ঠিকমত টিউনিং করতে পেরেছে, তার ওপরই চলে জীবনের সার্থকতা। ‘নেই’-টাকেও সুরে বেঁধে
ফেলতে যে পারে, সেই বোধহয় মানুষ। আমি সেই মানুষের দিকেই
তাকিয়ে দেখি, তার রূপ থেকে যে আলো বেরোয়, তাকে পান করি বুক ভরে। হতাশ হই এই ভেবে, কেন
যে এখনও ‘নেই’ লিখতে শিখি নি! হয়ত যেদিন ‘নেই’
লিখতে শিখে যাব, সেদিনই আমার খাতায় পেন চলবে বিনা শব্দে। গতি জাড্যে শব্দরা চলতেই
থাকবে, চলতেই থাকবে। আর মাঝেমাঝে ওরা পিছন ফিরে দেখে নেবে সেই স্লেটটা ঠিকঠাক মতো আছে কিনা! কোণা ভাঙলেও তাকে বাতিল করা যাবে কিনা! পেন্সিলের গুঁড়ো লেগে সাদা হয়ে যাওয়া স্লেটকে আবার ঠিক মতো মুছে চাকচিক্য ফেরানো গেল কিনা! এই পিছন ফেরাটুকু না থাকলে বুঝি এগনো
যায় না। যতই তুমি বল, পিছনে ফিরে দেখতে নেই, অতীত অতীতই, অতীতকে ভুলে যাওয়াই ভালো; তবু কিছু স্মৃতিকে নেড়েচেড়ে মাঝেমাঝে দেখে নিতে হয় ওই
স্লেটের মতো। না হলে আর কোনোদিনই ‘নেই’ লেখা
যাবে না।
বিষয় বেশ খুঁজেপেতে বের করছিস ।
উত্তরমুছুনএই বিষয়কেও খুঁজে পেতে গেলে অনেক কসরৎ করতে হয় মনে মনে।কখন যে কোনটা ক্লিক করে যাবে..এ বিষয়ে তুমি অনেক বেশি জান, আমি জানি।
মুছুনআমি ছোটোবেলায় জানতুম একে বলে সিলেট । পরে দাদা পাঠশালায় পড়তে গিয়ে জেনেছিল যে এটা সিলেট নয় স্লেট, ইংরিজি, ইংরেজরা এতেই লেখা পড়া করা, আমাদের মতন কাগজে উডপেনসিল দিয়ে লেখে না । ওরা কতো চালাক, না ? কাগজ নষ্ট করে না । আর আমরা লিখে লিখে কত্তো কাগজ নষ্ট করি ।
মুছুননস্টালজিক লেখা
উত্তরমুছুননস্টালজিক লেখা
উত্তরমুছুনদারুণ বিষয় আর লেখাটাও খুব ভালো।
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
মুছুন